শ্রীরাধা আর ফতেমা দুই বান্ধবী। দু’জনের মধ্যে একেবারে গলায় গলায় ভাব। ওরা শহরের একটি নাম করা স্কুলে পড়ে।সবে ক্লাস থ্রিতে প্রমোশন পেয়েছে। ওদের এই বন্ধুত্বের বিষয়ে, বাড়ির লোকজন অবশ্য কেউ কিচ্ছু জানে না।কারণ ওদের দু’জনের মেলামেশা যা হয় সেটা শুধু স্কুলেই। দু’জনের বাড়িতো ঢের দূরত্বে। আসা-যাওয়াও হয় স্কুল বাসে। তাও আবার দুজনের বাস এক নয়।
তবে শ্রীরাধা আর ফতেমার বন্ধুত্বের কথা সারা স্কুল জেনে গেছে। ওরা দুজন রোজ দিন এক বেঞ্চে পাশাপাশি বসে।টিফিনের সময়, একসাথে বসে টিফিন খায়। তাও আবার বাড়ি থেকে আনা টিফিন দুজন নিজেদের মধ্যে ভাগা ভাগি করে খায়। স্যার-ম্যাডাম ওদের একজন কে কোন কারণে শাস্তি দিলে অপর জনের চোখেও জল টল্-টল করে।ওদের এসব কান্ড দেখে স্কুলের অনেকেই নানা ভাবে ব্যাঙ্গ করে। কেউ কেউ নাক-চোখ কুঁচকে বলে, “আহা, আমাদের দুই ন্যাকা পিসি!”
কিন্তু স্কুলের স্যার-ম্যাডামরা ওদের দু’জনকে খুব ভালোবাসে। প্রিন্সিপাল স্যারতো ওদের দু’জনকে একদিন না দেখে থাকতেই পারেন না। তাই নানা অছিলায়, প্রতিদিন অন্তত একবার ওদের দু’জনের ডাক পড়বেই তাঁর ঘরে।অন্য ছাত্রছাত্রীরা প্রিন্সিপাল স্যারের ডাক পেলে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। নাজানি কী বিপদে পড়তে হবে।অথচ শ্রীরাধা ফতেমা খবর পাওয়া মাত্র খুশিতে নাচতে নাচতে দে-ছুট্। তাই স্কুলে ওদের হিংসে করার লোকেরও অভাব নেই।
একদিন স্কুলে টিফিন বেলায়, দু’জনের দুই মধ্যে বন্ধুত্বটা তাহলে আরও আঁটো সাঁটো হবে। শীতটা একটু কমলে হবে বিয়ের অনুষ্ঠান। খুব ঘটা করে হবে পুতুলের বিয়েটা। স্কুলের প্রিন্সিপাল, স্যার-ম্যাডাম এবং ক্লাসের সব বন্ধুদেরও নেমন্তন্ন করা হবে।হবে প্যান্ডেল। আলো,ফুল দিয়ে খুব করে সাজানো হবে বিয়ের আসর। সানাই, বাজনাও আনা হবে। একবার শুধু দুই বন্ধু তাদের বাবা-মাকে রাজী করাতে পারলেই হল-ব্যাস, সব কিছু ঠিক ঠাক, সময়মতো হয়ে যাবে।
শ্রীরাধা পর দিন বাড়িতে মায়ের কাছে কথাটা পাড়ল। মা সব শুনে, হ্যাঁ না কিছুই বলল না। শুধু গম্ভীরভাবে বলল, “ফেব্রুয়ারি শেষে তোমার অ্যানুয়াল এগজাম। হাতে আর মাত্র আড়াইটা মাস। এখন একটু লেখাপড়ার দিকে মন দাও। মিডটার্মের চার-স্টাডিজে তুমি এইট্টি পারসেন্টও পাওনি। সেটা মনে আছে তো ? ইংলিশে নাইন্টির ঘরে থাকলেও বাংলায়, কম্পিউটারে এইট্টির উপরে উঠতে পারনি। বাঙালির মেয়ে, বাংলায় কেন ফুল মার্কস পাবে না ? ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা একটু চেষ্টা করলে তো এটা সবাই পাচ্ছে দেখছি! তুমি কেন পাবেনা শুনি ?”
ফতেমাও যথারীতি বাড়িতে আম্মুর কাছে কথাটা পাড়ল। আম্মু তাকে দুহাতে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরল। খুব আদরও করল।তারপর তার মুখের দিকে চেয়ে উদাস-চোখে বলল, “পুতুলের সাদি নিয়ে এতো চিন্তা করে কি হবে শুনি ?আর ক’বছর পর আব্বু জানতো মার ইসাদির তোড়জোড় শুরু করে দেবে। তখন যত খুশি আনন্দ করে নিও।পুতুলের সাদি নিয়ে অতো মাথা ব্যথা করে লাভ নেই ফতু। বরং মন দিয়ে লেখা পড়াটা করে যাও। ভালো রেজাল্ট না করলে, আব্বু জানতো মার সাদিটাই জলদি দিয়ে দেবে। তাই সেটা আটকাতে হলে, প্রতি বছর তোমাকে ভালো নাম্বার নিয়ে পাশ করতেই হবে। এখন সেই চেষ্টাটাই কর ।“
দুই বন্ধু স্কুলে গিয়ে দুজনের মায়ের কথা নিজেদের মধ্যে ভাগা ভাগি করল। দুজনেরই মনটা একটু খারাপ হল।কিন্তু দুজনেই ঠিক করল, সামনের এগজামে তারা রেজাল্ট খুব ভাল করবেই। আর সেটা করতে পারলে, তখন তাদের আব্দার বাড়িতে ঠিক টিকে যাবে। তখন আরকেউ এই নিয়ে আপত্তি করবে না। দুই বন্ধু জোর কদমে নেমে পড়ল ভাল রেজাল্ট করতে।শেষ মেশ তারা সেটা করেও ফেলল। শ্রীরাধা এবং ফতেমা এবার ক্লাস থ্রির ফাইনাল পরীক্ষায় জয়েন্ট-ফার্স্ট।
দুজনের বাড়িতে এখন উৎসবের মেজাজ। রোজ কত লোকজন ছুটে আসছে। দু’জনকে কাছে টেনে কতো ভাবে আদর করছে।অভিনন্দন, শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। এসেছেন স্কুলের স্যার-ম্যাডাম, প্রিন্সিপাল স্যারও। ওদের বাবা-মা, পরিবারের সকলেই তাই ভীষণ ভীষণ খুশি। শ্রীরাধা এবং ফতেমা, দু’জনের বাবা-মা’ই খুশিতে একেবারে টইটুম্বুর।তারা মুক্ত কন্ঠে ঘোষণা করেদিল, মেয়েকে খুশি করতে তারাও কোন ভাবেই কার্পণ্য করবে না। তারা জানিয়ে দিল, বাচ্চার যে কোনো আব্দার পূরণ করতে তারা এখন রাজী। ঠিক সেই সুযোগেই দুই বন্ধু জানিয়ে দিল তাদের একমাত্র আবদারটি- ‘ধুমধাম করে তাদের পুতুলের বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে শিগগির।
সবই ঠিক ছিল। সমস্যা হয়ে দাঁড়াল দুই পরিবারের ভিন্ন ধর্ম নিয়ে। শ্রীরাধারা হিন্দু।তাই ওদের পরিবারের সদস্যরা চাইছে, পুতুলের বিয়েটা হোক হিন্দু ধর্মমতে। আবার ফতেমার বাড়ির লোকজন বলছে, সেটা কি করে হয় !পুতুলের বিয়েটা হোক তাদের মুসলিম ধর্ম মতে। দুই পক্ষই অনড়। অর্থাৎ সামান্য পুতুলের বিয়ে নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যাবার উপক্রম।খবর পেয়ে, একদিন দুই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আলোচনায় বসলেন, স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যার। সঙ্গে রইল কয়েকজন স্যার-ম্যাডাম এবং দুই পাড়ার কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ। আলোচনা সভাটা ডাকা হল স্কুলে।
দুই পরিবারের অনেক কথা শোনা হল। শোনা হল প্রতিবেশী, বিশিষ্ট জনদের কথাও। সব শুনে প্রিন্সিপাল স্যার হাসতে হাসতে বললেন, ”আপনারা দুটি পরিবারই যথেষ্ট শিক্ষিত, অবস্থাপন্ন এবং সংস্কৃতি-সচেতন।সামান্য পুতুলের বিয়ে নিয়ে আপনাদের এই গোঁড়ামি আমার সঠিক মনে হচ্ছে না। তাছাড়া, আপনারা প্রতি বছর লক্ষাধিক টাকা খরচ করে, মেয়েদের শহরের সেরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াচ্ছেন। তাতে কী ওদের সত্যিই কিছু লাভ হচ্ছে? ভবিষ্যতে, আমাদের এই সমাজই বা ওদের কাছ থেকে কী পাবে?”
প্রিন্সিপাল স্যার একটু থামলেন। তারপর, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন লোককে ভেতরে ডাকলেন।তাদেরকে সকলের সামনে দাঁড় করিয়েও দিলেন। তারপর, তাদের দেখিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।
“শ্রীরাধা যার কাছ থেকে পুতুলটি কিনেছে, সেই লোকটি এদের একজন। সে ধর্মে মুসলমান।আর ফতেমা যার কাছ থেকে পুতুলটি কিনেছে, সেও এদের মধ্যে একজন। সে আবার ধর্মে হিন্দু। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ওই পুতুল দুটি যার কারখানায় তৈরি হয়েছে, সেই লোকটিও এদের মধ্যে রয়েছে। সে আবার ধর্মে খ্রিষ্টান।তাহলে এবার আপনারা বিচার করে বলুন, ওই পুতুলদের ধর্মটা আসলে কী?”
সবাই চুপটি করে বসে রয়েছে। কা’রও মুখে কোনও কথা নেই। হঠাৎ শ্রীরাধা-ফতেমা দু’জনে একসাথে লাফিয়ে উঠল।নাচতে নাচতে তারা দু’জন সমস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল, ”পেয়েছি, পেয়েছি গো, আমরা খুঁজে পেয়েছি। আমাদের পুতুলের জাত-ধর্ম হচ্ছে পুতুল। “এরপরই তারা আবার তাদের মায়ের কাছে গিয়ে, চুপটি করে বসে পড়ল।
এখনও কা’রও মুখে টু-শব্দটি নেই। প্রিন্সিপাল স্যার আবার সকলের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, “পৃথিবীতে মানুষ যখন প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল তখন সে কোনও জাত ধর্ম নিয়ে জন্মায়নি। এগুলো অনেক অনেক বছর পর আমারাই সৃষ্টি করেছি।অর্থাৎ, আমরা সবাই আসলে জাতিতে একটিই–মানুষ জাতি। আর আমাদের সকলের ধর্ম, সংস্কৃতিওএকটিই হওয়ার উচিৎ; সেটিহলো—মনুষ্যত্ব।আমরা সবাই যদি নিজেদের এমন করে ভাবতে পারি, তাহলে পৃথিবীতে কোন দিন জাত-ধর্ম নিয়ে কোথাও কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধবে না। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেকে নিশ্চিত রূপে একটি ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে যেতে পারব, চিরকালের জন্য। প্লিজ, আপনারা একটু ভাবুন। এই ছোট্ট-ছোট্ট শিশুদের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্তত–!”
প্রিন্সিপাল স্যারের কথা শেষ হওয়ার আগেই শ্রীরাধা এবং ফতেমার বাবা উঠে দাঁড়াল।দু’জনেই হাসি মুখে এগিয়ে গিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল। এখন তাদের দু’জনের চোখের পাতায় জল থৈ থৈ করছে। অন্যদের চোখও ছলছল্।কিন্তু কেউ আর কোনও কথা বলতে পারছে না। প্রিন্সিপাল স্যার, শ্রীরাধা ও ফতেমার বাবার কাঁধে তাঁর দু’হাত রেখে এক গাল হেসে বললেন,“তাহলে, এবার সমস্যাটা তো মিটেই গেল। আপনারা শীঘ্রই পুতুলে রবিয়ের আয়োজনটা সেরে ফেলুন।সেদিন আমরা সবাই গিয়ে, মিলে মিশে আনন্দ উপভোগ করে আসব! খেয়েও আসব খুব জমিয়ে।“
শ্রীরাধা ওফতেমার মায়ের মুখেও এখন লাফিয়ে লাফিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে মিষ্টি মিষ্টি হাসি।তারাও তাদের দুই মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে খুব আদর করল। তারপর, হাসি মুখে সবাইকে পুতুলে রবিয়ের নিমন্ত্রণ করে বাড়ি ফিরে গেল।