বিতর্কঃ সাহিত্যে অশ্লীলতার প্রয়োগ, লিখেছেন – রত্নদীপা দে ঘোষ
অশ্লীলতা – আ ফাকিং টার্ম
যা শালীন নয় তাই অশ্লীল। যা কিছু সুস্থরুচির বিপরীতপন্থী, সমাজে সেটাই অশ্লীল নামে পরিচিত।
সাহিত্যে শালীন অশালীন চিত্রকল্পনা নিয়ে বিরোধ চিরকালীন। কেউ মনে করেন, যা অশ্লীল তা কখনো মহাকাল-উত্তীর্ণ হতে পারে না। আজ অবধি যা কিছু মহৎ সাহিত্য তৈরি হয়েছে তা সবই শুদ্ধ, মার্জিত এবং সভ্য। শ্লীলসাহিত্যই একমাত্র উত্তীর্ণ হতে পেরেছে লোকালয়ের দিন-অবসানে।
সমাজ মনে করে লেখকের চারিত্রবোধ তাঁর লেখনীতে, সাহিত্যকর্মে ফুটে উঠবে। কোন লেখক যদি সাহিত্যের প্রয়োজনেও কোনো নিম্নবর্গীয় শব্দ লেখেন, তাহলে সেই লেখনী, লেখকের চারিত্রিক অবমাননার সাক্ষ্য দেবে , এমনকি পাঠকের চোখে তাঁর শ্রদ্ধা-আসনখানি টলে যাবে। অর্থাৎ লেখককে শব্দ ব্যবহার করতে খুব বুঝে শুনে, দ্বিতীয়বার এমনকি তৃতীয়বার চিন্তা করেই … তবেই তাঁর সাহিত্যকীর্তি হবে অমর।
লেখক কে … এই প্রশ্নটার উত্তর আগে খুঁজে নেওয়া যায়। লেখক কবি অথবা সাহিত্যিক … এরা কিন্তু আসলে এক এক জন অভিনেতা। মঞ্চে এঁরা অভিনয় করেন না ঠিকই কিন্তু কিন্তু এঁদের অভিনয়ের দাপট আমরা শুনতে পাই কাগজেকলমে। এরা যখন কবিতা লেখেন, তখন কবিতার ডুবসাঁতারে একজন ফকিরের মতই সাঁতার কাটেন … কবিতার লহরে আমরা তার ফকিরপনাটুকুই দেখতে চাই …বেলেল্লাপনাগুলি নয়। লেখেলেখির সময় এই ফকিরিপনা এবং বেলেল্লাপনা … এই দু’খানা চারিত্রিক পরিধি কিন্তু একজন কবি বা লেখকের নিজস্ব নয় … এই ব্যাপারটাই পাঠকসমাজের মাথায় বা মগজে রাখেন না …
.. একজন উপন্যাসিক যখন উপন্যাস লেখেন তখন তাঁর অজন্র চরিত্র। কখনো মা, কখনো মেয়ে কখনো তিনি ধর্ষক কখনো ধর্মগুরু… তিনি যখন মায়ের চরিত্র, তিনি তখন মায়ের ভাষা। আবার যখন তিনি ধর্ষকের ভূমিকায় তখন তার মুখে ধর্মগুরুর শব্দবিভংগ খুব দৃষ্টিকটু এবং অশোভন এবং জলদি-পতনের স্বাক্ষর বহন করবে… এতে কারোর কোনো সন্দেহ থাকার তো কথা নয় … একজন ধর্ষক কীভাবে সোনার-তরীর কণ্ঠে কইতে পারে… পাঠক কি একটু ভেবে দেখবেন?
আমাদের জানানো হয়েছে, যা অশোভন তাই অশ্লীল … ভ্রান্ত এই বোধটি আমাদের মেধায় খুব ভালো করে ঢুকিয়ে দেওা হয় শিশু-কিশোর কাল থেকেই। অথচ সাহিত্যের প্রয়োজনে, অভিনয়ের প্রয়োজনে, ছবিআঁকার প্রয়োজনে যে কোনো শব্দ, শব্দের তুলি-মোমকে কিন্তু সাহিত্যকর্মীদের কবচ করতেই হবে, হওয়া উচিত। সমাজ কেন একজন তুলির ওপরে, একজন কলমের ওপরে ছড়ি ঘোরাবে?
ফুলগাছে এসে একটি মউমাছি এসে বসলো … ব্যস এইটুকু দিয়েই… পাঠকদের বুঝে নিতে হবে যে এই কবিতার চতুর্থ পংক্তিতে এইমাত্র একটি চুম্বন উৎপন্ন হল … এ হাস্যরসের দ্রাঘিমা আর কতদিন চলবে বোকাচোদার দল? .. হাগুনতির লাজ নাই… দেখুন্তির লাজ … এর চাইতে চরম হাস্যকর আর কি হতে পারে … কবে আমরা চারাগাছ থেকে বৃক্ষ হবো … কবে আর সাহিত্যে নাইতে নাইতে অতলের রসাতলে যাবো … তার চাইতে ঠোঁটে এসে বসুক ঠোঁট, বুকের ভেতর বুক, গৃহস্থ পুষ্ট হোক, ঘরে তার খুকি-খোকা হোক …
এ বার প্রশ্ন হচ্ছে কোন শব্দ শ্লীল কোনটি অশ্লীল তা ঠিক করবে কে বা কাহারা? এই মাদার-ফাকার সোসাইটি করবে ঠিক? গাঁড়ে দম আছে? যে সমাজে মেয়েরা ধর্ষিতা হচ্ছে, লাগাতার হয়েই চলেছে… হচ্ছে… অ্যাসিড অ্যাটাক রাহাজানি, খুন … আমি গাঁড় মারতে চাইছি সেই সমাজের অথচ পারছি না … এই অবস্থায়, এই মনন নিয়ে একজন লেখক কি শুধু মৃদুমন্দ বাতাসের পলাশফলন আর তার ঘ্রাণগন্ধ লিখতে পারেন না তার লেখা উচিত … লিখবেন তিনি নিশ্চয়ই লিখবেন, মরীচিকার গলন নিয়ে লিখবেন। কিন্তু আমাদের স্খলনের বিচিত্রবীর্য নিয়ে কি তিনি চুপ থাকতে পারেন? তিনি কি প্রতিবাদ করবেন না?
করলেও তা কোন ভাষায়? আশ্চর্য প্রশ্ন তো … ভাষা তো ভাষাই… ভাষার আর কোন দ্বিতীয় মা-বাপ নাইতো। যেখানে যেমন নৌকো সেখানে তেমন জল। যেমন যেমন জল সেখানে তেমন দাঁড়… টেনে নেওয়াটি আসল নোয়া একজন সাহিত্যকর্মীর আসল দোলনা… সৎ পাঠক কি এইরকম সৎ এবং প্রখর সাহিত্যে কি ডুব দিতে পছন্দ করবেন না?
জাস্ট আগুন-আগুন বীরবিক্রম হোক, দো-নলা বিচিদার হোক সেই আগুন। খেয়াল রাখতে হবে সেই আগুন যেন তিষি প্রজাতি না হয়, তাকে হতে হবে একদম হাতে-গরম, ঝলসানো ঝালকাঠি। আঙ্গুল যেন সোজাসুজি তাক করা থাকে সমাজের চোখে, তথাকথিত সুশীলসমাজের যোনি ভেদ করতে পারে এমনভাবে যাতে সমাজ এবং দর্পণ আয়নায় নিজের মুখ লুকাতে বাধ্য হয় বোরখার অন্তরালে …
সাহিত্যে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ কতখানি সুস্থ এই বিতর্কের শুরুতে আমার প্রথম আপত্তি অশ্লীলতা শব্দটিকে নিয়েই। শব্দ অশ্লীল হবে না, হয় না। শব্দ শক্তিশালী হবে অথবা কম শক্তিশালী অথবা মৃদু শক্তিশালী … সাহিত্যের ধারা অনুযায়ী বা বক্তব্য হিসেবেই একজন লেখককবি অথবা সাহিত্যিক ঠিক করে নেবেন তার ভাষাটির রূপ হবে কেমন। যখন ‘ মা’ অথবা ‘ দেশ’ শব্দটি দিয়ে লেখা হচ্ছে কোন কবিতা অথবা প্রবন্ধ তখন তার শব্দবোধ হবে ভাবের অনুসন্ধান জড়ানো। মণি এবং মানিক্যের আবহে লেখা হবে সেই কবিতার ছান্দসী।
কিন্তু একজন ধর্ষিতার বাক্যবন্ধন হবে তুমুল আলাদা। তার ভেতরে যে আগুন জমানো এবং জারানো থাকবে, লেখা সেই ঢঙেই আসবে। একজন সাহিত্যিক যখন রচনা করবেন কোন শয্যামুখর কাহিনী , তাঁর ভাষা আরও টানটান হবে … টালমাতাল হবে পায়ের তলার হ্রদ, বিছানার কাণ্ডারী। একাধারে শব্দের স্পার্ম এবং ডিম্ব একই দেহ-সঞ্চালনায় সালঙ্কারিত হবে মুহুর্মুহু …
তবে না বোঝা যাবে কৃষ্টি এবং সৃষ্টিতে কার কতখানি দম …
এখন আমরা যদি একজন যৌনকর্মীর মুখে বসিয়ে দিয়ে একজন ধর্মগুরুর ভাষা তাহলে সাহিত্যের দাম কম্বে বই বাড়বে না। সাহিত্য কি তাতে নকল হয়ে পড়বে না? নাকি এই সমাজের মতো সেও বেজন্মা হয়ে পড়বে?
সাহিত্যের ভাষা হোক সৎ, স্বছল। সমৃদ্ধ। সাহিত্য চোখ খুলে দিক মানুষের। বর্তমান সমাজের আলো এবং অন্ধকার দুই-ই লিখুক দ্বিধাহীন। সেক্স লিখুক সেক্সের ভাষায়, চাঁদ লিখুক পূর্ণিমার আলোয়, নদী লিখুক নৃত্যের অন্তরালে। যুদ্ধ লিখুক কামানের গতিপথে …
সমাজে জ্যেঠুমনারা থাকবেই। অতীতে ছিলেন তাঁরা, আছেন আজো। তাঁদের চোখে সবকিছুতেই অশ্লীলতা পোশাকে আশাকে নীতিতে চিত্রকল্পে, ছবিকল্পে সব কিছুতেই তাঁদের দৃষ্টি সজাগ। চোখ তাদের সর্বদাই নাভির নীচে…
তাঁরাই নাকি নির্ধারণ করবে কোনটি সুভদ্র কোনটি অশ্লীল। যুগের পর যুগ ধরে এঁদের বীর্যপাত ধারাবাহিকভাবে হতে থাকবে। রবীন্দ্র-শরৎ-কল্লোল-হাংরি কেউই কিন্তু এদের চোখ এড়াতে পারেনি… সাহিত্যের ভাষায় এইসব জ্যাঠামনাদের আমি ‘গাঁড়মারা পাব্লিক’ বলে আখ্যান করতে পছন্দ করবো।
অশ্লীলতার সীমারেখাও যুগে যুগে পাল্টেছে। গতকাল যা অশ্লীল ছিল আজ তা ‘ ধুসসসস এ কিচ্ছু না, কিছুই অশ্লীল না’ … আবার আজ যা অশ্লীল … আগামী কয়েক বছর পর তার আর কোন উন্মাদনাই থাকবে না। যেমন প্রজাপতি যেমন বিবর .. আজকাল কি আমরা এইসব সাহিত্যকর্মে অশ্লীলতা খুঁজে পাই? পাই না। কিন্তু তৎকালীন সমাজের জ্যেঠুমশাইরা কিন্তু পেয়েছিলেন… তবেই না …
তাঁরা মনে করেন, যে সাহিত্যু জনসমক্ষে পাঠ করা যাবে না তা সাহিত্য নয়। আমি মনে করি সাহিত্য জনসমক্ষে পাঠ করারই নয়। সাহিত্য সম্পূর্ণভাবে একেলা-পৃথিবী। পাঠ করবেন যিনি, পাঠক ও তিনি। সাহিত্য-স্রষ্টার চাইতে বড় সাহিত্য আর কোথায়… তিনি লেখক, তিনি পাঠক আবার তিনি শ্রোতাও। তাঁর হাতে কলমের স্রোত, তাঁর কলমার ভুজঙ্গকে কে দেখাতে পারে ভয়? তাঁর কাছে শব্দমাত্রই ব্রহ্ম। যে কোন শব্দই তড়িৎসম্পন্ন বিদ্যুৎ…
তথাকথিত কোন অশ্লীলশব্দকে যিনি কাল/ সমাজ/ মাইক/ মঞ্চ এবং পুরষ্কারের ভয় না করে সাহিত্যে/ কবিতায় অলঙ্করণে ব্যবহার করতে পারেন দাপটের সঙ্গে … তিনি সর্বাপেক্ষা চেতন-গ্রাহী ধ্রুবক। যিনি একই নিঃশ্বাসে লিখতে পারেন ঝড় এবং ঝড়ের গতিবেগ, যিনি লিখে রাখেন জ্বর এবং জ্বরের পারদসমগ্র, যিনি মায়ের আত্মকথা লেখেন নিবিড়ঘোমটার অন্তঃপুরে , যিনি শ্মশানে আত্মপ্রচার করেন মাটিধুলোর ছেলেখেলায়, যিনি ধর্ষিতা নারীর মুখে বসিয়ে দিতে পারেন … ‘অ্যাই শালা তফাত যা বহেনচোদ বোকাচোদা’
… সেই সাহিত্যকর্মীর সততায় মুগ্ধ না হয়ে পারিনা। চাই, তাঁর ত্রিশূলটি মশালে মশালে হোক আলোড়িত … যে সমাজ এই মশাল নিবিয়ে দিতে চায়, অশ্লীলতার ধুয়ো তুলে বিচারকের আসনে বসে, আমি মনে করি, সেই বিচারের চাইতে অশ্লীল এবং অশোভন আর কিছু হতে পারে না … কলমের বুক এবং ব্রেসিয়ার যারা রুদ্ধ করতে চায় জেহাদ তাদের বিরুদ্ধে জারি… থাকুক আমৃত্যু…
‘ অ্যাই রাজা তুই ন্যাংটো, তোকে চুদবো’ … মানহারা রমণীর মুখে এই শব্দমানিক্যগুলি শুনবো বলে বেঁচে থাকতে চাই এই পামর-সভ্য সাহিত্যসভায় …
বিতর্কঃ সাহিত্যে অশ্লীলতার প্রয়োগ
(লেখাটি অর্বাচীন, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা। জুন-২০১৮ তে প্রকাশিত হয়েছিল। আরো বেশি পাঠকের কাছে এই বিতর্ক পৌঁছে দেওয়ার জন্য অর্বাচীন পত্রিকার সম্পাদকের অনুমতিতে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।)
মুখ্য সম্পাদক
(টেকটাচ টক)