• Uncategorized
  • 0

মুড়িমুড়কি -তে অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়

অনুবাদ সংস্কৃতি  

লুসি গ্রে-র তর্জমা করতে গিয়ে হথর্ন নিয়ে বেশ একটা সমস্যায় পড়া গেছিল। তাকে অবিকৃত রাখা হবে, না কি কোনো বাংলা নাম দেওয়া হবে? বিলেতে সেই সময় এই জাতীয় বুশ বা ঝোপ দিয়ে  জমির সীমানা নির্দেশ করা হত। হথর্নের ফল, পাতা এমনকি ফুল থেকে ভেষজ ওষুধ বানানো হত। বেশ কথা। এদিকে বাংলায় মান্ধাতার আমল থেকে প্রধানত যে গাছটি বেড়ার জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে, তার নাম রাংচিতা। কিন্তু তার কোনো ভেষজ গুণ আছে বলে জানিনে। উপরন্তু রাংচিতা পাতার কষ টক্সিক …কৃষ্ণকান্তের উইলে সেই সাক্ষীর “রাঙ্গচিত্রের আটা হইতে ঘা” করবার জালিয়াতির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার।
তাছাড়া আমাদের যেমন বেলগাছ বললেই ব্রহ্মদৈত্য এবং শ্যাওড়া গাছ বললেই পেত্নীর কথা মনে আসে, তেমনি হথর্নের সাথে পরী এবং জাদুবিদ্যার একটা সংযোগ আছে লোককথায়। লুসির রহস্যময় ভাবে নিখোঁজ হওয়ার করুণ ম্যাজিকের সাথে চমৎকার খাপ খেয়ে যায় হথর্ন, লুসিকে প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে দিতে সাহায্য করে কবিতায় হথর্নের উপস্থিতি। অথচ বন্য রাঙ্গচিত্রের এবম্বিধ কোনো ভৌতিক কৌলীন্যও নেই। কাজেই হথর্নকে বাংলার তীরে এনে ফেলা গেল না কোনো মতেই। সে তার স্বকীয়তাবশতঃ নিজের চারদিকে অনতিক্রম্যতার একটা বেড়া রচনা করে থেকে গেল।
বাকি থাকে আরেকটা সম্ভাবনা। আক্ষরিক অনুবাদ। অতীতে এধরনের চেষ্টা যে হয় নি, তা নয়- ধরুন হাইড্রোজেনের বদলে উদজান, অক্সিজেনের বদলে অম্লজান। কিন্তু কারো পিতৃদত্ত নাম মাখন লাল সরকার হলে, তর্জমার আতিশয্যের চোটে তাকে ইংরাজিতে বাটার রেড গভার্ণমেন্ট বলে বসার যে গল্প আমরা সেই ছেলেবেলায় শুনেছি, ব্যপারটা খানিকটা সেইরকম দাঁড়াবে মনে হল।
(তবে আমরা এরকম বিদঘুটে পরিভাষার অনুবাদ যে ক্ষেত্রবিশেষে সহ্য করি না তা নয় । যেমন আপিসে প্রথমবার হিন্দি সাইনবোর্ডে “প্রণোদ প্রত্যাবর্তক বিভাগ” দেখে ঢোঁক গিলে সহকর্মী দুবেজীকে জিজ্ঞেস করলাম, ইসকা মতলব তো জরা বতাইয়ে দুবেজী। দুবেজী এদিক ওদিক দেখে আমার কানে কানে বললেন, মেরী হিন্দি ইতনি আচ্ছি নহি হ্যায়। এডমিনকা ডি কোস্টাসে পুছকে দেখিয়ে। বোর্ড উসনে হি লগবায়া। বোঝো! থ্রাস্ট শুধু রিভার্স করলেন না, বড়ি কুশলতা কে সাথ ডাইভার্ট ভি কর দিয়া।)
এইখানে আরেকটু শিবের গীত সেরে নি। এতক্ষন হথর্ণ নিয়ে ফালতু হ্যাজ যা হচ্ছে, ওয়ার্ডসওয়ার্থের জন্য তা একদম, যাকে বলে “জায়েজ”। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের মধ্যে অন্যতম, যিনি তরুণবয়সে দিস্তা দিস্তা অনুবাদ করেছেন ভার্জিল, হোরাসের মত প্রাচীন রোমান কবিদের, এমনকি মাঝবয়সে এসেও তাঁর অনুবাদে রুচি এতটুকু কম হয় নি, ততদিনে তাঁর করা অনুবাদের তালিকায় যুক্ত হয়েছে পেত্রার্ক, কিয়াব্রেরা, মাইকেল এঞ্জেলোর মত ইতালীয় কবিদের নাম।
সবচেয়ে বড় কথা অনুবাদের আদর্শ কি হওয়া উচিত তাই নিয়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থ যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছেন। পূর্বসূরী ভার্জিল অনুবাদক ও কবি ড্রাইডেনকে বেশ একহাত নিয়েছেন। মেটাফ্রেজ, প্যারাফ্রেজ জাতীয় প্রতিশব্দের কচকচি বাদ দিয়ে বলা যায়, ড্রাইডেনের যেমন কবিতার অনুবাদ কতটা আক্ষরিক এবং কয় শতাংশ ভাবানুবাদ হওয়া উচিত ইত্যাদি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে গেছেন তার বিপরীতে শতখানেক বছর পরে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ভাবানুবাদের নামে ড্রাইজেনের প্রভূত পরিমানে ইধার উধার কি বাতেঁ কবিতায় ঢুকিয়ে দেয়ার বিরোধিতা করেছেন। এসবই শোনা কথা বলছি। আমি কিন্তু এতশত জানিনা। যা বললাম সব পূর্বোক্ত মাতুলালয়ে আলোচিত সাহিত্য-ট্রিভিয়া কর্ণগোচর হওয়ার সুবাদে।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি শিবের গীত মনে আসছে। উনবিংশ শতকের একদম প্রথম দিকে, ১৮০৯  খ্রীষ্টাব্দে উইলিয়াম কেরী সাহেবের বাংলা বাইবেল প্রকাশিত হয় শ্রীরামপুর প্রেস থেকে। প্রথম বাংলা বাইবেল। তারপর বিভিন্ন সময়ে উইলিয়াম ইয়েটস,  জন ওয়েঙ্গার এবং শেষ পর্যন্ত্য ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে জি এইচ রাউসের হাত দিয়ে যে তর্জমা বের হয় সেটি সম্ভবত এক দশক আগে পর্যন্ত্য প্রটেস্টান্ট চার্চের স্বীকৃত বাংলা বাইবেল বলে পরিগণিত হত।
যাই হোক সেই প্রথম সংস্করণে কেরী সায়েব কিং জেমস ইংরাজী সংস্করণ অনুসরণ করলেও শব্দচয়নে বেশ খানিকটা দেশকাল নিয়ে ভাবনার ছাপ রেখেছেন। তিনি ইংরাজির লর্ড শব্দটি কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি অনুবাদ না করে, হিব্রুর YHWH (য়েহোভা)-র কাছাকাছি একটি শব্দ য়িহুহা ব্যবহার করেছেন। যেমন কিং জেমসের –The LORD reigneth , he is clothed with majesty, the LORD is clothed with strength…ইত্যাদি তাঁর হাতে হয়েছে, য়িহুহা কর্তৃত্ব করেন তিনি মহত্বে পরিহিত আছেন। য়িহুহা স্ববেষ্টিত পরাক্রমে পরিহিত হইয়াছেন পৃথিবীও যেন লাড়া যাইতে পারে না….ইত্যাদি।
গবেষিকা এলিসন মুখার্জীর মতে, Carey’s decision to transliterate was probably based on a reluctance to identify the God of Moses with any familiar Hindu god.
ইয়েটসের হাতে পড়ে য়িহুহা পরিবর্তিত হয় পরমেশ্বরে (১৮৩৮)। ওয়েঙ্গারের দ্বিতীয় সংস্করণে (১৮৭৪) তার চূড়ান্ত পরিণতি সদাপ্রভু শব্দটিতে। সদাশিব, সদাফল প্রভৃতি শব্দের অনুসরণে, এবং  তাতে লর্ড অর্থাৎ প্রভুর মর্যাদার আভাস আছে এমন একটি শব্দের উদ্ভাবনার জন্য নাকি জন ওয়েঙ্গার দস্তুরমত গর্বিত ছিলেন। হতেই পারেন , কারণ শব্দটি এখনো বাংলা বাইবেলে জনপ্রিয়।
সেইসব ট্রিভিয়া মনে রেখে, এই কন্টকসংকুল বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য তর্জমায় হথর্নই পুনর্বহাল রাখা। পাঠক মনে হয় মার্জনা করে দেবেন। নিতান্ত অসহ্য হলে আরেকটি অনুবাদের জন্ম হবে। তাতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ সাহেব নিতান্ত অখুশি হবেন, তা মনে হয় না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।