শিক্ষকদিবসে মীনাক্ষী লায়েক

শিক্ষক দিবস পালনের যৌক্তিকতা কতটুকু?
৫ সেপ্টেম্বর, ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণকে স্মরণ করে দিনটি আমরা টিচার্স ডে রূপে উদযাপন করি। কিন্তু আজ রাধাকৃষ্ণণজী জীবিত থাকলে শিক্ষক ও ছাত্রদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবন করে দেশের মানুষের কাছে লজ্জিত হতেন বোধহয়। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় অহরহ ঘটে যাওয়া শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের নৈতিক পতন যেভাবে সমাজকে কলুষিত করছে, স্বভাবতঃই প্রায় সকলেই মনে করে ৫ সেপ্টেম্বর দিনটি শুধুই একটি প্রহসনের দিন।
বেদ পুরাণের কাল থেকে গুরু-শিষ্য অর্থাৎ শিক্ষক -ছাত্রদের পারস্পরিক সম্পর্ক একটি অচ্ছেদ্য পবিত্র সম্পর্কের মধ্যে বিরাজমান ছিল। শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা, প্রেম, স্নেহ, শাসন, অন্তরের তীব্র টান, আস্থা সবকিছুই এই পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে অনেকদিন বিদ্যমান ছিল। আজ সে সম্পর্ক ধুলি -ধূসরিত। অবনতির বহুবিধ কারণগুলি খুঁজে পেতে বের না করলেও চলে, সবাই কারণগুলি মোটামুটি জানে। শুধু জানে না কলুষতার ফাঁকগুলি নির্মমভাবে বিদায় করতে। মানুষ এখন যেন নির্বিকার কাষ্ঠপুত্তলি। সামাজিক অবনতির দিনগুলি তারা নিজেরাই আহ্বান করেছে, তারা বোঝে নি অনাগত দুর্দিনের ভয়ংকরতার রূপটিকে। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে গেছে বোঝা যায় যখন দেখা যায় শিক্ষক প্রহৃত হচ্ছেন ছাত্রদের হাতে, ঘেরাও হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন। আবার কোনো সময় কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষকের হাতে ছাত্রীর শ্লীলতাহানির মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটছে। কেন এই সামাজিক অসুস্থতা?
প্রথম ও ভয়ঙ্করতম কারণটি হলো শিক্ষা ব্যবস্থায় রাজনীতির নির্লজ্জ প্রবেশ।
প্রাইমারী থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট অব্দি প্রত্যেক শিক্ষক, প্রতি ছাত্র ( ছাত্রীও ধর্তব্য, ছাত্রসমাজ বলতে শিক্ষারত সমস্ত পড়ুয়াকেই বোঝানো হচ্ছে), প্রতি বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অফিস, কর্মচারী, মাইনে, এমনকি পরীক্ষাগুলিতেও রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি বন্যার মতো ঢুকে শিক্ষাব্যবস্থাকে সর্বশান্ত করে তুলেছে। সমাজের বড় বড় মাথাওয়ালা রাজনীতিবিদরা বহুদিন পূর্বেই বুঝে গেছে সবল-সতেজ-আবেগপ্রবন-কর্মক্ষম ছাত্রসমাজকে এবং তার সাথে করে খাওয়া সৎ শিক্ষকদের যদি রাজনীতির আবর্তে এনে ফেলা যায় তবে কেল্লা ফতে। চুলোয় যাক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, চুলোয় যাক পারস্পরিক ভালোবাসা, চুলোয় যাক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের শিক্ষার প্রতি দায়বদ্ধতা।
দ্বিতীয় কারণ, শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার অভাব। আজকাল শিক্ষকতা একটি পেশামাত্র। পড়ানোর দায়বদ্ধতা না থাকলেও চলে, মাসের শেষে বেতনটুকু পাওয়া যায়। উপরি পাওনা টিউশন, সেজন্য ক্লাসে জান-প্রাণ দিয়ে না পড়ালেও চলবে। কোনরকমে সিলেবাস শেষ, যাঃ, আর কার কি বলার আছে। না পড়ালেও সরকারী বিধি অনুযায়ী লটারীতে গুচ্ছের পড়ুয়া ক্লাস ফাইভে ভর্তি হবে, ক্লাস এইট অব্দি না পড়ালেও পাশ, আর নাইন-টেন এ স্কুলে বাড়তি ছাত্র ফেল করিয়ে ক্লাসে ফেলে রাখবে না, অতএব পড়ানোর দায় নেই। স্কুলগুলিতে বাধ্যতামূলক ছাত্রভর্তি হলেও মিড ডে মিল, বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজ প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য শিক্ষকেরা পড়ানোতে মন দিতে পারেন না – কিন্তু বেতন ঠিক ঠাক। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পার্টিবাজি, ছাত্রদের ক্লাস না করা, শিক্ষকদের টিউশন এবং সরকারের মোসাহেবীতে দিন চলে যায়। না পড়ালেও চলে, বেতন ঠিকঠাক আসে। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের ভিত দেওয়া-নেওয়া। শিক্ষকেরা চাকরী পাচ্ছেন শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা দিয়ে, তাই শুধু তারা চাকরীই করছেন। ছাত্রদের নেওয়ার মানসিকতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, সম্পর্কের গ্রন্থিগুলি তাই আপনাআপনিই আলগা হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, আজকের ছাত্রসমাজ এক নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। তাদের শিক্ষকের কাছে কিছু নেওয়ার নেই। অমনোযোগী, অসহিষ্ণু ছাত্ররা দুর্বিনীত বেপরোয়া হয়ে উঠছে দিন দিন। তারা জানে বিদ্যালয় মানে মিড ডে মিল, জানে এইট পর্যন্ত বই মুখে পরিশ্রম করতে হবে না, জানে মাধ্যমিকটা কোনোমতে টেনে দিলেই চলবে, জানে যতই পড়ি এই পোড়া দেশে চাকরী-বাকরী নেই — বরং নেতাদের মোসাহেবী করলে কিছু জুটতে পারে, জানে শিক্ষক তাদের পড়াচ্ছেন মাস গেলে মাইনেটুকু পেতেই, জানে টিউশনে শিক্ষক তাদের কাছে পড়াটা বিক্রী করবেন – অতএব তাদের সন্মান করার কি আছে? ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষকদের গালিগালাজ এবং মারধোর করলেও তারা (ছাত্ররা) হয়তো অবোধ বলে পার পেয়ে যাবে, সন্মান যাবে শিক্ষকের, তাদের নয়। তারা জানে তারা যতই উৎপাত, বদমায়েশী করুক শিক্ষক শাসন করতে পারবেন না, তাদের হাত-পা বাঁধা। আর শিক্ষক শাসন করতে গেলেও যাঁতাকলে পড়বেন শিক্ষকেরাই, একদিকে ছাত্রদের অভিভাবকেরা তাদের ছাড়বেন না, অন্যদিকে মিডিয়ার রক্তচক্ষু।
শিক্ষাক্ষেত্রে বেহাল অবস্থার জন্য কিছুটা দায়ী অভিভাবকেরাও। আগেকার দিনে শিক্ষক শাসন করলে অভিভাবক বিশ্বাস করতেন শিক্ষকই ঠিক, তাদের সন্তান অন্যায় করেছে। এখন ঠিক তার বিপরীত অবস্থা। অনেক পড়ুয়াই বাড়ীতে সামান্যতম সহবতটুকু শেখে না। নিয়মানুবর্তিতা কাকে বলে বাড়ীতে তারা দেখেনি, তাই স্কুল কলেজে বিশৃঙ্খলা।
সবশেষে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতির কারণ অতি অবশ্যই মিডিয়ার তৎপরতা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য ঘটনাকে নেতিবাচকভাবে এত বৃহৎ করে দেখানো হয় যে শিক্ষকেরা ভয় পেয়ে যান। ভালো কিছু করার তাগিদ তাদের ভেতর থাকে না। একটা গা-ছাড়া ভাব, সব কিছু মেনে নেওয়ার মানসিকতা। ছাত্র অসুস্থ বোধ করলেও মিডিয়া স্কুপ নিউজ করে ‘শিক্ষকের নিগ্রহে ছাড়া অসুস্থ’।
সেই দিন আর নাই যখন যতীন পন্ডিত জমিদারবাবুর কাছে ঝরঝর করে কেঁদে বলছেন – “হুজুর, আমিই অপরাধী, আমি তস্কর”, কারণ ছাত্র মড়িরামের জন্য তিনি জমিদারের ভাঁড়ার থেকে কিছু ঘৃত আর মশলা চুরি করেছিলেন। বলেছিলেন ” ঘৃতটুকু হুজুর ওই ওকেই সেবন করতে দিয়েছি, মেধাবী ছাত্র, ঘৃতে মেধা বৃদ্ধি হয়” (পন্ডিতমশাই, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়)। অনেকদিন একলব্যর গল্প শোনা হয় না। আসলে দুই তরফেই ভালো গল্প শোনার তাগিদটা হারিয়ে গেছে। তাই ৫ সেপ্টেম্বর হুজুক করে ছাত্রেরা রকমারি গিফ্ট দিয়ে শিক্ষককে বাধিত করে, আর শিক্ষকেরাও সেই দিনটিতে শুতে যাবার আগে ভাবেন -উঃ, কাল আবার ক্লাস, আজকের দিনটি ছুটির আমেজে ভালোই কাটলো