• Uncategorized
  • 0

কবিতায় জয়ন্ত দেবব্রত চৌধুরী

কাহিনীর শেষে

একটা ভোরবেলার ট্রেনে এই একাকী যাত্রার শুরু হয়েছিল। কবির জীবনের মতো অগোছালো একটা ফাঁকা কামরা; ঝালমুড়িঅলা দূরস্থ, না ছিল কোথাও পোষমানা পশমি বেড়াল। শুধু আশ্বাসের মতো তাজা হিলিবিলি বাতাস ছিল, এক গোলাপি যুবক ছিল, ‘ভালোবাসি’- এই উত্তাপ ছিল শীতাতুর কামরাকে আদুরে বালাপোশের মতো জড়িয়ে। একটা পেছনে ফেলে আসা অসমাপ্ত দুর্গোৎসব ছিল, ঢলোঢলো মুখের প্রতিমা ছিল কোনও। ট্রেন থেকে নেমে লাল মোরাম বিছানো পথের প্রান্তে সূর্যের শেষ আলোর মতো ব্যতিক্রমী একটা উদার ঝাউ বন ছিল। দিনের আলোয় জাগ্রত সব শক্তিপীঠ ছিল, ছুটন্ত সাইকেলে দুই সাঁওতাল কিশোর ছিল, চুনকাম করা রাজবাড়ি ছিল একটা, পোড়ামাটির ফলকে রাবণের প্রাণ ছিল। রাতের আকাশে চাঁদ ছিল, নষ্টা চাঁদের নেশা ছিল, নেশায় বাউলের দরাজ গান ছিল। এসবের আগে সবুজ রংচটা বাড়ির ছাতে ঈশ্বরের মতো অভিশপ্ত একটা চিলেকোঠার ঘর ছিল, যাতে আসবাবপত্রের পরিবর্তে ডাঁই করে রাখা থাকতো চাপচাপ অন্ধকার। একটা মলিন জাদুকরের তৈলচিত্র ছিল, ক্রুশবিদ্ধ যীশু ছিল পেরেক দিয়ে দেয়ালে টাঙ্গানো। একটা উইয়ে কাটা বাংলা অভিধান ছিল, তাতে ‘বোধন’এর আগে ‘বিসর্জন’ ছিল। যাত্রাশেষে একটা নতুন ঘর ছিল, ঘরের মধ্যে মাতাল ঘুম ছিল, ঘুমের মধ্যে প্রাচীন প্রতিশোধ নিতে বিদেহী আত্মার মতো ফিরে ফিরে আসা কোনও নারীর স্মৃতি ছিল। বাম বাহুতে তীক্ষ্ণ নখরের স্পর্শ ছিল, নখে বিষ ছিল, বিষে মুক্তি ছিল। আর কোথাও একটা পরিত্যক্ত কবরস্থানের সোঁদা গন্ধ ছিল, তাতে সৃষ্টির আদি থেকে রাখা একটা পাথরের বেঞ্চ ছিল, বেঞ্চে সময় যেন থমকে ছিল; যাতে বসে কালের আবর্তে পুনঃপ্রবেশ করার আগে কেউ বসে ছিল ঘণ্টাখানেক, ঘনঘন হাতঘড়ি দেখছিল, আর তখনই একটা প্রেমের মত সর্বগ্রাসী উল্কা এসে পড়েছিল মহামহিম এই পৃথিবীর ক্লান্ত শিথিল বুকে।

ফুরিয়ে যাওয়া দিনের আলো

বিগতযৌবনা সাদামাটা একটা সবুজ বাড়ির কোল আলো করে আমি এসেছিলাম একদিন। তখন দিনগুলো কত দীর্ঘ ছিল, ঘরগুলো কত উঁচু! নিমকাঠের পক্ষীরাজের দুই ডানা বরাবর ছড়ানো থাকত শীর্ণ রাজপুত্রর নিপাট রাজত্ব। সাদা ঘোড়ায় চেপে, মর্চে-ধরা বর্শা-হাতে যখনতখন যেতাম বিরাট রাজ্য পরিদর্শনে। বাড়ির পেছনে অগোছালো বাগানের নাম-না-জানা বুনো গাছেরা ছিল আমার অনুগত দুঃস্থ প্রজা। রাজার সামনে মাথা না নোয়ালেই তাদের শিরশ্ছেদের শাস্তি হত অনিবার্য। ধারালো অস্ত্রভয়ে আর আমার প্রবল দাপটে বিদ্রোহের কথা ঘুণাক্ষরেও কখনো মুখে আনেনি তারা, বড়জোর প্রবল মারের মুখে রাজামশাইকে শান্ত করতে হয়ত একগোছা রক্তগোলাপ ঝরিয়ে দিল পায়ের কাছে! একবার চৈত্রমাসের শেষের দিকে সে কী ঝড়বৃষ্টি! আটটা দামাল হাতি যেন প্রকাণ্ড শুঁড়ে করে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে পিছল করে দিচ্ছিল গোটা জগৎটাকে। সারাটা রাত পক্ষীমাতার পক্ষপুটে মাথা গুঁজে রইলাম। সারাটা রাত বিভীষিকাময় বাজপাখি ছোঁ মেরে মেরে গেল আমার সাজানো বাগানে। পরদিন সকালে পায়ে পায়ে গেলাম সেখানে, অসমযুদ্ধে হারা সৈন্যর মত তারা পড়ে আছে এখানেসেখানে, কারোর হাত নেই তো কারোর পা। অকালবিধবা লতারা সাদা পোশাকে মুড়ে রেখেছে সারা দেহ, আমি সামনে যেতেই দুই পা জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়ল আকুল কান্নায়। আমার কেমন জানি মায়া হল, তখন ইস্কুলে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কথা জেনেছি সদ্য, ভাবলাম যদি নতুন করে কয়েক ঘর প্রজাপত্তন করা যায় তো এই অবলারা প্রাণে বাঁচবে অন্তত! ঘটনার ঠিক তিনদিন বাদে রোববারে একজন ঠিকে কাজের লোক ডেকে পুরো বাগানটা পরিষ্কার করালো বাবা— একেবারে সবশুদ্ধ সাফ। মৃতের স্তূপে দুয়েকটা জীর্ণ জীবন চাপাটাপা পড়েই থাকে সচরাচর, তার হিসেব কে আর রাখে! এখন বেলা পড়ে এলে বুকের ভেতর সেই চাঁপা গাছেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাতের বেলায় প্রাচীন প্রজারা পুনর্দখল করে তাদের অধুনাপ্রৌঢ় প্রভুকে, পূর্ণ চাঁদের আলোয় আমি কখনোসখনো গাছ হয়ে যাই।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।