• Uncategorized
  • 0

শিক্ষকদিবসে বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

জন্ম ১৯৭২,পুরুলিয়ায় ।।কবি ও গল্পকার।। কেতকী সম্পাদনার সাথে যুক্ত।। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর । দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ এক ডজন। পেয়েছেন ত্রিবৃত্ত পুরস্কার মালীবুড়ো সম্মান সহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা।

শিক্ষকদিবস, কিছু স্মৃতি, অনন্ত বর্ণমালা

সারা জীবন ধরেই তো শেখা। এর বিরাম নেই, ছেদ নেই, বিরতি নেই।এক একটি অভিজ্ঞতা আমার কাছে বর্ণের মতো। তার গায়ে লেগে থাকে সুখ দুঃখ আহ্লাদের রঙ ।কী নিপুন ভাবে জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকে এর প্রতিটি স্তর। কখনও বাঁক নেয় আবার কখনও তা ঋজুপথে চলে যায় বহুদূর পথ। শিক্ষকদিবস তাই প্রতিদিন।প্রতিটি বীক্ষণবিন্দুর সামনে দাঁড়িয়ে এর উদযাপন।

এখন শিক্ষকদিবস নিয়ে যে হুল্লোড় হয়, আমাদের সময়ে তা ছিল না।চুপচাপ নীরবে কখন পেরিয়ে যেত এই দিনটি, আমরা টেরই পেতাম না। ঢাক ঢোল বাদ্যি বাজানোর কোন আওয়াজ বুঝতে পারতাম না। সাজ সাজ কোন রব ছিল না।তার মানে আমাদের মধ্যে কি কোন শ্রদ্ধাবোধ ছিল না সেদিন ? তার মানে আমাদের মধ্যে কি কোন টান কোন কৃতজ্ঞতা ছিল না ? উপহার হিসেবে দামি দামি কলম নয়, রকমারি মোড়কে ঢাকা পার্থিব কোন বস্তু নয় এমনকি নিজের ডানহাতের বুড়ো আঙুলও নয় আত্মনিবেদনের ভেতর দিয়ে একলব্য হতে পারার অগ্নিস্পর্শী স্বপ্নই আমাদের ভেতরে লালিত পালিত হয়েছে প্রতিদিন। হয়েছে বলেই এক একটি অক্ষরের গায়ে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে এক একজন শিক্ষকের মুখ।

বাবলুদার কথা মনে পড়ে খুব। দাদুর কাছে শুরুটা হলেও বাবলুদাই আমাকে শিখিয়েছিল এক একটি বর্ণ।তার সেই বর্ণপরিচয় ছিল অন্যরকমের। অ এ অজগরের হা- মুখ দেখিয়ে বলত দেখছিস খিদের কী ভয়ংকর রূপ। তাই অ- য়ে অজগর নয়, অ- এ অন্ন, আ এ আম নয়, আমটা ঝুলে আছে আকাশে তাই আ এ আকাশ। আজ মনে হয় জীবনের এই সহজ অথচ অমোঘ সত্যের প্রথম পাঠ শুরু হয়েছিল সেদিনই। যে যাই বলুক না কেন আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা আমাদের খিদে মেটায়। পেটের খিদে, মনের খিদে। বাবলুদা বুঝেছিল এ কথা। এবং সেই বোধ সঞ্চারিত করতে পেরেছিল হয়তো আমাদের মধ্যেও।মনের বিস্তার থেকে জন্ম হয় আকাশের। মুক্ত চিন্তার। যৌক্তিক অনুধাবন এই আকাশকে পূর্ণতা এনে দেয়। শিক্ষা তাই আকাশ। মুক্ত স্বাধীন স্বতন্ত্র চিন্তার আকাশ। সূর্যোদয়ের মন্ত্র, তিমিরহননের গান।বাবলুদাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম মাসিক কৃত্তিবাসে ” ঈশ্বরদা”।নতুন বর্ণপরিচয় নিয়ে শিশুমনের জানলায় এক একটি অক্ষর স্থাপন করছে একজন গৃহশিক্ষক।সেই অক্ষরের গায়ে জল আলো আর কাদামাটি। সেই অক্ষরের গায়ে প্রোটোপ্লাজমের ঘ্রাণ। নির্জন স্লেটের উপর সাদা দাগ। দাগ নয় আসলে পথনির্মাণ। আঙুল ধরে ধরে রাস্তা হাঁটতে শেক্ষাচ্ছে কেউ।উঁহু, এভাবে নয়, আমার মতো করে নয়। একদম নিজের মতো করে প্রত্যেকটি আঁচড়ের মূলবিন্দুতে চেতনার স্রোত ছড়িয়ে দিতে হবে।তবেই তার ভেতর তৈরি হবে প্রোটোপ্লাজম, মানে প্রাণনির্যাস।
“ জলের পোকা জলকে যা, আমার স্লেট শুকিয়ে যা” বলতে বলতে আমরা তখন বাতাসের ভেতর মিশিয়ে দিচ্ছি স্লেটের আর্দ্রতা। জল শুকিয়ে আসছে, আবার নতুন করে শুরু হবে লেখা। যাবতীয় কাটাকুটি সংশোধন দিয়ে এবড়ো খেবড়ো রাস্তাকে, ভুলপথকে চলনযোগ্য করে তোলার প্রয়াস আঁকছি আবার, আবার, বারবার।
ক্লাস এইটে এসে যে মানুষটির চিন্তাভাবনা আমাকে তুমুলভাবে আলোড়িত করেছিল তিনি সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার মাস্টারমশাই। প্রকৃত অর্থেই আমার পথপ্রদর্শক।লাজুক মুখচোরা এবং প্রায় শেষের সারিতে বসে থাকা  একটি ছাত্রকে তিনি ভালোবেসে তুলে আনতে পেরেছিলেন প্রথম বেঞ্চে।অনেক ভীতি ও দুর্বলতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন কত সহজেই।
 তাঁর ক্লাসে উত্তর বলতে না পারার কোন ভয় ছিল না। ছাত্রদের মুখ থেকে উত্তর শোনাকে তিনি একদমই গুরুত্ব দিতেন না।বলতেন –আমাকে প্রশ্ন করে যা । উত্তর আমি দেব। জিজ্ঞাসার উদ্বোধনই হচ্ছে শিক্ষা। জবাব অনেক কিছু হতে পারে, সত্য, মিথ্যে ভুল বা ভ্রান্তিপূর্ণ।ঠিক বা ভুল আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে তাকে নির্ধারন করা যাবে না। চিরজাগরুক কৌতুহলের ভেতরেই লুকিয়ে আছে পাঠ্যস্পৃহা। প্রশ্ন না থাকলে উত্তরের কোন অস্তিত্বই নেই।সত্যের আড়ালে অনেক মিথ্যেও লুকিয়ে থাকে। প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তবেই গ্রহণযোগ্য সারমর্মকে ধারণ করতে হবে। যেদিন এই ক্লাসরুম থাকবে না, সেদিন থাকবে আত্মজিজ্ঞাসা। আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি জিজ্ঞাসাই জীবনের গতিজাড্য।
ভজনদা দ্রুত লিখতে বলেছে এই গদ্য।একটু স্মৃতিতাড়িত হয়ে যাচ্ছি বোধ হয়। চল্লিশে দাঁড়িয়েই কবি বলেছিলেন- “ আমি বুড়ো, প্রায় বুড়ো, কী আছে আমার আর মদমত্ত স্মৃতিখানি ছাড়া” ডাউন মেমোরি লেন দিয়ে হেঁটে আসা বয়সের সাথে সমানুপাতিক কীনা জানি না কিন্তু কখনও কখনও চলার পথে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিতে ইচ্ছে করে সেইসব দিন। একটা জীবন গড়ে উঠে  যে পথরেখা ধরে সেই রেখার সামনে প্রণত হয়ে বসতে ইচ্ছে করে দুদণ্ড।
প্রতি মূহূর্তেই তো শেখা। প্রতিষ্ঠানের ভেতরে বাইরে বিভিন্ন পরিসরে, বিভিন্ন পরিজন ও অপরিচিতজনের কাছ থেকে।সব কথা লেখা যাবেও না এখানে। লিখতে ইচ্ছে করছে অনেক শিক্ষকের কথাই। যারা কাছে জড়িয়ে আছেন যারা ভৌগোলিক দূরত্বে সরে গিয়েও হৃদয়ের গভীরে রয়েছেন সবার কথাই। অনেক উজ্জ্বল মুহুর্ত আর  অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতি নিয়ে রোজই আমার শিক্ষকদিবস।
একটি বিদ্যালয়ে যতজন ছাত্রছাত্রী আসে সবাই সফল হবে, উঠে আসবে আলোর বৃত্তে এরকম তো নয়। বিদ্যালয়  এক প্রয়াসের নাম।কেউই ব্যর্থ নয়, অসফল নয় এখানে।যে ছেলেটা  ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পকেট থেকে বিড়ি বার করে দূরে বটগাছের তলায় বিড়ি টানতে টানতে অঙ্কের ক্লাস পার করত। বীজগণিতের কোন সুত্রই মুখস্ত রাখতে পারত না। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাষা খুঁজতাম। প্রশ্ন করেছিলাম  –ক্লাসই যদি করবি না তো কেন আসিস স্কুলে? এ ঠিক জিজ্ঞাসা নয়, মনের ভেতর উঁকি দিয়ে সোজাসাপ্টা উত্তর নিষ্কাশন করে আনা।ছেলেটি নির্দ্বিধায়  বলেছিল – পড়তে আমার ভাল্লাগে না। একদম ভালো লাগে না। তবু আসি বাবার ভয়ে নয়, মায়ের ভয়ে নয়, তোদের জন্য । তোদের সাথে কাঁধে কাঁধ রেখে কত গল্প ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছি এখানে।এই গল্পগুলো থেকে যাবে।এরা মরে না, মরবে না কোনদিন। স্কুল শুধু  নম্বর কুড়োনোর জায়গা নয়, নম্বরের চেয়ে বেশি কিছু পাই বলেই তো আসি।
 আমারই বন্ধু, সহপাঠী সে। আমাকে শিখিয়েছিল বহুব্যপ্ত জীবনের কথা।আপাত অপ্রাপ্তির ভেতরে লুকিয়ে আছে এক পরম প্রাপ্তির পথ। খুব সহজ ভাষায় শিখিয়েছিল জীবন ও জীবনের চিরস্থায়ী আনন্দের স্বরূপ।
আমাদের হেডমাস্টার শ্রদ্ধেয় সমীরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলে এই লেখা শেষ করব।জীবনের প্রতিক্ষণে তাঁকে অনুভব করি। একজন মহৎ শিক্ষক মানে একজন মহৎ মানুষ।যাঁর জীবনদর্শনই আলোকিত করবে উত্তরকালকে, উত্তর প্রজন্মকে। শিক্ষক যে প্রকৃত অর্থেই  সমাজ গঠনের কারিগর এ শুধু কথার কথা নয় আমৃত্যু তিনি সেই সাধনায় ব্রতী থেকেছেন।সমাজের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষের বিকাশ ছাড়া সামাজিক কল্যাণ সম্ভব নয় তাঁর স্বপ্ন ও সংকল্প এই মানবিক দায়বদ্ধতার বন্ধনে ব্যাপৃত থেকেছে আজীবন। তিনি নিরলসভাবে সেই কাজ  করে গেছেন।কম্পাসের মতো দিকদর্শনের ক্ষেত্রে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। সেরকম ভাবে  কখনও পিতার মতো কখনও অবিভাবকের মতো পাশে দাঁড়িয়েছেন এই ভূখন্ডের সমস্ত মানুষের। নীতির প্রশ্নে কঠিন এবং আপসহীন। টানটান শিরদাঁড়া। আবার অন্যদিকে  পরম স্নেহময়।
  আমার সৌভাগ্য যে এরকম একজন বিরল দৃষ্টান্তের মানুষের স্নেহের স্পর্শ আমাকে পেয়ে ধন্য হয়েছি। এই  আলোকসম্ভার থেকে একবিন্দু আলোর প্রত্যাশা আমার সারা জীবনের সাধনা।
A teacher, a child and a pen can change the world  আমি বিশ্বাস করি এই স্বপ্নে।একজন প্রকৃত শিক্ষক অনেককিছু বদলে দেয়, দিতে পারে।প্রতিটি শিশুর ভেতর সম্ভাবনা আছে সেই অপরাজেয় শক্তির জাগরণ সম্ভব হয় শিক্ষকদের স্পর্শেই।
শিক্ষকদিবসে প্রতিটি শিক্ষককে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রণাম।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।