ততদিনে পুড়ে ছাই পাঁচ পাঁচটি ট্রেন, অখন্ড ভারতবর্ষে জ্বলে নিভেছে বহু আগুন। অস্তিত্বের দোলাচলতা ও তার পরিণতিতে সগর্বে দেশীয় সম্পদ ধ্বংসের ফলাফল স্বরূপ বাড়ি ফেরা হয়নি বহুদিন।
আমার অসুস্থ বাবা, আর প্রতিদিন বুড়িয়ে যাওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া মা ‘কে দেখতে যেতে প্রতি সপ্তাহান্তে পেরোতে হয় কর্মক্ষেত্রের চরমতম অপমান, পরিহাস আর দুশো কিলোমিটারের পথশ্রম।
ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় সেদিন যখন বাড়ি ফিরছি, বিকেলের পড়ন্ত রোদ হেলে পড়েছে দূরের নারকেল গাছে, এক পাল পঙ্গপালের মত ছোট ছেলেরা হাত নাড়তে নাড়তে ছুটে গেল জমির আল ধরে। ট্রেনের ভিতরে স্ব স্ব বৃত্তে ঘন হয়ে আসছে কথা। উল্টোদিকের সিটে বসে থাকা এক হিন্দু ভদ্রলোক অতি উৎসাহে অন্যের কথাবার্তায় প্রবেশের ব্যর্থ প্রয়াস ছেড়ে, পাশে বসে থাকা স্বল্পভাষী মাঝবয়সী মুসলিম ভদ্রলোকের সাথে ভাব জমিয়েছেন ততক্ষণে। কথায় কথায় জানা গেল মুসলিম ভদ্রলোকটি মুর্শিদাবাদের একটি মাদ্রাসার ইতিহাসের শিক্ষক, আর বিপরীত মানুষটি নিম্ন আদালতে কর্মরত। দগদগে ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেলডাঙা স্টেশন ছাড়তেই হিন্দু ভদ্রলোকটি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন
” মাদ্রাসা মানেই জঙ্গি তৈরির কারখানা! “
কথার পিঠে কথা উঠতে থাকে, উগ্র হিন্দুত্বের সুর চড়তে শুরু করে সপ্তমে, ক্রমশ মিইয়ে যেতে থাকে মাদ্রাসার শিক্ষকের একলা প্রতিবাদ। অধিকাংশ যাত্রী মজা নিতে থাকেন বন্ধ চোখের আড়ালে। হঠাৎই আলোচনা থিতিয়ে আসে পলাশী থেকে ওঠা তৃতীয় লিঙ্গের দুইটি মানুষের উপস্থিতিতে। দুর্মর হিন্দু ভদ্রলোকটি ততক্ষনে ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্র করার দাবি তুলতে তুলতে চিৎকার করে মুসলিম সহযাত্রীকে প্রাণ সংশয়ের হুমকি দিতে শুরু করেছেন –
” ছুড়ে ফেলে দেব ট্রেন থেকে বেশি কথা বললে, এ দেশে থাকলে মাথা নীচু করে থাকতে হবে, দাঁড়া, হোক একবার এন. আর.সি, তারপর দেখছি। “
ইতিহাসের শিক্ষকের মুখে ততক্ষণে নেমে এসেছে মৃত্যুভয়! দেশ ও সম্প্রীতির উপর মোটামুটি বারোটা কবিতা লিখে ফেসবুকে শতাধিক ‘লাইক ‘ কুড়োনো আমি ঘনায়মান অন্ধকারে খুঁজে বেড়াচ্ছি শিরদাঁড়াটা।
হঠাৎই অন্ধকার খান খান করে চেঁচিয়ে উঠলেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষটি –
” ওই ভদ্রলোকের পো, কাকে ছুড়ে ফেলবি ট্রেন থেকে? ধর্ম ধুয়ে জল খা তোরা, যা! আর এই যে ভদ্রলোকের বাচ্ছারা, বসে বসে সব মজা দেখছিস? আমাদের তো লজ্জা নাই, তোদেরও নাই নাকি? “
মৌলবাদী কন্ঠস্বরের টুঁটি চেপে ধরে ভিড় ঠেলে ওরা গাইতে গাইতে চলে গেল –
“ছি ছি, ছুঁয়োনা কি করো,
বিদেশী নাগরও,
আমরা ফুলেরও সখী। “
ততক্ষণে কৃষ্ণনগর স্টেশনে ঢুকছে ট্রেন, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মহাপ্রভুর মূর্তি, প্রেম গাইতে গাইতে উর্দ্ধবাহু দাঁড়িয়ে আছেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ হিন্দু।