গদ্যে সৌমিত্র চক্রবর্তী

যাযাবরী কথা

রোজদিনের গল্প বলে কিছু থাকে না। সবই নৈমিত্তিক যন্ত্রচালিত। খুব দমবন্ধ করা ভীড়ের মধ্যেও কিছু মানুষ একা থেকে যায় আজীবন। জোয়ালভাঙা রূপকথার রুপান্তরের কল্পকাহিনীগুলো তাদের জীবনে কোনোদিনই সদর্থক বাস্তব হয়ে ওঠেনা।
যাযাবরী কথা স্থিত হলে প্রখর গ্রীষ্মদুপুরে আচমকা মেঘ আসে। বিজলি চমকায়, জল পড়ে ঝমঝম ঝমঝম … সব স্থিরতা ছিন্নভিন্ন করে হঠাৎই বাজ পড়ে ফাঁসিদেওয়ার মাঠে। স্থবির ঘরের জানলা দিয়ে চিরে যাওয়া তীব্র আলোর ঝলক যাযাবরকে স্নান করিয়ে দেয়। সে চমকে ওঠে। কোন দূর অতীত থেকে অস্পষ্ট সুর ভেসে আসে। সেই অপার্থিব সুরের মায়াজাল আর কারো কানে পৌঁছয় না। শুধুমাত্র এলোমেলো ঝাঁকড়া চুলের হারিয়ে যাওয়া সওদাগর সেই গান শুনে উন্মনা হয়। কি যেন এক হারিয়ে যাওয়া রঙিলা সুতোর ঝাঁক কয়েক লক্ষ ভোল্টের বাজের আলোর ঝলকানিতে তার ভুত অতীতের কিছু স্মৃতি বুলিয়ে দিয়ে যায়।
মন খারাপ হয় হতভম্ব যাযাবরের। কেন মন খারাপ? কিসের জন্য মন খারাপ? এর ব্যাখ্যা কখনোই কোনো যাত্রী জানতেও পারেনি, পারেনা। শুধু অনুভব করে তার দৈনিক একঘেয়ে কাজের বেড়াজালে আটকে থাকা মন আজ তার হুকুম মানতে রাজী নয়। বড্ড অবাধ্য এই মন বড় বিষম বস্তু। তার হদিশ কেউ কখনো পায়নি, পাবেওনা কখনো। খোলা জানলার সামনে হাজার নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ছুটে যায় লোকটা। শতচ্ছিন্ন মন নিয়ে দেখতে থাকে বাইরের প্রকৃতি তছনছ করা ভয়ঙ্কর তান্ডব।
সময় কে ধরে রাখার তুচ্ছ চেষ্টা সে করেনি কখনো। তার সঙ্গে আলাপ করেছে, গলাগলি করেছে, রমণে মত্ত হয়েছে গভীর রাতের অস্বচ্ছ কালোর পর্দার আড়ালে। জমে থাকা গম্ভীর কালো মেঘের মধ্যে থেকে সপ্তদশ শতকের ঘোড়ার টগবগে ক্ষুরের শব্দ ভেসে আসে। আর আসে চিকের বেপর্দা আস্পর্দ্ধায় জড়োয়ার টুংটাং লহরীর নেপথ্য সঙ্গীতের ঝালরে গহরজানের মায়াবী গলা –
     “বিছর যায়ে সাঁইয়া মোরি
বিজরি ছরক কে …
পিয়ামন তো হি ন চায়…”
দরজা খুলে বেরিয়ে আসে লোকটা। উন্মত্ত উথালপাথাল এর মধ্যে হাঁটতে থাকে আনমনে। একমাত্র তারই বাজকে পরোয়া নেই। কোনো শেকলে কেউ আটকে রাখতে পারে নি তাকে। বিছর যায়ে রঙিলা বসত…।
Spread the love

You may also like...

error: Content is protected !!