যীশু খ্রীস্টের পুনর্জন্মের পর শিষ্যরা নাকি তাঁকে কাশ্মীরে পাঠিয়ে দিয়েছিল , তীর্থঙ্কর সেই ভাবনা থেকেই আঁকার পরিকল্পনায় ছিল ৷ তাই অতুলকে , তার পছন্দ হয় ৷ কারণ অতুল ,দাঁড়ি আর লম্বা চুলে ঈশ্বরের মত প্রতিভাত হয় ৷ কোন এক বার থেকে অতুলকে তুলে নিয়ে এসেছিল তীর্থঙ্কর , তার ছবির মডেল হিসাবে ৷
অতুলের এই কন্দর্পকান্তি রূপ , নিষ্পাপ সৌন্দর্যেই দীঘি আকর্ষিত হয়েছিল ৷
দীঘি , তীর্থঙ্করের স্ত্রী ৷ দীঘি যখন তীর্থঙ্করকে বিয়ে করেছিল , তখন সে একজন অকর্মণ্য মানুষ ছিল সমাজের চোখে ৷ ছবি এঁকে ভ্যানগগ , পল ক্লি হওয়ার স্বপ্ন দেখে ৷ তখনও তার একমাএ ভালোবাসা ছিল ছবি আঁকা আর আজ যখন সে বিখ্যাত তখনও একমাএ ভাবনা এবং ভালোবাসা যা কিছু সবই ঐ একটাই জিনিস , আঁকা ৷ আজ তীর্থঙ্কর বিখ্যাত হওয়ার পর তাকে গ্রহণ করেছে সবাই । সেখানে দীঘির কোন জায়গা নেই ৷ আজ সে তীর্থর স্ত্রী হিসাবে নিজেকে ভাবতে ঘেন্না করে ৷ সারাক্ষণ একটা অস্হিরতা ৷ পাগল পাগল লাগে ৷
মাঝেমাঝেই বিগত দিনগুলোয় ফিরে যায় দীঘি ৷ তিল তিল করে বেঁচে থাকার লড়াই ৷ তাদের সেই দিনগুলো দীঘিকে তাড়া করে বেরায় ৷ সেই রাতটা আজও তার স্মৃতিতে তাজা ৷ দীঘিদের একেবারে তখন নিম্ন মধ্যবিত্ত অবস্হা ৷ পরের দিনর মুখের খাবাযরটুকুর জোগার নেই ৷ ওদের সন্তান দৃপ্ত তখন দুধের শিশু ৷ তীর্থ সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়ছিল এইভাবে বাঁচা যায় না ! সকলে মিলে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে ৷ তীর্থ সন্তানের দুধের বোতল বিষ মেশায় ৷ আর নিজেদের নিজেদের জন্যে চায়ের কাপে ৷ভেতরের ঘরে দীঘি মা লক্ষ্মীর ছবির পেছন থেকে মাটির ভাঁড়টা মাটিতে আছাড় মেরে ভাঙ্গে ৷ কিছু খুচরো টাকা পয়সা ছরিয়ে যায় মাটিতে ৷ তীর্থ চেঁচিয়ে বলে দীঘিকে ” আমি রেডি দীঘি ” তারপর উঠে বিছানায় দৃপ্তর পাশে বসে , ওর গালে বহু বর্ণে আঁকা একটা প্রজাপতি ৷ ওর পিঠে হাত বোলায় ফিস্ফিস্ করে বলে – ” আমাদের আয়ু এই পর্যন্তই ” বোতলটা ক্রমশ বাচ্চার ঠোটের কাছে নিয়ে যায় ৷ দীঘি ততক্ষণে খুচরো টাকা পয়সাগুলো আঁচলে তুলে নিয়ে ছুটে দরজার কাছে , জোরে চেঁচিয়ে ওঠে তীর্থর উদ্দ্যেশ্যে ” না…… ” তীর্থ দীঘিকে দেখে মৃদু হাসে বলে ” আমাদের কাপ দুটো নিয়ে এসে বসো ” ৷ দীঘি আঁচলে বাঁধা খুচরো পয়সার পুটুলিটা দেখিয়ে বলে ” তীর্থ অন্তত আর এইটুকু আয়ু তো আমাদের আছে ” ৷ পুটলিটা বাড়িয়ে ধরে তীর্থর দিকে , ” এইটুকু চেষ্টা এখনও বাকি আছে …….তীর্থ ……. ” ৷ তীর্থ সেদিন ধীরে ধীরে ঘার নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল ৷ এই স্মৃতিটা দীঘিকে তাড়া করে বেরায় ৷
তীর্থর সাথে এখন প্রায় আর দীঘির কথাই হয় না ৷ যেটুকু হয় তা উত্তপ্ত বাদানুবাদ ৷ তীর্থর মডেল অতুলের সাথে ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে দীঘি ৷ অতুলই যেন তার মুক্তির একমাএ উপায় ৷ মুক্তি আসে না ৷ বরং আরও গভীর অন্ধকারের দিকে চলে যায় দীঘি ৷ মনোরোগী হয়ে ওঠে ৷ এক পলকে সে বর্তমান থেকে অতীতে প্রবেশ করে আবার পরের মুহুর্তেই আবার ফিরে আসে বর্তমানে ৷ ঢুকে পড়ে অতীতে যেখানে তাদের ভাঙ্গাচোরা ঘরে , তীর্থ ক্যানভাস ফুরিয়ে গেছে বলে তার উন্মুক্ত শরীরে ছবি আঁকে …….
যেখানে তীর্থ দীঘির লম্বা বিনুনির ডগা সুদ্ধ চুলকে ব্রাশ হিসাবে ব্যাবহার করে দাড়ি কামাত….. । দীঘি ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে । একদিন তীর্থর সঙ্গে বাদানুবাদ করার সময় হঠাৎ গলায় দারুণ কষ্ট অনুভব করে ৷ ডাক্তার বলে কন্ঠনালী ভয়ংকর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৷ একদম কথা বন্ধ রাখতে হবে ৷ এই কথা বন্ধ রাখার সময় ডাক্তার বাড়িয়েই চলে ৷
দৃপ্ত যখন একটু একটু বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই সে বাবা মায়ের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক দেখেনি ৷ কিন্তু সংসারে যেহেতু তীর্থর প্রভাব বেশী সেইহেতু সে বাবার পক্ষই বেছে নিয়েছিল ৷
কিন্তু দীঘি একদিন দৃপ্তকে বলে ,সে যে বাবার পক্ষ নেয় ,সেই বাবাই একদিন তাকে দুধে বিষ মিশিয়ে মারতে চেয়েছিল ৷ এই সত্য জানতে পেরে , দৃপ্ত প্রচন্ড আঘাত পায় ৷ এই ঘটনা তাকে বাবার থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়ে দেয় ৷
সন্ধ্যেবেলা পড়তে না বসে দৃপ্ত পিয়ানোতে এসে বসে ৷ দীঘি ঘরে বসে পিয়ানোর শব্দ শুনতে পায় , খুব রেগে যায় এবং নীচে নেমে আসে ৷ একটা কাগজের ওপর ” এটা পড়ার সময় ” লিখে সেটা পিয়ানোর রিডের ওপর ফেলে দেয় ৷ দৃপ্ত , দীঘিকে উপেক্ষা করে বাজাতে থাকে ৷ ওর হাত কাগজের উপর পড়তেই থমকে যায় ৷ সামনে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছে ৷কাগজটা পড়ে ৷পিয়ানো ছেড়ে উঠে চলে যায় পড়ার ঘরে ৷ দৃপ্তের বাধ্যতা তাকে অবাক করে ৷ সে দৃপ্তর পড়ার ঘরে যায় ৷ পা টিপে টিপে ঢোকে ৷ ছেলের পেছনে এসে দাঁড়ায় ৷ আরেকটা কাগজ দৃপ্তর টেবিলে এসে পড়ে ……. তাতে লেখা ” বাঁদর ” …… দৃপ্ত দেখে , মুখ ঘোরায় ৷ দীঘি হেসে ফেলে , দৃপ্তও হেসে ফেলে ৷ বহুদিন বাদে দৃপ্ত হাসলো ……. দীঘির মুখটা উজ্জ্বল গয়ে ওঠে ৷
এরপর শুরু হয় অন্য এক অধ্যায় ৷ দীঘি এদিক ওদিক থেকে তার লেখা কিছু চিরকুট খুঁজে পায় ৷ হঠাৎ কি মনে হল , সে নিজেই নিজেকে একটা চিরকুট দিল – ” তুমি কি চাও ? “………… এইভাবেই সে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করে ………… ৷ নিজেকে নিয়ে একটা খেলা শুরু করে ………. অনেকরকম প্রশ্ন লেখা কার্ড তৈরী হয় ………… কিছু সাদা কার্ডও রাখে দীঘি ৷ যাতে নতুন করে কিছু প্রশ্ন লেখাও যাবে ৷
দেখতে দেখতে রীতিমত একটা খেলা তৈরী হয়ে গেল ৷ খেলার নিয়ম হল , ছক্কা গড়িয়ে খেলা শুরু হবে ৷ ছক্কা পড়লে কার্ড টানতে পারবে ৷ একসঙ্গে দুটো ছক্কা পড়লে সাদা কার্ড টানতে পারবে৷ যেহেতু দুটো ছক্কা দিয়ে খেলা হবে , নিয়ম তৈরী হল একটা ছক্কার পয়েন্ট থেকে আর একটা ছক্কার পয়েন্ট বাদ দিলে যত পয়েন্ট হয় , একবারে ততগুলো কার্ড টানতে পারবে ৷ যদি কেউ কথা বলে ফেলে তাহলে অন্যজন একটা কার্ড পাবে ফাইন হিসেবে ৷
দীঘি এবং দৃপ্ত এখন খেলাটা খেলে ৷ অবসর সময়ে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা এই খেলায় মেতে থাকে ৷ প্রথম যেদিন দৃপ্ত সাদা কার্ড পায় সে প্রশ্ন করে- ” বাবা কি সত্যিই আমাকে খুন করতে চেয়েছিল ? ” দীঘি উত্তর দেয়- ” না “..
যে তীর্থকে খুনী বলে প্রতিপন্ন করেছিল ছেলের কাছে , সেই তীর্থকে আবার ” মানুষ ” করে তুলতে লাগল ছেলের সামনে , তাদের খেলার মধ্যে দিয়ে ৷
তীর্থ দেখে মা ও ছেলে খেলছে ৷ দেখে , কিন্তু কিছু কথা বলে না ৷ নিভৃতে নিজের কাজ করে যায় ৷
দৃপ্তর জন্মদিন ৷ বড় পার্টির আয়োজন হয়েছে ৷ ঘটনাক্রমে তীর্থর ফিরতে একটু দেরী হয়ে যায় । গাড়ী এসে থামে ৷ বাড়ির চারিদিকে এক চূড়ান্ত নিস্তব্ধতা ৷ একটা ভয়ঙ্কর অমঙ্গলের আশঙ্কায় সে দৌড়ায় ……. পৌছায় হল- এ …….
সব ঠিক আছে ৷ আমন্ত্রিত সকলে সেই খেলাটা খেলছে যেটা দীঘি আর দৃপ্তকে সে খেলতে দেখে……
তীর্থ জিজ্ঞাসা করে – ” What are you doing all ?”
হলের এক প্রান্তে একটা চিরকুট দুলে ওঠে . We are playing …..
তীর্থ জিজ্ঞাসা করে – কি খেলা এটা ? নাম কি এটার ?
দীঘির চিরকুট – ” I am inside you “
তীর্থ আবার জিজ্ঞেস করে – ” কতক্ষণ চলবে ? “
আর এক জায়গায় চিরকুট ওঠে – ” যতক্ষণ না আমরা সবাই একে অন্যকে জানছি ,চিনছি ….. “
এরপর থেকে তীর্থ- ও মাঝে মাঝে খেলতে বসে দীঘি আর দৃপ্তের সাথে ৷ দৃপ্ত উঠে যায় কখনও কখনও খেলতে খেলতে ৷ তীর্থ আর দীঘি খেলে ৷ কখনও তীর্থের ফোন আসে ৷ তীর্থ ফোনে কথা বলে আর দীঘি একটা একটা করে কার্ড টানতে থাকে তীর্থের ফাইন হিসেবে ৷ যখন আর শুধু একটা মাত্র সাদা কার্ড আছে , তীর্থের নজর পড়ে … তীর্থ আর কথা বলে না ৷ ফোন রেখে গিয়ে খেলতে বসে ৷ তীর্থ দান চালে – দু ছক্কা …..
ডুয়ার্সের জঙ্গলে বেড়াতে যায় ওরা , এই প্রথম দুজনে একসঙ্গে ৷ প্রথম জীবনে দারিদ্র , তারপর দূরত্ব – দুজনের বেড়াতে যাওয়া ওঠেনি আগে ৷
সবুজের কোলে , পাহারের সান্নিধ্যে , একটা বাংলোয় এসে উঠেছে ওরা ৷ দৃপ্ত মনের আনন্দে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে ৷ তীর্থ তার গালে এঁকে দিয়েছে একটা প্রজাপতি ৷ তীর্থ পিঠে ইজেল নিয়ে বেরোয় ,সঙ্গে দীঘি- ও ৷ ওরা হাঁটতে থাকে পাহাড়ের দিকে ……. একটা দমকা হাওয়ায় দীঘির সবুজ শাড়ির আচল ওড়ে ৷ সবুজ নিসর্গের মধ্যে এমনভাবে মিশে যায় যেন , দীঘির আঁচলই চরাচর ……. আর তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে তীর্থঙ্কর ……..
এই আঁচলের বাইরে যাবে তীর্থঙ্কর , তার সাধ্য কি……. !