সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শাশ্বতী নন্দী (পর্ব – ৬)

নিশিভোর

পর্ব – ৬

(৯)
ডিজি সাহেবকে রাজি করানোটা সহজ হল না। ঝিলমিলপুর অপারেশনের নামেই ভীষণ ভাবে রিঅ্যাক্ট করে উঠলেন তিনি। রাগত সুর গলায়, ‘হাউ ইনসেন্সেবল ইউ আর গৌরী! অপারেশন উইদাউট আ টিম লিডার? এটা কি একটা মক অপারেশন? যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা! আমার তো নামটা ডুবিয়েই ছাড়বে, যা মনে হচ্ছে’।
হাতের চেটোর উল্টো পিঠ দিয়ে গৌরী ঠোঁটের ওপর ঘাম মোছে, ‘স্যার, আমার কাছে পাক্কা খবর, বাবাজী ওই দিন ঝিলমিলপুর আসছেই। ভক্তরা সমস্ত আয়োজন সেরে ফেলেছে। সুতরাং একটা অপারেশন জরুরি। এত খেটে আমি ব্লু প্রিন্ট তৈরি করলাম …
-বাট হু উইল লিড দা অপারেশন? দ্যাট হরি ঘোষ! সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারে না যে লোকটা। -ডিজি সাহেবের গলায় সংশয়, ‘নো, নো, দিস উইল নট বি দা রাইট স্টেপ’। -বলেই ফোনটা ছেড়ে দিলেন।
মনটা তিতকুটে তখন থেকেই। একটা সুন্দর পরিকল্পনাকে শেষ মুহূর্তে কীভাবে বুল ডোজার চালিয়ে চুর চুর করে ভেঙে দেওয়া হল! আক্ষেপটা রয়ে যাবে চিরকাল। একটা সৎ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এই ভন্ড বাবাজীদের নির্মুল করতে, কাজটা করতে দেওয়া হল না তাকে। হাহ্‌!
তবে সুমনাকে ওই লম্পট বাবাজীর নজর থেকে বাঁচিয়ে আনতেই হবে।
সারাদিনে আজ একবারও অনুভবের ফোন আসে নি। এরকম হয় না সচরাচর। হয়তো কাজের চাপ, ওদিকে আবহাওয়াও খারাপ চলছে। সকালের দিকে একটা এস এম এস এসেছিল শুধু, ‘নেট ওয়ার্কের অবস্থা খারাপ। যোগাযোগ করতে না পারলে দুশ্চিন্তা কোর না’।
গৌরীর কাজে আজ মন নেই। ঠিক করল অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বে। যাওয়ার পথে আশা ঊষার কাছে যাবে কি একবার? কবে ভাড়া বাড়িতে উঠে চলে যায়।
যাক, একটা সুস্থ জীবন পাবে তাহলে। দুটি মেয়ের পড়াশোনার ভার সে নেবে, মনে মনে ঠিকই করে ফেলেছে গৌরী।
ফোন করে ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি করতে বলল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়াটাও ঠিক দেখায় না। গৌরী নিজের পেন্ডিং ফাইলের স্তূপগুলিতে একবার চোখ বোলায়। এসব জলভাত কেস তার ওপর ফেলে দেওয়া হয়েছে শুধু আটকে রাখার জন্য। সব চাল অরিন্দম পালের।
মনটা অস্থির, পাগল পাগল লাগছে। এ সময় যদি কোনও কাছের, ভীষণ আপন কেউ থাকত। সুমনাটাও দিন দিন কেমন হয়ে উঠছে!
আপন খেয়ালে ওর নম্বরটা কখন যেন টিপে ফেলেছিল। । একবারের রিঙেই ফোন তুলল সুমনা। -লং লিভ গৌরী।  তোমাকেই ভাবছিলাম। কী সুন্দর একটা জায়গায় এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি জানো? নেট নেই, নইলে ভিডিয়ো করে দেখাতাম।
-কোথায় আছো? –গৌরী কানে ফোন নিয়ে জানলায় এসে দাঁড়ায়।
-একদম খাদের কিনারে। অনেক নীচ দিয়ে একটা রূপালি ফিতের মতো নদী বয়ে যাচ্ছে। সো বিউটিফুল! জানো, ভিকি আর আমার মধ্যে কী নিয়ে সব সময় ঝগড়া হত? আমি ভালবাসতাম পাহাড়, ও নদী আর সমুদ্র।
-ঠিক আছে বুঝলাম। এবার তুমি লক্ষ্মী মেয়ের মতো  গাড়িতে উঠে বোস তো। অমন জায়গায় একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে নেই।
সুমনা যেন আকাশ থেকে পড়ল,-গাড়ি! গাড়ি পাব কোথায়? ড্রাইভারকে কখন ছেড়ে দিয়েছি। একা পায়ে হেঁটে  পাহাড় ঘুরছি। জানো ভিকি খুব জেলাস ছিল। পাহাড় ভালবাসতাম বলে ও আমায় পাহাড়ে নিয়ে আসত না। বলত, পাহাড়ে গেলে তুমি আমায় ভুলে শুধু পাহাড় দেখবে। হা হা হা । কী ছেলেমানুষি বল তো।
আজকাল যেন বড্ড বাড়াবাড়ি করছে সুমনা। রাতদিন শুধু ভিকি আর ভিকি। এত কাঙাল ওই ছেলেটার জন্য? বিরক্তিটা বোধহয় মুখ দিয়ে বেরিয়েও গিয়েছিল।
-তোমাকে আমি খাদের পাশ থেকে সরে দাঁড়াতে বলেছি। কেন শুনছ না কথা? ভিকি ছাড়া কি তোমার জীবনে আর কিছু নেই?
কথাগুলো কর্কশ নিঃসন্দেহে। বলার পর নিজেই গৌরী  লজ্জিত। পরক্ষণেই সুর নরম করে -কাম অন সুমনা, এভাবে অতীতে আটকে থেকো না।
সুমনা হো হো করে হেসে উঠল, ‘অতীত! ভিকি আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। আরও কয়েক জন্ম পরেও আমি একই ভাবে সুমনা হয়ে ফিরে আসব শুধু ভিকিকে পাওয়ার জন্য।
এরপরই ওদিকটা নীরব। শুধু বৃষ্টি ঝরার শব্দ। গৌরীর দুশ্চিন্তা বাড়ল। পাহাড়ে যখন তখন বৃষ্টি নামে। এবার কী হবে মেয়েটার? সামনে তো লোকালয়ও নেই। আশ্রয় পাবে কোথায়? গাছ গরানে ঘেরা পাহাড়। যদি কোনও জন্তু জানোয়ারের আক্রমণ হয়?
না, গৌরীর মাথা আর এত চিন্তা ধারণ করতে পারছে না। সে চেয়ারে ফিরে আসে। কমপিউটর অন করে। কী করবে, কী করবে না বুঝতে পারছে না। সুমনার নম্বরে আবার ফোন করল। নট রিচেবল। অসহ্য!
টেবিলে শুয়ে থাকা ফাইলগুলোর দিকে তাকাল একবার।  ওগুলো ক্লিয়ার করতে কয়েকটা ঘন্টাই তার জন্য যথেষ্ট। এগুলোর জন্যই তাকে ফিল্ডে যেতে দেওয়া হল না। আবার সেই রাগ ভেতরে ভেতরে ফিরে আসছে। না, মনটাকে ঘোরাতে হবে অন্যদিকে।
হঠাৎ সে দশ বছরের পুরনো ফাইলের ইনডেক্স সার্চ করতে বসল। কাল সুমনা এ ব্যাপারে কী একটা বলছিল না … কিন্তু ওখানেও যে ঢোকা যাচ্ছে না। পাসওয়ার্ড দিয়ে ডিজিটাল লকিং করা আছে পুরনো কেসের ফোল্ডারটা। গৌরীর ভ্রুতে ভাঁজ। আচ্ছা, কমপিউটরের পাশাপাশি ম্যানুয়াল রেজিস্টারও তো মেনটেন করা হয়। সেটা চেষ্টা করলে পাওয়া যাবে?
বেল বাজিয়ে অর্ডারলিকে কথাটা বলতেই ঘোর অনিচ্ছা দেখাল চোখে মুখে। ধুলোর পাহাড় ঘাঁটতে নারাজ। তাছাড়া গোডাউনের চাবি, তালা ইত্যাদি কোথায় থাকে, তাও নাকি তার অজানা।
ওকে একটু নিরীক্ষণ করে গৌরী। অনিচ্ছার মধ্যে আরও কিছু যেন লুকিয়ে আছে। ওকে বিদায় দিয়ে অগতির গতি রোহিতকেই ডাকতে হল।
মিনিট পনেরোর মধ্যে সর্বাঙ্গে কালি ঝুলি মেখে রোহিত ফিরল মোটাসোটা একখানা রেজিস্টার নিয়ে।
গলায় ক্ষোভ, ‘যা তা অবস্থা ম্যাডাম ওখানটা। সাপ ব্যাঙও থাকতে পারে। অথচ ভাইটাল সব নথি পত্তরে ভেতরটা ঠাসা’।
গৌরী লজ্জিত, -ছি, ছি, এ কাজটা তোমায় দিয়ে করালাম।
রোহিত হাসে, ‘ভাগ্যিস, করালেন। নইলে পেতেন না। ওখানে গুপ্তধন বুঝি রাখা থাকে, তাই চাবি অরিন্দম স্যারের ট্যাঁকে গোঁজা। আমাদের কাছে একটা ডুপ্লিকেট চাবি ছিল, তাই রক্ষে। এই রেজিস্টারটাকেও আড়ালে আবডালে রাখা হয়েছিল। যাক ম্যাডাম, আরও কিছু প্রয়োজনে, উইদাউট হেসিটেশন, ডাকবেন।
গৌরী হেসে ওকে হাত দিয়ে থামায়, ‘আজ জুঁইয়ের সঙ্গে কোনও অ্যাপো ট্যাপো নেই তো? নইলে চেহারা আর বেশ ভূষোর যা অবস্থা!
রোহিত হেসে মাথা নাড়ে, নেই।
মোটা সোটা রেজিস্টারে দশ বছরের জায়গায় মাত্র বছর সাতেকের রেকর্ড আছে । পৃষ্ঠাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, পেনের লেখাও ধ্যাবড়ানো। তবে বেশি দূর যেতে হল না, কয়েক পাতা ওল্টাতেই একটা পৃষ্ঠার ওপরে নজর গেল। বড় বড় করে লেখা, জ্যোতিপ্রিয় সিনহা। বাহ্‌, সালটাও মিলে যাচ্ছে। এই তো সাত বছর আগে।
কিন্তু কেস নম্বর থেকে ফাইল নম্বর টুকেই মনে মনে  হোঁচট খায়। নম্বর পেলেই তো হল না, আস্ত ফাইলটা পাওয়া যাবে কীভাবে? আদৌ আছে কি? রোহিতও চিন্তিত। তবু বলে, ‘দেখছি চেষ্টা করে’।
চ্যাম্পিয়ন ছেলে! বিজয়ীর মতো এক মুখ খুশি নিয়ে একটু পরেই হাজির, ‘খুব ভাইটাল ফাইল মনে হচ্ছে। লাল ফিতে দিয়ে আলাদা করে সেন্ট্রাল স্টোরে রাখা ছিল’।
ভাইটাল তো বটেই। গৌরী মনে মনে হাসে।  রোহিত চলে যেতেই, সে ফাইলের মধ্যে বুঁদ হয়ে যায়। কেস হিস্ট্রিটা পড়তেই গায়ের লোম যেন দাঁড়িয়ে পড়তে চাইছে। কোনও এক সময়,জ্যোতিপ্রিয় সিনহার নাকি দুটি স্কুল ছিল অনাথ মেয়েদের জন্য। থাকা খাওয়া, পড়াশোনা এবং স্বনির্ভরতার শিক্ষা দেওয়া হত সেখানে।
হুম, আই ওয়াশ! গৌরী পড়তে পড়তে বিড়বিড় করে।
-তা সেই স্কুল শিক্ষার শেষে মেয়েদের পাঠানো হত আরও উচ্চতর ট্রেনিং করাতে। দেখা গিয়েছে, সেই প্রশিক্ষণের নামে বেরিয়ে মেয়েরা আর কখনই ফিরে আসে নি নিজের ঘরে। তারা পাচার হয়ে গেছে ভিন দেশে।
গৌরী ফাইল থেকে মুখ তোলে। ছিঃ! ভেতরটা লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। এমন এক লোকের সন্তান তার স্বামী!
জ্যোতিপ্রিয়র ইতিহাস আরও যত ঘাঁটছে, একটা পচা দুর্গন্ধ যেন তাকে অস্থির করে তুলতে লাগল। এতদিন এত কিছু তার অজানা ছিল কীভাবে? হিসেব করে দেখে, সে সময় ও পুরুলিয়ায় পোস্টেড। তাছাড়াও তাকে বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টে বিভিন্ন জেলায় জেলায় ঘুরতে হত। তাই এত সব কলঙ্ক কথা কানে আসে নি। তবে মূল ঘটনাটা খাপছাড়া ভাবে শুনেছিল। প্রবৃত্তি হয় নি, অনুভবের কাছে আদ্যোপ্রান্ত শুনতে। জ্যোতিপ্রিয় সিনহা নামটাই তার কাছে এক বুক ঘৃণার।
মোবাইল বাজছে। শব্দটায় কেঁপে উঠল গৌরী।  অন্ধকার গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেন অন্ধকারেই মিশেছিল এতক্ষণ। বিরক্ত লাগল। কার ফোন এখন? কিন্তু স্ক্রিনে উঁকি দিতেই শিরদাঁড়া টানটান হয়, ‘ইয়েস স্যার’।
ওপাশে ডিজি। -‘তোমার কথায় একটা সেকেন্ড থট দিলাম, বুঝলে গৌরী। ঠিকই বলেছ, একটা চান্স থাকলেও থাকতে পারে বাবাজীর ওই ডেরায় ফেরার। সো, আই টকড্‌ টু কমানডেন্ট অফ ইন্ডিয়ান রিসার্ভ ব্যাটেলিয়ন। ওরা রাজি। অ্যাসিসটেন্ট কমানডেন্টের নেতৃত্বে একটা রেইড অপারেশন চালানো হবে সেদিন। এ ছাড়াও আর একটা উদ্দেশ্যও আছে, যদি বাবাজী লোকটাকে নাও পাওয়া যায়, তার কয়েক পিস অনুচরকেই না হয় তুলে আনা যাবে। ওদের থেকেই যদি কোনও কথা বার করা যায়।
গৌরী যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অপারেশন হবে তাহলে! সত্যিই! তার চোখে যখন তখন বাষ্প জমে না, কিন্তু এখন চোখের কোণ দুটো চিক চিক করছে জলে। গৌরী তাহলে হেরে গেল না!
-সো, তোমার টিম রেডি কর। অপারেশন উইল স্টার্ট অ্যাজ পার দা শিডিউল।
তার মানে তো হাতে মাত্র দুদিন। কালই কলকাতার টিমকে রওনা হতে হবে। তড়িঘড়ি আবার রোহিতকে খোঁজ করা হল। অফিস তখন খাঁ খাঁ, রাত বেড়েছে। তবু ওই ছেলেটা বসে থাকে যতক্ষণ তার ম্যাডাম থাকে। এত অনুগত!
হরি ঘোষ আজ তাড়াতাড়িই কেটেছে, দুপুর থেকে নাকি লুজ মোশন ছুটেছে।
সব শুনে রোহিত উচ্ছ্বসিত। -জানতাম ম্যাডাম, খেলা ঘুরবেই।
গৌরী হাসছে, -ম্যাচ কিন্তু বার করে আনতে হবে। তুমিই আমার ভরসা। মাথা ঠান্ডা করে ইনিংসটা খেলো। ক্যাপ্টেন তো বসিয়ে দেবে মনে হচ্ছে। এত পেট রোগা মানুষ!
-ভাববেন না ম্যাডাম। আবর্জনা ক্লিয়ারেন্স চলছে। ওখানে পৌঁছেই দেখবেন হরিবাবু ফিট। লোকটার দম আছে। তবে আপনাকে মিস করব।
আলোচনা শেষে এক সঙ্গেই দুজনেই বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে। রোহিতকে লিফট দিল গৌরী, অনেকটা রাত হয়েছে। মনটা এখন তার নির্ভার, পাখির পালকের মতো ভাসতে চাইছে।
হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই গাড়ি থামিয়ে সে একটা বড় ষ্টেশনারী শপে ঢোকে। বড় বড় কয়েক প্যাকেট বিস্কুট, লজেন্স,  কেক কিনে রওনা দিল আশা ঊষাদের কাছে। পুঁচকে দুটো আজ বড্ড টানছে।
রাত তখন নটা। দুই মেয়েই হয়তো গভীর ঘুমে জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। ওখানে পৌঁছে দেখে লক্ষ্মী আর বিকাশ, একটা খাটিয়া পেতে ফুটপাথের ওপর, সুখী দম্পতির মতো গল্প করছে। ওর গাড়ি দেখে ছুটে এল। গৌরী হাতের প্যাকেটগুলো লক্ষ্মীর কাছে দিতে চাইল, কিন্তু ও নাছোড়। জোর করে ছাউনি ঘরে নিয়ে ঢোকাল।
অগত্যা … পা টিপে টিপে ঊষা আর আশার মাথার কাছে প্যাকেটগুলো রেখে বেরিয়ে আসতে যায়। পেছন থেকে তখনই এক কচি গলা, সেই মিষ্টি চিনির মতো গলাটা, ‘আন্টি। আমার জন্য বেশি তো? দিদির চেয়েও বেশি?’
বাড়িতে ফিরে অনেকক্ষণ আজ বটুকদার সঙ্গে গৌরী গল্প করল। বহুদিন পর একটা তিরতিরে উত্তেজনা বইছে শিরায় শিরায়।
খাওয়া সেরে ব্যালকনিতে যায়। ব্যালকনি বাগানে রঙ বেরঙের ফুল। ভুরভুরে গন্ধে তোলপাড়। অনুভবের প্রিয় জায়গা এটা। অফিস থেকেই ফিরেই এখানে ওর বসা চাই।
হঠাৎ অনুভবের পিছু পিছু জ্যোতিপ্রিয়র নামটাও মাথায় এল। তারপরই আঁতকে ওঠে, আরে সেই ফাইলটা! অত কাঠখড় পুড়িয়ে যে জোগাড় করা হল। টেবিলের ওপরেই খোলা রেখে বেরিয়ে এসেছে। সর্বনাশ!
তখন পরপর এমন কয়েকটা ঘটনা ঘটল … ডিজি সাহেবের ফোন, অপারেশন শুরুর অনুমতি, তারপর রোহিতের সঙ্গে কথাবার্তা … সব কিছুর মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিল ওই ফাইলের গুরুত্ব।
এখন কী করবে সে? কাল ফাইলটা অক্ষত মিলবে কি? যদি অরিন্দমের নজরে আসে! সকাল সকালই না হয় সে অফিস পৌঁছে যাবে। কিন্তু তাতেও কি …
সমস্ত রাত্রিটা নির্ঘুমেই কেটে গেল । হায় রে কপাল। যে আনন্দটা আজ সে বয়ে নিয়ে ঘরে ফিরেছিল, আবার সেটা  চাপা পড়ে গেল কোন ধ্বংস বীজের নীচে। নিজের বিছানায় বসে এক অজানা আতঙ্ক নিয়ে জানলার বাইরে রাতকে ফুরিয়ে যেতে দেখল।
পরদিন অনেক সকাল সকালই অফিস পৌঁছে যায় গৌরী। না, ফাইলটা মিলল না। অর্ডারলিকে সঙ্গে নিয়ে তোলপাড় করে খুঁজল সব, ফাইল মিসিং। এমন কী সেন্ট্রাল স্টোরে গিয়েও অনুসন্ধান করা হল, সেখানেও নেই। একটা গভীর সূত্র হাতে আসতে আসতেও যেন হারিয়ে গেল।
(১০)
যা আশঙ্কা করেছিল, তাই হল। কলকাতার টিম দার্জিলিং পৌঁছেই জানতে পারে তাদের রিপোর্টিং অথরিটি, অনুভব সিনহা।  অর্থাৎ এই দল পরিচালনার ভার অনুভবের। তবে অপারেশনে থাকবে অ্যাসিসটেন্ট কমানডেন্ট, আই আর বি।
রোহিতই খবরটা প্রথম জানায়। মনে মনে হাসে গৌরী। যাক, অনুভবের গেম প্ল্যানটা তাহলে সার্থক হল। এ কারণেই তো ও এত দৌড় ঝাঁপ করে দার্জিলিঙ্গের পোস্টিংটা নিয়েছিল।
তবে হরিবাবুকে এসবে মাথা ঘামাতে দেখা গেল না। তার শরীর নাকি পাহাড়ি বাতাস পেয়ে চনমন করে উঠেছে। সে ম্যাডামকে ফোনে জানায়, ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। এই ক্যাপ্টেন সব সামলে নেবে। আর যতখানি পারবে, আপডেট দিয়ে যাবে’।
অনুভবের নির্দেশে ঠিক হয়েছে কলকাতার টিম ঝিলমিলপুর থেকে প্রায় কুড়ি কিলো মিটার দূরে ক্যাম্প করে থাকবে। তবে এক জায়গায় সবাই দলা পাকিয়ে নয়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। যেন তারা একটা ট্যুরিস্ট গ্রুপ। কোনভাবেই যেন শত্রুপক্ষের সন্দেহ তাদের ওপর না পড়ে।  জায়গাটা পাখ পাখালি ঘেরা। ট্যুরিস্টদের আসা যাওয়া লেগেই থাকে।
 হরিবল্লভ মোবাইলে ভিডিয়ো কল করে চারপাশটা দেখাতে দেখাতে চলেছে। নেট কানেকশন মাঝে মাঝে আসছে যাচ্ছে। টিমের সবার কাঁধে ঢাউস ব্যাগ, জলের বোতল, চোখে বায়নাকুলার।
তবে হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছে সকলের। ঘন পাহাড়ি জঙ্গল, রাস্তা বলতে কিছু নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ কয়েক হাজার ফুট ওপরে পাথর ছড়ানো চরাই।
হরিবাবুর মুখে ধারা বিবরণী। রাতারাতি লোকটার ভোল পাল্টে গেছে। খুব স্মার্ট ধরণের কথাবার্তা, যেন এক টি ভি সাংবাদিক কোনও ঘটনা ‘কভার’ করতে করতে চলেছে।
গৌরীর তীক্ষ্ণ চোখ মোবাইলের ভেতর দিয়েই আশেপাশের পরিবেশকে জরিপ করছে। হঠাৎ চাপা গলায় ডেকে উঠল, ‘ক্যাপ্টেন?’
-ইয়েস ম্যাডাম।
-একটা মারাত্মক ভুল হচ্ছে। সবাই বাংলায় কথা বলতে বলতে চলেছেন কেন?  ইংরেজি, হিন্দী, ভোজপুরি, যার যা খুশি চালান, বাংলা নয়। খবরদার নয়। আমার ধারণা সোর্স মারফৎ কলকাতার টিম পৌঁছনোর খবর ওদের কাছে চলে যাবে। তাই বাংলা শুনলেই সন্দেহ হবে। আর একটা কথা,  সকলের চোখে সানগ্লাস মাস্ট, অ্যান্ড মাংকি ক্যাপ। আপনাদের মুখ আর মাথা যেন কভারড থাকে। নইলে চুলের কাট থেকেও ধরে ফেলবে আপনারা পুলিশের লোক’।
-রাইট ম্যাডাম।
হঠাৎ লাইন কেটে যায়। স্ক্রিনে ফুটে উঠল, ‘ভিডিয়ো ফেইলড’। স্বাভাবিক। এই দুর্গম পাহাড়ে এতক্ষণ নেটওয়ার্ক ছিল, এই ঢের।
তবে একটা ব্যাপারে মন খচখচ করছে। অনুভব ওদের এমন দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় পাঠিয়ে দিল কেন? এত দূর থেকে অপারেশন করবে কীভাবে?
সারাটা দিন গুমোট হয়ে রইল মন। দু চারবার ফোনে চেষ্টা করল হরিবল্লভ বা রোহিতকে ধরবার। কারোর নম্বরই লাগছে না। অসহিষ্ণুতা বাড়ছে ক্রমশ। না পেরে অনুভবকেই ফোন করে বসে।
প্রথমবার রিং হয়ে কেটে গেল। দু মিনিটের মধ্যে ওপাশ থেকে কল এল। অন্য একটা নম্বর।
-যাক, তাও যে নিজে থেকে একটা ফোন করলে। – অনুভব হাসছে। খুব শান্ত, ঠান্ডা গলা। খুশির মুডেই আছে বোঝা যাচ্ছে।
-হ্যাঁ, আমার ছেলেপিলেরা এখন তোমার অধীনে। চিন্তা হচ্ছে।
হা হা হা। -তোমার ছেলেপিলে মানে তো আমারও ছেলেপিলে। সো, নো চিন্তা। বাবার কাছে পৌঁছে গেছে যখন, সেফ অ্যান্ড সাউন্ড থাকবে।
-তুমি হঠাৎ ওই টিমকে দার্জিলিং এর শেষ প্রান্তে পাঠিয়ে দিলে কেন? কথা তো ছিল ঝিলমিলপুরের আশ্রম রেইড হবে। কোনও অপারেশন চলার আগে তার দশ মিটার রেডিয়াসের মধ্যে তো ফোর্সকে থাকতে হয়। কিন্তু তুমি …  উদ্দেশ্যটা কী জানতে পারি?
অনুভব খানিক চুপ। তারপর আস্তে বলে, ‘অপারেশনের  স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আমি কোনও রকম আলোচনায় যেতে পারব না। তবু বলি, শান্ত থাকো, সব ঠিক হবে, ভাল হবে।
-না, আমি শান্ত থাকতে পারছি না।
-তাহলে একটা হিন্ট শুধু দিই, আমাদের কাছে খবর আছে, বাবাজী সাঙ্গো পাঙ্গো নিয়ে ওই জঙ্গল পেরিয়ে সিকিমের দিকে প্রসিড করছে। ওদের আটকানো দরকার।
-তাহলে তুমি দার্জিলিং এর টিমটাকে ওখানে ডেপুট করলে না কেন? ওই ঘন জঙ্গল, দুর্গম পাহাড়, চড়াই উৎরাই, সমতলের মানুষ কি পারবে হঠাৎ করে কোনও অভিযান চালাতে? বরং দার্জিলিং এর রেজিমেন্ট কাজটা অতি সহজে করতে পারত।
ফোন কেটে দিল অনুভব, অর্থাৎ সে আর বেশি কথায় আগ্রহী নয়। কিছুক্ষণ পরই ঢুকল রোহিতের ফোন। অস্পষ্ট গলার স্বর। যেটুকু শোনা যায়, মনে হল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। হঠাৎ নাকি হরিবল্লভ টিম ছেড়ে উধাও। বেলা দুটো নাগাদ, ‘এই এদিক সেদিক একটু ঘুরে আসি’, বলে সেই যে বেরিয়েছে, আর ফেরার নাম নেই। এদিকে ঘন জঙ্গল, বেলা ফুরিয়ে আসছে।  হিংস্র জন্ত জানোয়ারের হানাদারি নাকি চলে এদিকে। ওরা তাই ভেবে কুল পাচ্ছে না হরিবাবুকে কোথায় খুঁজতে বেরোবে।
গৌরী কপালের রগ চেপে ধরে। হা ঈশ্বর! এত দূর থেকে ও কাকে কীভাবে সাহায্য করবে? তবু দ্রুত কিছু চিন্তা সেরে নির্দেশ দেয়, ‘আপাতত কাল সকাল না হওয়া পর্যন্ত, কেউ টিম ছেড়ে ওকে খুঁজতে গিয়ে এদিক ওদিক ছিটকে যেয়ো না’।
হরিবাবুকে এই অপারেশনে আনাটাই এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে। অবসরের আর মাত্র দু বছর বাকি। পরিবারে তার স্ত্রী বর্তমান, সেও রুগ্ন, নিঃসন্তান। হরিবাবুর কিছু হয়ে গেলে কী জবাব দেবে স্ত্রীর কাছে? মানুষটা আসলে ঠাণ্ডা মাথার,  সৎ, বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন। অপারেশন চলাকালীন টিমের সদস্যদের দেখভালের জন্যও একজন দায়িত্বশীল মানুষ চাই। এসব কাজে লোকটির জুড়ি নেই। সহকর্মীদের প্রতি যথেষ্ট স্নেহপ্রবণ।
ফোন ছাড়তেই গৌরীর শরীরে একটা আনচান শুরু হল। কোথায় যেতে পারে হরিবাবু? কোনও আততায়ীর হাতে কি … অসম্ভব নয়। চারিদিকেই তো বাবাজীর লোকের হানাদারি।
নিজের চেম্বারে আর বসে থাকতে পারল না। একবার কি অনুভবের সঙ্গে কথা বলবে? ওর ফোর্স দিয়ে খুঁজতে পাঠাবে হরিবাবুকে?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।