• Uncategorized
  • 0

শিক্ষকদিবসে বিশ্বজিৎ আঁকুড়ে 

পেশায় শিক্ষক, নেশায় কবিতা। সম্পাদক - রাঢ় বনতলি

ক্ষয়ের জানালা দিয়ে দেখা অজস্র সে ক্ষত

“মাস্টার-মশাই আপনি কিছু দেখেননি!” জনপ্রিয় এই সংলাপটির জন্ম শূন্য দশকের প্রথম দিকে। তখন আমরা অবৈতনিক প্রাথমিক অতিক্রম করেছি মাত্র । ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক তখনও তলানি স্পর্শ করেনি।প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সবে কংক্রিট-রূপ ধারণ করেছ।গ্রাম্য পরিবেশ তখনও লালমাটি সবুজ-টিলা।প্রকৃতির কোলেই আমাদের সহজ-পাঠের প্রাথমিক শিক্ষা।গৃহশিক্ষকের কাছে অবশ্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয়-এর  প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ অধ্যয়ন করতে হত।

লালু স্যর, আমার প্রথম গৃহশিক্ষক।বাবা খুঁজে-পেতে তাঁকে উদ্ধার করেছেন -বাড়িতে এসে পড়ানো চাহিদার পূরণে   ।  প্রায় পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি লম্বা,দোহারা চেহারা,   গায়ের রঙ কালো ।গম্ভীর মুখে, হাসি চিহ্ন নিখোঁজ থাকতো  । স্যরের চোখের দিকে তাকালেই    চড়াম করে  বিদ্যুৎ ঝলক। শরীর থেকে  পাঁচ ইঞ্চি রক্ত শুকিয়ে যেত।গলায় একটা আস্ত মরুভূমির রুক্ষতা। সহজ পাঠের প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগের আনন্দগুলো প্রথমে মুখস্থ।তারপর না দেখে লেখা।না পারলে? বনের বাঘ এক্কেবারে সম্মুখে । গাছের পাখি পাড়া ছেড়ে পগার পার। জলের মাছ? ডাঙায় উঠে শুটকি-শুকো ।লালু স্যরের কঞ্চির আতঙ্কেই অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা, ইতিহাস-ভুগোল বিজ্ঞান  আয়ত্ত করেছি।

লালু স্যর ক্লাস ফোরের পর আর পড়াননি।এরপর স্কুল-কলেজের শিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। একঘাটের জল বয়ে গেছে অন্যঘাটে।  সমগ্র ছাত্র জীবনে স্যরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে  কথা বলার সাহস জোগান পাইনি কোনোদিন।শিক্ষান্তে একটা সরকারি চাকরি যদি কোনো প্রতিষ্ঠা হয়। তবে সেই     প্রতিষ্ঠা লাভের পর স্যরের কাছে গিয়ে বললাম — “স্যর আপনি আমার জীবনে এসেছিলেন বলেই আমি এতটা পথ অতিক্রম করতে পেরেছি। ” স্যরের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো।গলায় জটপাকানো অক্ষরগুলো স্বযত্নে সামলে বললেন — “তুমি তো পড়াশুনায় ভালো ছিলে!”……. কোত্থেকে একটা বিজয়ী  হাসি স্যরের সারা মুখে চেপে বসল—তুমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছো শুনে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। ছাত্রের সাফল্যে পৃথিবীর সকল মাস্টার-মশাই-ই উচ্ছ্বসিত হন। বিশ্বাস করুন, সেদিনই প্রথম স্যরের মুখে হাসির অনায়াস চলাচল দেখলাম।

যে সংলাপ দিয়ে এই গদ্যের সূচনা করেছি। সেই প্রসঙ্গে আসা যাক – আজ প্রতিটি  শিক্ষক দিবসের সম্মুখে দাঁড়িয়ে দেখি— ছাত্র-ছাত্রীদের সীমাহীন উদ্দীপনা।নিজের টিফিন খাবার টাকা গুছিয়ে হয়তো-বা সামান্য হলেও   অভিভাবকদের একটা বাড়তি খাতের জন্ম হয়েছে।শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে অনুষ্ঠান আয়োজন  ক’রে, শিক্ষকদের হাতে  উপহার সামগ্রী তুলে দেয়। শুনেছি গৃ্হশিক্ষকের বাড়িতেও ঘটা করে পালিত হয় এই মহান দিনটি।শিক্ষক দিবসকে ঘিরে একটা বাজারও তৈরি হয়েছে রীতিনীতি। আমরা শিক্ষক দিবসে এত উচ্ছ্বাসে  ভাসিনি। আমাদের শিক্ষক-দিবস মানে ফোর্থ পিরিওডের পর ছাত্র ভার্সেস শিক্ষকদের একটা ফুটবল ম্যাচ।যে ম্যাচে শিক্ষকরাই জিততেন। ক্রিকেট তখনও লোকক্রীড়াগুলিতে থাবা বসাতে পারেনি। এখন প্রশ্ন হল – একদিনের এই  শিক্ষক শ্রদ্ধার আনুষ্ঠানিকতা ঘিরে। যে মূল্যবোধের ক্ষয় শুরু হয়েছে শূন্য দশকের প্রথম দিকে আজ সেটা দগদগে ঘা। শিক্ষাঙ্গনের ভিতরে ও বাইরে শিক্ষক যখন  ছাত্র, অভিভাবক ও রাজনৈতিক রোষে  প্রহৃত হন ।মনে গহন কোণে তখন বিষাদ থৈথৈ করে বইকি! নানা প্রশ্নও তো ঘিরে ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে আহত  সময়কে।এই বৃহত্তর সমাজও শিক্ষা নিয়েছে কোনো না কোনো মাস্টার-মশাই-এর কাছে!

কেন এই  ক্ষয়ের কাছে নত হই বারবার? প্রশ্ন অনেক, তর্জনী প্রসারিত করা যেতেই পারে, একে অন্যের নাসিকা বরাবর। কিন্তু যে স্রোতের কাছে রেখেছি শরীর  সে কি ক্ষমা করবে আমাকে?……….

“কোনো তালিই বাজে না এক হাতে
ইতস্তত ছড়িয়ে রাখা তূণ প্রশ্নগুলি ব্যস্ত প্রতিঘাতে “

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।