কবিতায় শুভদীপ নায়ক
প্রশ্নহীন, একা
১
মরা প্রজাপতিরাশি
আমি তাই নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি
পাহাড়ে, পাতা ঝরা পথ আর বনান্তের
সমস্ত আড়াল আমার সাক্ষী
নিজেকে ফুটিয়ে তোলা ছাড়া
সেগুনকাঠের আর কোনও যত্ন নেই
বৃক্ষস্বাধীনতা নিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে
পাহাড়ের ক্ষুধার্ত শৃঙ্গে, বরফের স্রোত
ডিঙিয়ে বসে আছে পূর্ণযুবতীরা, বিবর্ণ সারসের মতো তাদের স্বচ্ছদৃষ্টি ।
এইভাবে একদিন সব উপহার শেষ হয়ে যাবে
খণ্ড মেঘ এসে একদিন নিয়ে যাবে জলপাইবনে, কুরুশকাঁটার জঙ্গলে
কোথায় গড়িয়ে পড়েছে জল ? কোন চোখে মানুষ তাকিয়ে থাকে শতপ্রশ্নে ?
এল বাঁক, এল হরিণের দল
জুঁই ফুল ঝরে গেল প্রেমিকার বুকের ওপরে,
খসে গেছে বনেদিয়ানার চিহ্ন, আকশি-সংকেত
সাবানগুঁড়োর মতো অর্ধসত্য ঘুম চিরদিন মিশে গেছে স্বপ্নে
এত পথ পার হয়ে এসে কুটির নিয়েছি সবেদার বনে, মাটির সরায় রাখা
তরল বিষে পিঁপড়ের মতো জমা হয়েছি বৈচিত্রদোষে,
প্রজন্ম শিকড় ছড়ায়,
জীবনের তলদেশে, করুণাবৃত্তি ও নিরালার গান নিয়ে ।
২
চারপাশে পরশ্রীকাতর বেলুন উড়ছে ,
তাকে কি খুব অস্পট দেখতে পাচ্ছি ?
আজ ফুলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলাম
কাল ভুলতে বসব গাছের সমস্ত ফল-কে
‘এই বেমানান অসভ্যতা কেন ? আমার জন্যে ?’
হ্যাঁ, ছোটগল্প আর কবিতা লিখে বন্ধুতা নেমে এল
স্পর্শে, কাহিনি এল চিত্রনাট্যে,
শাকসবজি আর পুকুরে নরম মাছের ভালবাসাবাসি হল,
যুবতী আঁধারমথ,—আমাকে বোলো না
তার হাত ধরে টেনে এনে এ অরণ্য সাজাতে ।
এ খাতায় যে বাতাসটুকু বইছে, তার নেশা এতই প্রবল,
তার সংকট এতই ঋণগ্রস্ত, অবিনাশী চোখ আর সহস্র স্থাপত্যে
এতই তার বিপুল ভাঙাভাঙি,
জন্মমাত্র হ্রদের গভীরে নেমে আমি তাকে চিনতে পারিনি,
ভেবেছি সুতো পরানোর মতো সে এক সামান্য সূচের ব্যাপার ।
মলাট দেওয়ার আগে মার্জিন টানিনি,
কাগজের মোড়কে, মহাবিষুবের ক্ষতে
জীবন কি হারিয়ে গেছে কোলনস্পর্শী চিঠিতে ? জবাব পাইনি ।
শুধু আশ্চর্য জলের ফোয়ারার নিচে ঝাপিয়ে পড়েছিল উড়ন্ত বনপাখি ।
৩
বাগানবাড়িতে গিয়েছি, দেখি সোফার ওপরে বসে হলুদ সিফন শাড়িতে
পত্রিকার পাতা উল্টে দেখছে, আজ ত্রিশ বছর হল, নোনাজল পার করে,
শরীরমনের জাল ছিঁড়ে, স্বপ্ন দেখার অলিগলি ঘুরে, নতুন চিঠির ভাঁজ খুলে,
পরকলা মেঘের মতো সিকিভাগ অহংকার সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে ।
একদিন নতুন চাকরির খবর, অচেনা গাছ, পাহাড়ি পথ আর ছুটন্ত খুরের আঘাত
সবকিছু ভাগ করে নিয়েছি, তাকে ঘিরে স্ত্রীর সব অপমান গোপনে নিয়েছি মেনে ।
সেই বিমূর্ত অপেক্ষারত লোভাতুর শরীরটির কাছে, যাকে দুহাতে জড়িয়ে ব্যাথা দিয়েছি,
সুর তুলেছি, অন্ন চেয়েছি, বস্ত্র ঘেঁটেছি, মাছের আড়ত ভেবে আঁশ খুঁজে
অনায়াসে তাড়না পেয়েছি, আজ এই ঠাণ্ডা রোদের দিনে দরজায় পুরুষের ছায়া পড়তেই
উঠে এসে নীরবে দাঁড়ায়, ‘কতদিন পরে এলে, চিঠিতে আসার কথা না লিখেই,
অকস্মাৎ এমনভাবে দরজায় কড়া নাড়লে, মনে হয় পুরনো বাতাস বুঝি ফিরে এল জীবনে,
শঙ্কায় বেজে উঠি, কাঁটাবনে বিঁধে যাই নীরবে ।’
কোমর জাপটে ধরি, চোখ দুটো ভরে ওঠে লাজে । হাতাকাটা কালো ব্লাউজের
শাসন এড়িয়ে ক্ষীণ হাত দুটি আমাকে জড়িয়ে ধরে নিবারণ পেতে চায় ।
আঙুলের সরু ডগা বোতাম খুলতে থাকে জামার কলারে, জলাভূমি ছেড়ে,
কোঠর ফেলে, কয়েক’শ প্রজাতির পাখি অন্যত্র উড়ে যায় ।
যা কিছু বৃষ্টিভেজা, স্বপ্নভেজা, রোদের আঘাতে যা কিছু ক্ষতবিক্ষতময়,
সেইসব অবক্ষয়ী পরাধীন ঘাস গজিয়ে উঠল আমাদের উঠোনে, দালানের
একপ্রান্তে পাতা হল চায়ের টেবিল, খবরের কাগজ ভারি বইয়ের চাপে
নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে, চায়ের পেয়ালা আজ ভরে এল, সুধা আর ক্ষুধা
এক হয়ে গেছে । স্নানের অনেক পরে খালি গলায় আর ভিজে চুলে
বেতের মোড়ায় বসে দূরগামী পথটির দিকে আয়নার মতো তাকিয়ে ।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী দেখছ ?’