• Uncategorized
  • 0

মুড়িমুড়কি -তে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়

মুখবইনগরকাহিনী

ফেসবুকে অনেক মহিলা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান , আমিও তাঁদের প্রোফাইল একটু এদিক-ওদিক ঘেঁটে , তাঁদের মানচিত্র দেখে নিয়ে, আর একজন কবিতার পাঠক পাওয়া গেল ভেবে , মোটামুটি একসেপ্ট করে নি। কিছুদিন পরেই একটি পুরুষ রিকোয়েস্ট পাঠান , তাঁর থোবড়া দেখে মনে হয় – কোথায় যেন দেখেছি ! সেই পুঙ্গবের প্রোফাইলে গিয়ে দেখি তিনি ওই মহিলার বয়ফ্রেন্ড বা পতিদেব ; এবং দুজনের জলকেলির দৃশ্য আমি ওই মহিলার এলবামে দেখেছি তাই চেনা-চেনা। তাঁর আশংকাকে সম্মান জানিয়ে তাঁকেও বন্ধু-তালিকায় প্রবেশাধিকার দিই। তারপরে দুজনে কেউই আর কথা বলেননা, কে জানে কেন ! গোটা ব্যাপারটাই কেমন দুর্বোধ্য কবিতার মত হয়ে যায় ….
কফিশপে বসে থাকতে থাকতে এখন হঠাৎ কাউকে দেখে মনে হয় – আরে কোথায় যেন , কোথায় যেন একে দেখেছি, কোথায় , কবে , কেন….তারপরেই বুঝতে পারি , ওহো, এ আমার ফেসবুকীয় বন্ধু-অনুভূতি ! এ আমার ফ্রেন্ড-লিস্টে আছে, মাঝে মধ্যে একটা-দুটো টুকরো কথাও হয়েছে বোধহয় , এদিক-ওদিক লাইকগলিতে আনাগোনাও ঘটেছে হয়ত কখনো।  সে তাকায় , আমিও তাকাই , কোনাকুনি টেবিল থেকে শব্দ  আর উড়ে গিয়ে পড়েনা সেই টেবিলে ; রিয়েলিটি আর ভার্চুয়ালিটির নিঃশব্দ লড়াইয়ে হেরে গিয়ে শেষমেষ আলাপ-পরিচয় হেঁটে যায় মূক-করিডরে।  কথা হয় তারপর , ফেসবুকে –  “আপনিই আজ না…ওই কোনের টেবিলে ? কথা বললেননা কেন…” ইত্যাদি, ইত্যাদি, স্মাইলি, স্মাইলি, অনর্থক চ্যাট-জানলা কিছুক্ষণ। ভার্চুয়াল আর রিয়েলের মধ্যে এই যে দেওয়াল , তার গায়ে নিঃসঙ্গতার পোস্টার মেরে লুকিয়ে পড়ে শহর।
অনেকে আছে, ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করলে, বা কোনো পোস্ট লিখলে, সেখানে, লাইক, লাভ , অট্টহাস্য বা কমেন্ট করে ; ইনবক্সে অবলীলায় সেঁদিয়ে পরপর মিসাইলের মত মেসেজ পাঠায় , কিন্তু কোনো কবিতাসভা বা অন্য কোথাও দেখা হয়ে গেলে, সামনে আর কিছু বলেনা , সামনা -সামনি তারা নিশ্চুপ নীল তারা , হিমালয়ের গুহায় বসে থাকা রহস্যময় মৌনী- বাবা কিংবা মুচকি হাসির আনসলভড মোনালিসা। তারপর আবার ফেসবুকে, কথা, টুকি, উঁকি। এটা কেন? ভার্চুয়ালিটি আর রিয়েলিটির মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব , নাকি অন্য কোনো মায়াবী রডোডেনড্রন? কিংবা , একটু সেমি -একাডেমিক – “সোশ্যাল মিডিয়া কি আদতে আমাদের লেস কনফিডেন্ট করে দিচ্ছে ?” ; এই আড়ালে কথকতা আর সামনে নো-কথা আমার ইয়ে একটু জ্বালিয়ে দেয়, বলতে দ্বিধা নেই। যদি কেউ প্রশ্ন করে – তুমিই নিজে থেকে কথা বলোনা কেন, তাহলে বলবো, চিনতি পারলে, বলি, কত্তা, বলি। তবে চোখে চোখ পড়লে কেউ যদি লজ্জাবতী লতার মত ওদিকপানে তাকায় , তাহলে আর কই না , যদিও জানি এই লতাই একটু পরে ইনবক্সে -“কী খবর ?” লিখে চারটে স্মাইলি দেবে। বয়স হচ্ছে, আর এসব আজব নিমকি ছেনালি পোষায়না ….
ফেসবুকে কেউ আপনার পোস্ট, বা ছবিতে “লাইক” দিল মানে সে আপনাকে লাইক করে তা নয়, সে আপনার পোস্ট, বক্তব্য, কবিতা, বা ছবিটিকে ‘লাইক’ করলো মাত্র ; কেউ আপনার পোস্টে “লাভ” দিল বা ওই লাল হৃদয় মেরে দিল মানেও কিন্তু সে আপনাকে হৃদয় দিয়ে দিল বা অন্য কিছু দিল, তা নয় ভাইসকল, তার মানে শুধু সে আপনার পোস্ট-টিকে ‘লাভ’ করলো, আর কিছু নয়; ছবি মানে আপনি নন, আপনি মানে ছবি নন, ছবি মানে ছবি, আপনি মানে আপনি, যদিও সেটা কে তা অনন্ত ছায়ালোকে লেখা থাকে , রিয়ালিটি মানে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি নয়, যদিও রিয়ালিটি মানেও প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার হাসি কিনা, তাও কেউ জানেনা ; সুতরাং এই ধুলোবালিছাই অস্তিত্ব বা না-অস্তিত্ব নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে টুক করে ওই প্রজাপতির সিকিম-ভ্রমণের ছবির  নীচে কিংবা বন-বাংলোর বারান্দায় মেলে দেওয়া চুলে দিয়ে দিন একটি খাপখোলা ‘লাইক’ বা ‘লাভ’ !
কিছু কিছু লোক আছে, ফেসবুকে ফ্রেন্ড লিস্টে নেই, অথবা আছে কিন্তু কোনোদিন কথা হয়নি, হয়না ; কোনোদিন কোনো পোস্টে, কবিতায় বা ছবিতে কোনো কমেন্ট করেনি, লাইক দেয়নি, হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাও দেয়নি , অট্টহাস্য ছুঁড়ে দেয়নি , দুঃখ দেখায়নি বা ক্রোধে ফেটে পড়েনি ; কিছুই যে করেনি বা বলেনি , তাতে আফসোস নেই , মেঘের আড়ালে মেঘনাদ হলেই যে সে মগনলাল মেঘরাজ – এই সরলীকরণেও আমি বিশ্বাস করিনা , কিন্তু এদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও আছে, যারা আমার কোনো পোস্টে অন্য কেউ কোনো বিরূপ মন্তব্য বা খিস্তিরঙের কমেন্ট করলে , সেই কমেন্টে ছোট্ট করে লাইক বা লাভ গুঁজে আবার কুম্ভের মেলার ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে। সবুজ চোখওয়ালা এইসব আজব সিক্রেট-এজেন্টদের চিহ্নিত করেছি , তাদের এই মধুর ভালোবাসার কারণ জানতে খুব ইচ্ছে হয় ….
এই যে ‘লাইক’ , ‘লাভ’, প্রতি-লাইক , প্রতি-লাভ ; আর মাঝখানে ভেসে থাকা বেমিসাল নীরবতা, এ আসলে শীতের গোধূলিরং ট্রামলাইনের মত এক টাইমলাইন যেখানে কথা নেই , অপেক্ষা আছে , শব্দ নেই, ইশারা আছে , প্রিয়াঙ্কা চোপড়া নেই, সুরাইয়া আছে , ইনবক্স আছে কিন্তু ইনবক্সে ইনপুট নেই। এই নিস্তব্ধ লাইক-লাভ আদান-প্রদানের মধ্যেই “হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ ” আছে, গহন – গভীর জুনিপার বন আছে , নয়ের দশকের শেষ ভাগের টিউশন-রোম্যান্স আর রঞ্জাবতীদের বারান্দা থেকে ছুঁড়ে দেওয়া চকিতে উধাও ফ্লাইং-কিস আছে। বাকি, সব গেছে , সোশ্যাল মিডিয়ার হাঙ্গর ঢুকে পড়েছে ডিমলিট বেড রুমেও , প্রতিটা চুমু ৩১-শে মার্চের মধ্যে লিংকড হয়ে গেছে আধার – আঁধারে ; শুধু রয়ে গেছে নীরব লাইক এক্সচেঞ্জ – ‘তোমাকে ভালো লাগে, তবু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি’-র অমোঘ যন্ত্রনা-ম্যাজিক। রোবটের দুনিয়ায় শেষ প্রতিবাদ, শেষ শব্দহীন মলোটভ ককটেল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।