গদ্যে ঈশানী রায়চৌধুরী
এক ধরনের বিপন্নতা
( ১ )
মহর্ষি আজকাল কিঞ্চিৎ বিমর্ষ থাকেন | সংসার, সংসার, সংসার ! উফ, কেন যে দুর্মতি হয়েছিল ওই বিষকন্যের সঙ্গে ঘর বাঁধার ! সারাটি জীবন জ্বলে পুড়ে আঁধার হয়ে গেল | বাইরের লোকজন মান্যিগন্যি করে, হেঁ হেঁ করে তোল্লাই দেয় ঠিকই, কিন্তু যার ঘরের ভেতরেই উঠতে বসতে কেউটের ছোবল, তার যে কী জ্বালা ! না:, এমনিতে ঘরকন্নে করছে, দরকারমতো ছত্তিরিশ পদ রাঁধছে, সন্ধে হলে তুলসিতলায় নিয়ম করে পেন্নামও করছে ; কিন্তু সব গুণ এই এক দোষে বিষ হয়ে গেল | কথায় কথায় এমন স্বামীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা ! এখন তো এ প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ! আসলে হিংসে ! মেয়েমানুষ তো ! ওই যে অল্পবয়সী মেয়েরা তাঁর রূপে ( যাক গে যাক, চেহারাটা অবিশ্যি কোনকালেই তেমন কিছু…. ), গুণে ( এটা কেউ অস্বীকার করতেই পারবে না, এখানে খাপ খুলতে হচ্ছে না কাউকে… ) অস্থির ; ওইটেই যেন মোটে সয় না মাগীর | এদিকে দেমাকে মটমট করছে ! কালেভদ্রে একটু কাছে ঘেঁষতে গেলেই বলে,
–মেয়েদের শরীরের কী বোঝো তুমি !
না:, তা আর মহর্ষি বুঝবেন কেন ! বুঝবে শুধু ব্যাটা বাৎস্যায়ন ! তাও যদি না কামশাস্ত্র লেখার সময়ে তাঁর পায়ের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত ! প্রতিটি অধ্যায় তো তাঁরই হাতে ধরে শেখানো ! তা সে কথা একবার বলতে গিয়ে কী হেনস্থা ! মহর্ষির নাকি হাতযশ নেই ! কীসের ? না, ফোর প্লের | ছি ছি, বিয়ে করা বৌয়ের সঙ্গে ও সব করতে আছে ? মুনিঋষিরা ধ্যানজপতপ করবেন, শিষ্য শিষ্যারা সেবা করবে, শিষ্যাদের দেখে একটু আধটু চনমনানি আর দৃষ্টিসুখ, ব্যস ! পত্নীসংসর্গ ? সে তো হবে কালেভদ্রে | ইন্দ্রিয়াসক্তি থাকলে সিদ্ধিলাভ হয় না | কিন্তু এই অর্বাচীন রমণী … ঘরশত্রু বিভীষণ !
মহর্ষি আজ সকাল থেকে আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে বসেছেন | একটা বিদেশের অ্যাসাইনমেন্ট আছে | বতিচেলি অনেক দিনের পুরোনো ছাত্র | সেই কোন যুগের | সে হাতে পায়ে ধরেছে কিছু ছবি এঁকে দিতে হবে | মেয়েমানুষের ছবি | তার নাকি কিছুতেই ঠিকঠাক হচ্ছে না | এদিকে একজিবিশনের সব তৈরী | উপরোধে কত ঢেঁকিই যে গিলতে হয় !
বা:, বেশ হয়েছে ছবি | বহুদিন পর তুলি ক্যানভাস | কিন্তু আঙুলের ম্যাজিক একই আছে তো ! মহর্ষি সহর্ষে হাত ঘষলেন,
— জয় গুরু ! উফ , গুরু আবার কে ! আমি স্বয়ম্ভু !
বিকেলের আলোয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ক্যানভাস দেখছিলেন তিনি | কিন্তু অত সুখ কপালে সইলে তো ! মাগী ঠিক গন্ধে গন্ধে হাজির ! একগাল হেসে জানতে চাইল,
— কী করছ গো ?
মহর্ষি ব্যাজার মুখে বললেন,
— দেখতেই তো পাচ্ছ ছবি আঁকছি | দু-দিনে বাইশটা ক্যানভাস শেষ করতে হবে | তুমি যাও তো এখন ! অনেক কাজ !
— দেখি দেখি ! ও মা, এ কী ছাইভস্ম এঁকেছ ! মেয়েটার বুকদুটো এমন ফজলি আমের মতো কেন ? ম্যা গো ! এদিকে মুখটা তো কচি | চোখ মুখের ধরন তো বলে কাঁচা বয়সের যুবতী | তার এমন বিচ্ছিরি শেপ ? আর ওই ছ্যাতরানো কোমর ! দেখেই মনে হয় বছরবিয়োনী ! হবেই তো ! তোমার শুধু ওই চোখ দিয়ে মেয়েমানুষকে ছুঁয়ে থাকার ধ্যাষ্টামো থাকলে এর বেশি আর কীই বা হবে ! মরণ দশা ! তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকল, এখনও মেয়েমানুষের গতর চিনলে না, আবার লম্বা লম্বা কথা ! হ্যান পারি, ত্যান পারি ! মুখে আগুন অমন পারাপারির ! সারাটা জীবন যৌবন আমার জলে গেল ! উফ, লজ্জা লজ্জা ! কিস্যু মুরোদ নেই ! আজ ফাঁস হল তো বাকতাল্লা ! হাতযশ না ছাই ! কানার আবার হাতযশের গুমোর ! নেহাত আমি সতীলক্ষ্মী, তাই এই তোমার মতো শুকনো সন্নিসির ঘর করি ! অন্য যে কোনো মেয়ে হলে তোমার ইয়েতে লাত্থি মেরে কবেই নাগরের হাত ধরে চলে যেত !
মহর্ষি গুম মেরে বসে রইলেন | আজ কেন জানি না আর বলতে ইচ্ছে করল না… সেই সব দিনগুলোর কথা… অজন্তার গুহাচিত্র আঁকার সময়ে …ওঃ, সে সব দিন ছিল বটে ! দলে দলে তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা …
মহর্ষি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের শুষ্ক খর্জুরপ্রতিম অন্ডকোষদুটিতে হাত বোলাতে লাগলেন |
( ২ )
মহর্ষির আশ্রমে সকাল আজকাল থেকে সাজ -সাজ রব লেগে থাকে | রোজই | আশ্রমখুকীরা বয়সে ও গঠনে দিব্যি পরিণত | অবিশ্যি সে তো হবেই, মহর্ষি তো আবার দৃষ্টিসুখে বিশ্বাসী ; কিন্তু তাদের খুকীসুলভ অন্তহীন সারল্য ও চাপল্য | সারাক্ষণ ফুরফুরে দুষ্টু টুনটুনি হয়ে কাজের চেয়ে অকাজে ব্যাপৃত আর যত মরণদশা আশ্রমের যুবককুলের | মহর্ষির গুরুগম্ভীর কথায় ভুলে আর টুনটুনিদের পিছু নিয়ে আশ্রমে নাম লিখিয়ে বেমক্কা ফেঁসে গেছে | যাবতীয় বেগার খাটা তাদেরই কপালে | মহর্ষি তাদের দিয়ে জল তোলাচ্ছেন, ধোপার খাতা লেখাচ্ছেন, বাজারহাট মুদিখানা সব | এমনকী নিয়মিত নিজের গিন্নির টিপের পাতা থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন পর্যন্ত কিনিয়ে আনছেন | কোনো কোনো হুমদো মার্কা তরুণ আনাজও কাটছে, ঘষঘষ করে তাল তাল মশলাও পিষছে | অথচ মহর্ষির প্ল্যান ছিল অন্য | ভেবেছিলেন, যুবতীরা “গুরুদেব গুরুদেব “বলে কোলে কাঁখে লেপ্টে থাকবে, তাদের ভরপুর স্বাস্থ্য হলেও ভরপুর বোধবুদ্ধি তো নেই, কাজেই তিনি যা বলবেন ..তাই বেদবাক্য আর এই মেয়েদের পিছু নেওয়া ছোঁকছোঁক-পার্টি ছোঁড়াগুলোকে নিজের পাবলিসিটির কাজে লাগাবেন | মহর্ষির বহুমুখী প্রতিভা তো ! লেখেন, আঁকেন, গানবাজনা করেন | কিন্তু বিধি বাম ! মহর্ষির ভার্যাটি, সত্যি কথা বলতে কী, মহর্ষির এই বালতিভরা প্ল্যানপ্রোগ্রামের দুধে সিরিঞ্জ করে স্রেফ চোনা মিশিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন |
উফ, এই এক নারী ! হাড়মাস ভাজাভাজা করে দিল একা হাতে ! অথচ বনপথে যখন সেই ন্যগ্রোধপরিমন্ডলা নব্য যুবতীটিকে দেখে চিত্তে মলয়পবন বয়ে গিয়েছিল, তখন বোঝেননি কী ভয়ানক আয়লা টাইপের এই মেয়েছেলে ! গুরুনিতম্বিনী, আহা স্তনদুটি যেন পাকা শ্রীফল, কটিদেশটি তো হাতের মুঠোয় ধরা যায় … ইয়ে খুঁত বলতে সামান্য বোঁচা নাক, কিঞ্চিৎ ক্ষুরধার জিহ্বা আর তিড়িংবিড়িং স্বভাব | তা ভেবেছিলেন দু-দিন সংসারধর্ম পালন করলে সমঝে যাবে, মাতৃভাব আসবে | ও হরি ! এ বলে,
— আমিও তোমার মতো বড় বড় বই পড়ব, দিস্তে দিস্তে কাগজে গুরুগম্ভীর রচনা লিখব, আমিও বোকাসোকা লোক পেলে চাট্টি জ্ঞান দেব |
মহর্ষি প্রথমে ভাবতেন, আহা ছেলেমানুষ ! তা লিখুক ! কুচোকাচা ছড়া লিখুক, ছোটবেলার রান্নাবাটি পুতুলের বে’ দেবার গপ্পো লিখুক, চাই কী কাঁচা হাতে একটা দুটো নিবন্ধও চলবে | বাকি সময়ে রান্না করবে, গরু বাছুরদের জাবনা মেখে দেবে, সন্ধেবেলা চুলটি বেঁধে মুখটি মুছে টিপটি এঁকে তাঁর শ্রীমুখের সামনে তদ্গত হয়ে বসে বসে বাণী শুনবে | কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক ! এই তো সেদিন যেমন ! ছবি আঁকা নিয়ে অত হুজ্জুতি করল ! ক’টা দিন বাদে চুপিচুপি সবে একটু কিছু লিখতে বসেছেন, অমনি এসে হাজির | কাগজ বাজেয়াপ্ত |
–দেখি দেখি কী লিখছ !
তার পরেই বোঁচা নাক উঁচু করে,
–এ মা, এ তো ঝাড়া মাল | সঅঅব আমি বইতে পড়েছি | বাপের বাড়িতে |
অর্বাচীন নারী ! থাক না বাপু মেয়েমহলে বুলবুলি চুলবুলিদের সঙ্গে ..তা নয় ! এলেন জ্বালাতে | কাকে বোঝাবেন যে এগুলো মোটেই ঝাড়া মাল নয় ! অনেক ঝাড়াই বাছাই করে সাবধানে কোলাজ করা | যাতে লোকে বুঝবে, কিন্তু আঙ্গুল তুলতে পারবে না | এর বাজার-চলতি নাম হল ডিকনসট্রাকশন | এতেও এলেম লাগে | এই কাজ করে করে মহর্ষি চুল দাড়ি পাকিয়ে ফেললেন, এখন এই সেদিনের মেয়ে তাঁকে জ্ঞান দেবে ?
মাগীর ভারী মদ্দানি স্বভাব ! ছেলেছোকরাদের সঙ্গে সময়সুযোগ পেলেই রংবাজি আর হ্যা হ্যা হি হি | এই সব দেখেশুনে খুকীরা কী ভাগ্যিস একে তেমন পছন্দ করে না ! তবে কয়েকটা গণ্ডমূর্খ ছোঁড়াকে ঠিক দলে টেনেছে | তাদের দিয়ে কাগজ কলম কালি আনায়, ফাইফরমাশ খাটায় | বশংবদ করে রেখেছে | ছ্যা ছ্যা ! তারাও “দেবী” বলতে অজ্ঞান | হারামজাদাগুলোর ইল্লুতে স্বভাব যত ! “মা ” বল, “মা “! তা সে কথা শুনে মাগী খিলখিল করে হেসে লুটিয়ে পড়ে |
— না বিইয়েই আমি বুঝি কানাইয়ের মা ? তোমার তো কনস্ট্রাকশনের আগেই সব খেল খতম ! অবিশ্যি অত ডিকনসট্রাকশন করলে তো এমনটাই হবে | এত করে বলি ক্রিয়েটিভ হও ! কী বিছানায় , কী রচনায় … হি হি .. |
আজ মহর্ষি মরীয়া | সকাল থেকে সাধনমন্দিরে দরজা দিয়েছেন | তাঁর উপাস্য দেবতা শিব | একাগ্র হয়ে ডাকলে কী না হয় !
— বাবা, বাবা গো !
— বল রে ব্যাটা, কী চাস |
— বাবা, আমি যদি বাপের ব্যাটা হয়ে থাকি তো আমাকে এমন মন্ত্র দাও যাতে আমি এই বেয়াড়া মেয়েছেলেটাকে, থুড়ি আমার স্ত্রীকে বশে আনতে পারি |
দেবাদিদেব শিউরে উঠে বললেন,
— যা আমার ক্ষমতায় কুলোয়, সেটুকুই চা’ না বাপ | বউ বশে রাখার তুকতাক জানা থাকলে কী আমি নিজে ঘরে টিকতে না পেরে শ্মশানে মশানে নেশাভাং করে পড়ে থাকি, নাকি সে আমার ঘাড়ে উঠে আমাকে একান্ন পীঠে ঘোড়দৌড় করায় আর আমাকে পায়ের নীচে রেখে জিভ বার করে হ্যা হ্যা করে ভ্যাংচায় ?
— আমার কী হবে বাবা তাহলে ?
— তোকে বাঁচাতে পারে একমাত্র ছুরি কাঁচি |
— খুন করতে শেখাচ্ছ বাবা ?
— আ মোলো যা ! খুন করবি কেন ? বিসজ্জন দিবি |
— কী বাবা ?
— তোর অহং, তোর পুরুষকার | সার্জেনের কাছে | এখন তো কী সব অপারেশন করে সেক্স চেঞ্জ করা যায় শুনেছি , বরং ওইটে করে নে | মাগী ট্যাঁ ফোঁ করতে পারবে না | বড্ড মদ্দানি স্বভাব না ! কেমন জব্দ ! হয় দুই বোনের মতো মিলেমিশে থাকবি, নয়তো দুই সতীনে চুলোচুলি |
মহর্ষি দুই উরুর সন্ধিস্থলে হাত রেখে আসন্ন মহাদুর্যোগের সম্ভাবনায় শিউরে উঠলেন |