দুই আত্মীয়া মুখোমুখি বসে গল্প করছেন। বয়সে ১৫/২০ বছরের বড় হবেন। মুখোমুখি তবে কাছাকাছি নয়। দুজনের মাঝখানে তিন মানুষ ফারাক। একটা বই রয়েছে দাদুর ঘরে। ওটা আদ্ধেক পড়ে উঠতে হয়েছিল মা ডেকেছিল বলে। আবার পড়বার জন্য দাদুর ঘরের দিকেই যাচ্ছি। পথ জুড়ে ওঁরা গপ্প করছেন। আমি মাঝখান দিয়ে চলে গেলাম কালো বুকশেলফটার কাছে। ওটার ওপরে ঢাউস রেডিওর পাশে উপুড় করে রাখা আমার বই। এমনিতে এতদিন হাত যেত না। এখন লম্বা হয়েছি। হাত যায় ওটার ওপর। নিরিবিলি রাখতে হলে ও জায়গাই শ্রেয়। কারো কৌতূহল, পাকামি, দেখি দেখি কী বই… ইত্যাদি ভ্যানতাড়ার হাত থেকে বাঁচার সহজ উপায়। বই নিয়ে বেঁটে জানলার পাশে ধপ করে বসতে যেতেই কানে এল- “ ছোটমামীর শিক্ষা দিক্ষা দেখসস? মাইয়াটা ধাড়ি হইয়া গেলো কোন সহবৎ শিখায় নাই। দুইজনে গল্প করতাসি কোনদিকে না চাইয়া চইল্যা গেল মাইঝখান দিয়া।” তখন বয়ঃসন্ধির শুরু। কানে এল কিন্তু মাথায় নয়। কেননা আমি ডুবে গেছি গজেন্দ্রনাথ মিত্রের বইটায়। সন্ধ্যাবেলায় তারা চলে গেলে মা ঘরে এসে জিজ্ঞেস করল তুই ওদের সঙ্গে অসভ্যতা করেছিস নাকী? আমি অবাক হয়ে আকাশ থেকে পড়লাম। এমনিতে খুব শান্ত ছিলাম আর অসভ্যতা করবার মত মেয়ে নই বলেই মা রিচেক করতে আমাকেই প্রশ্ন করেছিল। তখন সেই প্রথমবার আমি শুনলাম আমি নাকী যথেষ্ট সহবৎ শিক্ষা পাই নি। মনে আছে আমার জ্ঞান মতে কোন অপরাধ না করেও কেউ আমায় এত তিরস্কার করতে পারে ভাবতে পারি নি। মা কে আমার জন্য কখনও নালিশ শুনতে হয় নি। আজও মনে দাগ বসে আছে সামান্য ঘটনাটার। আমাদের বাড়িতে বাবা মা কারো কাছেই আমরা ভাইবোনেরা মেয়ে বা ছেলে বলে আলাদা কোনরকম ব্যবহার বা শিক্ষা পাই নি। যা কিছু ঠিক তা সকলে মান্য করবে, যা বেঠিক তা কেউ করবে না- এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় হয়েছি সবাই। যার ফলে ‘লক্ষ্মী’ হওয়ার প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা, কর্তব্য, পুরষ্কার কোনকিছু নিয়েই কোন ধারণা ছিল না। তবে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম লক্ষ্মী হওয়া ‘মেয়েছেলে’র কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। মানে বাড়িতে বোঝানোর কেউ নেই বলে সমাজের বোঝানোর মহান কর্তব্য এল। কত রকম উপদেশ- “পা ফাঁক করে দাঁড়াতে নেই”, চিত হয়ে শুতে নেই, গা এলিয়ে বসতে নেই, জোরে কথা বলতে নেই, এমনকী গ্লাসে মুখ লাগিয়েও খেতে নেই আলগোছে গিলে খেতে হবে জল ইত্যাদি হাজার জিনিষ। বিয়ে করব ঠিক করেছি। প্রেম করেই। ডেট ঠিক হয়ে গেছে। একদিন বিকেলে লুচি বানাচ্ছে মা আমি পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছি। আত্মীয় এল বাড়িতে। আমাকে বলল লুচি বেলতে পারিস তো? আমি স্মার্টলি বেলনচাকি টেনে ময়দা বেলতেই কাছাখোলা ব্যাপার। – একী!!!! বড়দি, তুই মাইয়ারে রান্নাবাড়ি কিছুই শিখালি না? মিনিমাম কিছু তো শিখাবি! তার চোখ কপালে দেখে ভাই দৌড়ে গিয়ে খাবার জলের গ্লাসটা নিয়ে এল। বেলনে বেলা পরোটার ম্যাপের ওপর গ্লাস উবুড় করে কেটে বলল- এই দ্যাখ ছোড়দি লুচি। বিয়ের পরে লুচি করতে গেলে ঘাবড়াস না এইভাবে গ্লাস দিয়ে ম্যানেজ করবি।
মা নির্বিকার। কিচ্ছু শিখতে হবে না। এই তো পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তারপর আবার নাটকের রিহার্সাল শিখাব কখন! থাকগে পরে শিখবেখন। মার চিন্তা নেই। আত্মীয়ের চিন্তা। কিন্তু ওই যে ‘লক্ষ্মী’ বানানোর জন্য সমাজের প্যাঁচাদের চোখে ঘুম নেই।
পরবর্তীকালে কিভাবে আমি মাছ কেটে রান্না করতে পেরেছি, কিংব আরো অসংখ্য রান্নার সাফল্যের ঘটনা…এ দীর্ঘ গল্প। শ্বশুরবাড়িতে ঠিক সিনেম্যাটিক পদ্ধতি নয় কিন্তু সারাক্ষণ প্রমাণ দিতে হবে আমি লক্ষ্মী। থাক পরে বড় করে লিখব।
লক্ষ্মীদের খিদে পায় না, কষ্ট হয় না, শরীর খারাপ হয় না, স্বামী বললেই বিছানা পায়, স্বামী ডিনাই করলে একদম পায় না, তারা খরচ করে না, তারা প্রচুর রোজগার করে, তাদের টাকায় অধিকার বোধ নেই, তাদের জন্য আসলে কিস্যুই দরকার নেই।
ভেবে দেখলে ‘লক্ষ্মী’ দের কাছে সমাজের ডিম্যান্ডের শেষ নেই। লক্ষ্মীরা কম খাবে, বেশি নাদবে টাইপ হতে হবে।
অতএব এই লক্ষ্মীপুজোর প্রাক্কালে বলছি প্রিয় মেয়েরা তোমরা মানুষ হও। যে মানুষ নিজের সুখের জন্য অন্য কোন মানুষ বা প্রাণীকে কষ্ট দিতে চায় না। ব্যস এই আপ্তবাক্য ফলো করে দেখো সত্যি লক্ষ্মী হয়ে উঠবে। তবে হ্যাঁ। লক্ষ্মী হও কিন্তু গরু হও না। নিজের অপছন্দ বলতে শেখো নিজের দায়িত্ব পালন করে তবেই।