• Uncategorized
  • 0

শিক্ষকদিবসে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় 

প্রাণীবিজ্ঞানে সাম্মানিক স্নাতক,শিক্ষাবিজ্ঞান ও বাংলায় স্নাতকোত্তর, বি.এড.। শিক্ষকতাকে তিনি নিছক পেশা না ভেবে অনেক বেশি কিছু ভাবতে ভালোবাসেন। অজস্র কবিতা,গল্প,প্রবন্ধ,আলেখ্য,সমালোচনামূলক লেখা,কয়েকটি নাটক এবং একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস। তাঁর বেশিরভাগ লেখাই দেশ-বিদেশের অজস্র নামি ও অনামি পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত।

আমার শিক্ষক   

আমার শিক্ষকদের নিয়ে বলতে গেলে অনেক প্রণম্যজনের
কথাই বলতে হয়।আমি সেই কথা আজ বলবো না।আমি এমন একজনের
কথা বলবো যিনি আমার প্রথাগত শিক্ষক ছিলেন না,ছিলেন আমার সহকর্মী।
শিক্ষক হিসাবে আমার জীবনের প্রথম স্কুল ছিল গোসাবার শম্ভুনগর হাই স্কুল।
সুন্দরবনের আবাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত কষ্টদায়ক,প্রায় নির্বাসনে আছি।
তখন বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় লেখা বেরোচ্ছে,নাটক লিখছি,নাটক করছি।
লোনাজল একটু সমস্যায় ফেললেও প্রায় সমবয়সী ছাত্রদের নিয়েও  বেশ আছি।
শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ও শম্ভুনগরে শিক্ষকতা করে গেছেন
তাই দুজন কবি-সাহিত্যিক একই প্ল্যাটফর্মে সহকর্মীদের সে কী উল্লাস!
আমি বরেনবাবু হতে পারবো না বলেই দিয়েছিলুম।তবু…..  তাঁরা ভুললে তো!
যাক সবচেয়ে উল্লসিত হয়েছেন তরণীবাবু,তরণী মল্লিক,আই এস সি অর্থাৎ
ইন্টেরমিডিয়েট অফ সায়েন্স,স্নাতক নন,গণিত আর বিজ্ঞান পড়ানোর কথা।
অথচ পড়ান বাংলা।শুধু পড়ান না দাপটের সঙ্গে পড়ান পণ্ডিত মানুষ বহুগ্রামের
মানুষ তাঁকে চেনেন।বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও আমার সাহিত্যপ্রীতি দেখে তিনি শিষ্য
বা সন্তানের মতো টেনে নিলেন।দু কি মি দূরের গ্রাম ঝাউখালি থেকে নদীবাঁধ ধরে
হেঁটে আসেন,ক্বচিৎ ভটভটিতে।স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানেই তরণীবাবু।
নির্দেশনা,রিহার্শাল,পরিকল্পনা সবই তিনি করেন।সেবার যুক্ত হলাম আমি।
কঠোরভাবে শৃঙ্খলা রক্ষা করেন তিনি।চার ফুট দশ ইঞ্চির ছোট্টমানুষটি কর্ণকুন্তী
সংবাদের তালিম দেন চোখ বন্ধ করে।আবৃত্তি শেখান তন্ময় হয়ে।তিনি আমাকেও
অনেক শেখালেন,যা শেখালেন তার চেয়ে বেশি শিখিয়ে নিলেন।তাঁর শ্যামল বরন উজ্জ্বল
হয়ে ওঠে যখন আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ভালো বলতে পারছে,ভালো নাচতে পারছে
কিংবা ভালো অভিনয় করতে পারছে।কিন্তু ভুল করলেই সেই মুখ কালো হয়ে যাচ্ছে,
হাতে লিকলিক করে উঠছে বেত।রবীন্দ্রজয়ন্তীতে মঞ্চের সামনে দূরদূরান্তের গ্রামের
মানুষ উপচে পড়েছেন। তরণীস্যার এইপ্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন আমিও
মনপ্রাণ এক করে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত একটি অঞ্চলের স্কুলে প্রাণের ঠাকুরের পুজো
নিঁখুতভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি।স্কুলের সকলে আজ এক মন এক প্রাণ।
আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রিয় কঠোর হৃদয় শিক্ষক তরণীস্যার।এদিন তাঁর কাছে
কেউই ধর্তব্যে আসেন না,তিনি অপ্রতিরোধ্য অপরাজেয় বিধাতা।
না বললেও সবাই বুঝে যাবেন,সেবার অনুষ্ঠান অত্যন্ত ভালো হয়েছিল।খুশির বাঁধ ভেঙে
গিয়েছিল।এমন কি হেডস্যার পর্যন্ত আবেগাপ্লুত গলায় বলেছিলেন,ওঃ!দারুণ করেছো তোমরা।
একান্তে আমাকে সাশ্রুনেত্রে জড়িয়ে ধরলেন তরণীবাবু।বললেন,জয়ন্ত,আজ তোমার জন্যই
সবকিছু এত ভালো হয়েছে।আমি প্রতিবাদ করলেও তিনি মানলেন না।অকাতরে শিক্ষার্থীকে
অনেকটা কৃতিত্ব দান করে তিনি তৃপ্ত হলেন।এমন শিক্ষক জীবনে পাইনি।পরবর্তী জীবনে তাঁর
শিক্ষা আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রয়োগ করে বেশ সাফল্য পাই।তাঁকে ভুলতে পারিনি।
শেষ কথাটা না বললেই নয়,যেদিন নতুন স্কুলের উদ্দেশ্যে শম্ভুনগর ছেড়ে আসার কথা
ঘোষণা করলাম, স্কুল এবং গ্রামে শোকের আবহ তৈরি হলো।স্নেহপ্রবণ তরণীস্যারের
মুখের দিকে তাকানো যায় না…….।যেন অকালে তাঁর পরমাত্মীয় বিয়োগ হয়েছে।
আর যেদিন লঞ্চে উঠলাম বাঁধ উপচে পড়া প্রিয় ছাত্রছাত্রী, মানুষজন,সহকর্মীদলের দিকে
তাকাতে পারছিলাম না।আর তরণীস্যারের সেই সশব্দ কান্না এখনও বুকে হাতুড়ি পেটায়
চোখ জলে ভরে ওঠে এই হাজারো সমস্যা জর্জরিত সময়েও।
প্রণাম তরণীস্যার।আমার শিক্ষক।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।