সাপ্তাহিক ধারাবাহিক নিবন্ধে সৌভিক ঘোষাল – ৫
বৈদিক সাহিত্যের সময়কাল নিয়ে দু চার কথা
এই যে বৈদিক সাহিত্যর কথা আমরা বলি, কি কি তার উপাদান? কবে রচিত হয়েছিল সেগুলি?
বেদ বা বৈদিক সাহিত্যের চারটি পর্যায় রয়েছে। আমরা বেদ বলতে যে চারটি বেদকে সাধারণভাবে বুঝে থাকি, সেটা হল েবৈদিক সাহিত্যের প্রথম পর্যায়। তার নাম সংহিতা।
বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীনতম অংশ হল সংহিতা। ঋক, সাম ও যজুঃ বেদ সংহিতাই প্রথমে প্রচলিত ছিল। পরে অথর্ববেদও সংহিতা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে সংহিতাগুলির মূল অংশ রচিত হয়। ঋকবেদের দশটি মণ্ডল আছে। দ্বিতীয় মণ্ডল থেকে সপ্তম মণ্ডল এর মধ্যে প্রাচীনতম। ঋকবেদের এই প্রাচীন অংশটি ১৫০০ থেকে ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে ও অন্যান্য অংশ ১০০০ খ্রী পূর্বাব্দের মধ্যে রচিত হয়ে থাকবে।
৯০০ খ্রী পূর্বাব্দের মধ্যে সামবেদের চূড়ান্ত সংকলন, কৃষ্ণ যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ রচিত হয়ে যায় এবং ৮০০ খ্রী পূর্বাব্দের মধ্যে শুক্ল যজুর্বেদ রচিত হয় বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন।
সংহিতা সাহিত্যের পরবর্তী অংশ হল ব্রাহ্মণ সাহিত্য।
ঋকবেদের সঙ্গে অন্বিত ব্রাহ্মণ দুটি হল – ১) ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও (২)সাংখ্যায়ন ব্রাহ্মণ।
যজুর্বেদের দুটি ভাগ। কৃষ্ণ যজুর্বেদ ও শুক্ল যজুর্বেদ। কৃষ্ণ যজুর্বেদের সাথে সংশ্লিষ্ট ৩) তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ এবং শুক্ল যজুর্বেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৪) শতপথ ব্রাহ্মণ। সামবেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হল ৫) তাণ্ড্য বা পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ ৬) তবলাকার বা জৈমিনীয় বা ষড়বিংশ ব্রাহ্মণ। অথর্ববেদের ব্রাহ্মণ হল ৭) গোপথ ব্রাহ্মণ।
খ্রীষ্টপূর্ব ৯০০ থেকে ৮০০ র মধ্যে প্রাচীন ব্রাহ্মণগুলি এবং ৮০০ থেকে ৭০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে নবীন ব্রাহ্মণগুলি রচিত হয়।
ব্রাহ্মণ সাহিত্যের পরবর্তী পর্যায়ের বৈদিক সাহিত্য হল আরণ্যক সাহিত্য। প্রধান চারটি আরণ্যক হল ১) ঐতরেয় আরণ্যক ২) সাঙখ্যায়ন আরণ্যক ৩) তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৪) বৃহদারণ্যক আরণ্যক।
আরণ্যকের পরবর্তী পর্যায় হল উপনিষদ। বৈদিক সাহিত্যের এই অংশটির সাথেই আমাদের পরিচয় সবচেয়ে বেশি। এগুলির মধ্যে আছে ঋকবেদের সঙ্গে অন্বিত ১) ঐতরেয় ২) কৌষিতকি। সামবেদের সঙ্গে অন্বিত ৩) ছান্দোগ্য ৪) কেন। কৃষ্ণ যজুর্বেদের সঙ্গে অন্বিত ৫) তৈত্তিরীয় ৬) কঠ ৭) নাগামৈত্রায়ণীয় ৮) শ্বেতাশ্বতর। শুক্ল যজুর্বেদের সঙ্গে অন্বিত ৯) বৃহদারণ্যক ১০) ঈশা। অথর্ববেদের সঙ্গে অন্বিত ১১) প্রশ্ন ১২) মণ্ডুক ১৩) মাণ্ডূক্য উপনিষদ।
খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ থেকে ৭০০ র মধ্যে আরণ্যক ও প্রাচীন উপনিষদগুলি এবং ৭০০ থেকে ৬০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে নবীন উপনিষদগুলি রচিত হয়।
বেদ কর্ম ও জ্ঞানকাণ্ডের আকর। ব্রাহ্মণ মূলত কর্মকাণ্ডের আলোচনা। উপনিষদ মূলত জ্ঞানকাণ্ডের আলোচনা। আরণ্যক কর্মকাণ্ড থেকে জ্ঞানকাণ্ডের দিকে যাত্রাপথ।
বেদাঙ্গ, পুরাণ, তন্ত্র এগুলি কী? বেদ এর সাথে এগুলির সম্পর্কই বা কী?
বৈদিক সাহিত্যকে বিভিন্ন দিক থেকে আলোচনার আকর বেদাঙ্গ সাহিত্য। বেদ পঠন পাঠনের অঙ্গ বেদাঙ্গর ছটি শাখা। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ এবং জ্যোতিষ।
শিক্ষা বৈদিক সাহিত্যের উচ্চারণ নিয়ে আলোচনা করে। এটি আজকের ভাষাতত্ত্বের শাখা ধ্বনিতত্ত্ব বা ফোনেটিকস এর মতো।
কল্প আলোচনা করে যাগযজ্ঞপ্রণালী ও জীবন যাপনের বর্ণনা নিয়ে। তিন ধরনের কল্পসূত্র আছে। ১) শ্রৌত সূত্র ২) গৃহ্যসূত্র ৩) ধর্মসূত্র।
ব্যাকরণ আলোচনা করে বেদের ভাষা নিয়ে। পাণিনির গ্রন্থে প্রাচীন বৈয়াকরণদের সম্পর্কে আলোচনা আছে। পৃথিবীর মধ্যে ভারতেই ব্যাকরণ চর্চা প্রথম শুরু হয় বেদের ভাষাকে কেন্দ্র করে এবং তা সর্বোচ্চ মানে পৌঁছয় পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’তে। পাণিনির পরে কাত্যায়ন, ভর্তিহরি সহ অনেকেই ব্যাকরণ চর্চায় বিশিষ্ট অবদান রাখেন। ভারতীয় ব্যাকরণ চর্চার ইতিহাস নিয়ে পরে স্বতন্ত্র বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে রইলো।
নিরুক্ত আলোচনা ও বিশ্লেষণ করে বৈদিক শব্দের অর্থ নিয়ে। প্রাচীনতম বৈদিক শব্দকোষ হল নিঘন্টু। এই নিঘন্টুর ভাষ্য লেখেন যাষ্ক। একেই বিশ্বের প্রথম অভিধান হিসেবে অনেকে গণ্য করতে চান।
ছন্দ আলোচনা করেছে বৈদিক সাহিত্যের ছন্দ নিয়ে। বৈদিক সাহিত্যের প্রধান সাতটি ছন্দ হল গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুভ, বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুভ, জগতী।
জ্যোতিষে রয়েছে বছর, মাস, দিন সহ সময়ের বিভাগ ও গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান নিয়ে আলোচনা। আজকের জ্যোতিষশাস্ত্রের পাথর তাবিজ কবজের সাথে বেদাঙ্গর জ্যোতিষকে মিলিয়ে না ফেলাই ভালো।
বৈদিক দর্শনের ছটি ধারা। সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা বা বেদান্ত। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যেই এই ধারাগুলি পাশাপাশি বিকশিত হয়েছিল। এর পর জৈন, বৌদ্ধর মত অবৈদিক দর্শনের ধারাগুলি জনপ্রিয় হয়। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন জৈন বা বৌদ্ধ দর্শনের আগেই বিকশিত হয়ে থাকবে, যদিও তার কোনও পূর্ণাঙ্গ টেক্সট একালের হাতে এসে পৌঁছয় নি।
বৈদিক সাহিত্য ও ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যর (যার প্রথম উল্লেখযোগ্য রচনা প্রথম শতাব্দীতে লেখা অশ্বঘোষ এর বুদ্ধচরিত) মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মহাকাব্যের যুগ। এই যুগেই রচিত হয়েছিল রামায়ণ ও মহাভারত। সাল তারিখ সংক্রান্ত বিতর্ক মাথায় রেখেও বলা যায় সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় দশকের মধ্যে মহাকাব্যদুটি কয়েকটি স্তরে নির্মিত হয়। তবে যে ঘটনাকালের কথা আছে তা নিঃসন্দেহে এর বেশ কয়েক শতাব্দী আগের।
বৈদিক সাহিত্যের কাল শেষ হবার প্রায় হাজার বছর পরে গুপ্তযুগে বেশীরভাগ পুরাণগুলি রচিত হয়েছিল। তবে কোনও কোনও পুরাণ খ্রীষ্টপূর্ব কালেও রচিত হয় বলে অনেকে মনে করেন। প্রধান আঠারোটি পুরাণের মধ্যে আছে ১) ব্রহ্ম ২) পদ্ম ৩) বিষ্ণু ৪) শিব ৫) ভাগবত ৬) নারদীয় ৭) মার্কণ্ডেয় ৮) অগ্নি ৯) ভবিষ্য ১০) ব্রহ্মবৈবর্ত ১১) লিঙ্গ ১২) বরাহ ১৩) স্কন্দ ১৪) বামন ১৫) কুর্ম ১৬) মৎস ১৭) গরুড় ১৮) ব্রহ্মাণ্ড। যে সমস্ত পুরাণ বিষ্ণুকে মহিমান্বিত করে সেগুলিকে সাত্ত্বিক পুরাণ, যেগুলি ব্রহ্মাকে মহিমাণ্বিত করে সেগুলিকে রাজস পুরাণ, যেগুলি শিবকে মহিমাণ্বিত করে সেগুলিকে তামস পুরাণ বলে।
গুপ্তযুগের শেষ দিক বা পঞ্চম শতাব্দী থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মসাহিত্যগুলি আত্মপ্রকাশ করতে আরম্ভ করে। সাধারণভাবে এগুলি তন্ত্রসাহিত্য নামে পরিচিত। তবে সুনির্দিষ্টভাবে শাক্তদের ধর্মসাহিত্যকেই বলা হয় তন্ত্র। শৈবদের ধর্মসাহিত্য আগম ও নিগম নামে এবং বৈষ্ণবদের ধর্মসাহিত্য সংহিতা নামে পরিচিত।
বিস্তারিতভাবে জানার জন্য বাংলা ভাষায় উপলব্ধ এমন কিছু বইপত্র