পুরুলিয়া জেলার জন্মদিনে বিশেষ রচনা :

ভাষা আন্দোলন : মানভূম
(এক গৌরবজনক ইতিহাস সমৃদ্ধ পুরুলিয়া। এখানকার ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস আছে তা ভারতের আর কোথাও নেই! পুরুলিয়া বা মানভূমের ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেকেই জানেন কিন্তু না জানা মানুষই বেশী। পৃথিবীর সকল ভাষা শহিদদের প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু করলাম এই লেখা। পাঠক,প্রিয় পাঠক, যদি আপনারা লেখাটি পড়ে কোথাও কোন অসঙ্গতি খুঁজে পান তবে অবশ্যই জানাবেন।)

(বঙ্গভুক্তি দাবিতে পাকবিড়রা থেকে কোলকাতা পদযাত্রার ছবি। ছবিটি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
১.
” তাড়িত দুঃখের মতো চতুর্দিকে স্মৃতির মিছিল
রক্তাক্ত বন্ধুদের মুখ,উত্তেজিত হাতের টঙ্কারে
তীরের,ফলার মতো
নিক্ষিপ্ত ভাষার চিৎকার :
বাংলা বাংলা —
কে নিদ্রামগ্ন আমার মায়ের নাম উচ্চারণ করো? ”
আল মাহমুদ : নিদ্রিতা মায়ের নাম( সংক্ষেপিত)
ভাষা একটা মাধ্যম। বহুমুখী একটি মাধ্যম। ভাষার জন্ম হয়,মৃত্যু হয়।বিয়ে হয়,পরকীয়া হয় মাতৃত্ব হয়।সংসার,পরিবার,ঘর, কখনো সখনো বেঘরও হয়।এই পৃথিবীর নানা দিকে নানান মানুষ। তাদের প্রকৃতি-পরিবেশ-পরিস্থিতি, সেই মানুষদের শারীরিক গড়ন,রঙ,বেশভূষা,যাপন ও মুখের ভাষা ঠিক করে অনেকাংশেই।
বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দেবনারায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন বলছিলেন,এক আলোচনা সভায়, তিনি কোলকাতার মানুষ। বাঁকুড়ায় তাঁর থাকার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলেন তিনি। সেই প্রথম এসেছেন বাঁকুড়ায়।বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে। তো, একদিন তাঁর এক করণিক বললেন, ” স্যার, আমি বইগুলি বাগিয়ে নি সব।” উনি বললেন –আমি তো শুনে থ! ‘বাগিয়ে নেওয়া’ মানে তো আমরা জানি “হাতিয়ে নেওয়া” বা ” সরিয়ে নেওয়া ” বা ” নিয়ে নেওয়া “।বাঁকুড়ায় এই বাগিয়ে নেওয়ার অর্থ যে “গুছিয়ে ঠিক করে রাখা ” তা তিনি জেনেছেন অনেক পরে।আমরা শুনে হাসলাম। ভাবলাম শুধু এই রাঢ় বাংলাতেই ভাষার কত কত রকমফের! তাহলে পৃথিবীতে আরো কত কত ভাবুন! কিন্তু সকলেরই তাঁর মাতৃভাষা নিয়ে গৌরব আছে, থাকবেই। তাকে রক্ষা করা,লালন করা সকলেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত। দীর্ঘ আন্দোলনের পর এই তো কদিন আগে পুরুলিয়াতে কুড়মালি ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হলো। সে যাই হোক, সকল ভাষার মিল অমিলের মধ্যেও তো একটি অন্তঃসলিলা যোগাযোগ তো আছেই। তবুও একদিন ভাষা নিয়ে দাঙ্গা হয়,তা কি ধর্মীয় দাঙ্গা থেকে কিছু আলাদা! একদল মানুষের কাজ হল লড়াই লাগানো।
ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে একটা গল্প আছে।গল্পটি টাওয়ার অফ ব্যাবেল নামেই বেশি পরিচিত। গল্পটি একটু বদলে নিলে তা মোটামুটি এরকম :
ঈশ্বর একদিন মানুষ সৃষ্টি করলেন। তাদের সকলের মুখের ভাষা ছিল এক। তারা সব সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তিতে বাস করতে করতে একদিন ঠিক করলো তারা সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের কাছে যাবে।তিনি যে আকাশপারের স্বর্গে থাকেন সেখানে যাবে তারা। তাই তারা শুরু করলো এক সুউচ্চ টাওয়ার তৈরির কাজ। দিনে দিনে তা উচুঁ হতে থাকে। ঈশ্বর স্বর্গে বসে দেখলেন,তাই তো এরা তো সকলে মিলে এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবে। ব্যাস!শুরু হলো সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের চক্রান্ত। তিনি মানুষদের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করার জন্য,তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য, দিলেন সেই মানুষদের ভাষা আলাদা আলাদা করে।ফলে দেখা গেল এক চরম ব্যবেল, বিশৃঙ্খলা।মানুষেরা সব জানতেও পারলো না কি হলো? কেউ কারো কথা আর বুঝতে পারলো না। ফলে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে যে টাওয়ার তৈরির কাজ করছিল তা ভেঙে পড়ল,সম্পূর্ণ হলো না।ঈশ্বর দুশ্চিন্তা মুক্ত হলেন।তার আর ক্ষমতা হারাবার ভয় থাকলো না।মানুষেরা আর কেউ সশরীরে তার কাছে আসতে পারবে না। আর সেই সব বিভিন্ন ভাষার মানুষরা ছড়িয়ে পড়লেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। ঈশ্বর হলেন এখানে সার্বভৌম শক্তির প্রতীক। সাধারণ মানুষ যখনই জোটবদ্ধ হয় তাদের সেই জোট ভেঙে ফেলার ইতিহাস যে কত প্রাচীন তার স্মরণেই এই গল্পের অবতারণা।
২.
পাঠক মনে করুন,১৯০৫- এর উত্তাল বাংলার কথা। বিপ্লববাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। অবিভক্ত বাংলাদেশ জুড়ে সংহত হচ্ছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। ভারতের অন্য প্রদেশে তখনো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। যত ঝামেলা সব বাংলা প্রদেশে। তাই ব্রিটিশ সরকার ঠিক করলেন এই বাংলাভাষী মানুষদের আলাদা করতে হবে।তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, ভাঙো , বাংলাকে ভাঙো।ওদের ভাষা, ওদের সংস্কৃতিকে ভাঙার পণ নিয়ে লর্ড কার্জন সাহেবের ফরমান জারি হলো (১৯০৫ এর ১৯ জুলাই), বাঙলাকে ভাঙো। ভেঙে নতুন একটি প্রদেশ গঠিত হবে।যার নাম হবে পূর্ববঙ্গ ও আসাম। এর মধ্যে থাকবে ঢাকা,রাজশাহী, চট্টগ্রাম, মালদহ,পার্বত্য ত্রিপুরা ও আসাম।যার রাজধানী হবে ঢাকা। অবশিষ্ট বাংলা,বিহার, উড়িষ্যাকে নিয়ে বাংলা প্রদেশ গঠিত হবে যার রাজধানী হবে কোলকাতা।১৯০৫, ১৬ অক্টোবর এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে স্থির হয়। কার্জনের ” partition of Bengal is Settle fact ” কে unsettle করার জন্য রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ, কবিগুরু সহ সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসন্তোষ।বাঙলার শিক্ষিত মানুষজন দলেদলে আন্দোলনে যোগদান করেন। জাতীয়স্তরে ছড়িয়ে পড়ে সেই আন্দোলন।সরকার সাবধান ও সচেতন হয়ে সরকার বিরোধী, শাসক বিরোধী এই জনবিক্ষোভকে প্রশমন করার চেষ্টা করেন। প্রায় ছয় বছর পর ১২ ডিসেম্বর, ১৯১১, দিল্লির দরবার উৎসবে রাজা পঞ্চম জর্জ সরকারের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
♦বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করা হয়।
( এ কি রকম রদ? শুধু আন্দোলন বন্ধ করার একটি কৌশল, দৃষ্টি ঘোরানোর, ভাষা বদলের একটি কায়দা নয় কি? )
♦রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লিতে চলে যাবে। ( নিরাপদে থাকার জন্য।আন্দোলন,ডেপুটেশন, বিদ্রোহ, অন্তর্ঘাত এসব এড়ানো যাবে। বাঙলা ও বাঙালীজাতির থেকে দূরে থাকা যাবে।)
♦বাঙলাদেশকে আবার দুভাগ করে দুটি রাজ্য হবে। ( তাহলে রদ আর কি হলো?) তার একটি রাজ্য বাঙলাদেশ (পূর্ববঙ্গ সহ), রাজধানী কোলকাতা। অপরটির নাম হবে বিহার- উড়িষ্যা,রাজধানী হবে পাটনা।
♦♦ দরবারি ঐ ঘোষনায় মানভূম জেলাকে
বিহার – উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করা হয়।তৎকালীন মানভূম,বর্তমান পুরুলিয়া জেলার মানুষদের কাছে এই সিদ্ধান্তটি মেনে নেওয়া ছিল খুবই কষ্টকর।
১ এপ্রিল,১৯১২ থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়।মানভূমবাসীদের সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যার ইতিহাস,অর্থনীতি,রাজনীতির যোগ তো কোনকালেই তেমন ছিল না।মানভূমের সঙ্গে তো বরাবর বাংলাদেশের যোগাযোগই বেশি। আগেও ছিল এখনো আছে।শুধু মানভূম নয় সূবর্ণরেখা নদী পেরিয়ে রাঁচি এমনকি টাটা বা জামশেদপুর পর্যন্ত এক বিরাট এলাকার মানুষ ছিলেন বাংলাভাষী।অনেকেই এই এলাকাকে ‘গ্রেটার বেঙ্গল’ বলার পক্ষপাতী। তাসত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার বাংলাভাষায় কথা বলা এই বিরাট এলাকাকে ঠেলে দিল বিহার-উড়িষ্যা রাজ্যে বা প্রদেশে। কোন যুক্তির তারা ধার ধারেন নি। সেই বিভেদের কৌশলে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করা ছাড়া তারা তো আর কিছু চান নি।
৩.
অনেকে মনে করেন মানভূমবাসীদের প্রতি ব্রিটিশ সরকার ক্রোধ ও প্রতিহিংসাবশত এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।১৭৬৫, ১২ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোম্পানি দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার,উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করার পরেই,জমির উপর সার্বিক কতৃত্ব স্থাপন ও চড়াহারে খাজনা আদায় করার জন্য জমি জরিপ করে এই ভূখন্ডকে নানা সময়ে নানান প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিভাজন করে। পুরুলিয়া জেলার উত্তরদিকে,কোম্পানি আমলের প্রথম জেলা হল পাঁচেট।পঞ্চকোট রাজ্যকেই পাঁচেট জেলা নাম দিয়ে তার জেলা সদর করা হয় রঘুনাথপুরে।(১৭৭৩,১৯ জানুয়ারি) প্রথম কালেক্টার নিয়োজিত হন মিঃ এস জি হল্লি। মাত্র সাত বছরে কোম্পানি খাজনা বাড়াতে বাড়াতে প্রায় দ্বিগুণ করে তোলে।এক হিসেব থেকে জানা যায়,১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি নির্ধারিত খাজনা ছিল ( টাকার হিসেবে) ৩০,০০০/ তা ১৭৮৩ তে করা হয় ৭৫,৫৩২/ যা প্রায় দ্বিগুণের বেশী, পরে তা কমিয়ে করা হয় ৫৫,৭৯৪/ টাকা।
সকলেই জানেন সেসময়কার জমিদাররা নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে খাজনা দিতে না পারলে জমিদারি নিলামে তোলা হত।১৭৯৮,৯ জুলাই পাঁচেট জেলার লধুড়কা,চৌরাশী,চেলিয়ামা,ছড়রা,লাগদা,মহিসারা,শেরগড় প্রভৃতি পরগনা নিলাম হয়ে যায়। রঘুনাথপুর আদালতে যারা জমিদারিগুলি নিলামে কিনেছিলেন তারা প্রায় সকলেই ছিলেন কোলকাতার বাসিন্দা। পঞ্চকোট রাজার প্রজারা বিদ্রোহ করলেন। তারা বললেন, পঞ্চকোট রাজা ছাড়া আর কাউকে তারা রাজা হিসাবে মানবেন না, অন্য কারোর অধীনে থাকবেন না। ফলে নিলামে কেনা জমিদারি কেউ দখল নিতে পারলেন না।এরফলে কোম্পানি নিলাম রদ করে পঞ্চকোটের রাজাকে পুনরায় তার জমিদারি ফিরিয়ে দেন কিন্তু সেরগড় পরগনার ১৮ টি মৌজা আর ফিরে এল না।
প্রজাদের বিদ্রোহের কাছে ক্ষমতাধর কোম্পানিকে এখানে পিছনে হাঁটতে হয়েছিল।
জেলার দক্ষিণ দিকে জঙ্গলময়,পাহাড়ঘেরা,দুর্গম। কোম্পানি এই এলাকায় পৌঁছে যায় ১৭৬৭ নাগাদ।খাজনা নির্ধারণের সময় থেকে এই অংশের প্রজাদের সঙ্গে শুরু হয় কোম্পানির লড়াই। এ লড়াইয়ের ইতিহাস প্রায় পঁয়ষট্টি বছরের।১৭৬৭-১৮৩২। ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী ও ঐতিহাসিকরা এদিককার স্বাধীনচেতা সাধারণ অন্তজ মানুষদের এ লড়াইকে নাম দিলেন ” চুয়াড়” বিদ্রোহ বলে। দেশীয় ইতিহাসবিদরাও সেই নামই মেনে নিলেন বিনা বাক্যব্যয়ে। প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলন ছিল সাধারণ অন্তজশ্রেণির আন্দোলন। ১৮৩২ এ “গঙ্গানারায়ণ সিংহ-র হাঙ্গামা” এই অঞ্চলে এক ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল। ১৮৫৫ তে সাঁওতাল বিদ্রোহের আগুন অল্প পরিমাণে হলেও মানভূমে লেগেছিল।এই আন্দোলনের প্রথম ইতিহাসকার দিগম্বর চক্রবর্তী। তাঁর পিতা পঞ্চানন চক্রবর্তী মানভূম থেকে পাঁকুড়ে গিয়েছিলেন। পাঁকুড়ের রানী ক্ষেমাসুন্দরী দেবী দিগম্বর বাবুর বোন। ( অরুণ চৌধুরীর প্রবন্ধ – ” দিগম্বর চক্রবর্তী “, দেশহিতৈষী ১৬ জুলাই,১৯৯৯) ১৮৫৭তে পুরুলিয়া তথা মানভূম জেলায় সিপাহীবিদ্রোহের প্রভাবও ছিল। যার ফলস্বরূপ পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিং কে দশমাস ব্রিটিশ কারাগারে কাটাতে হয়।কেউ কেউ বলেন তাকে অন্তরিন রাখা হয়েছিল। এখানে আদিবাসী সাঁওতালরা সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের রাজার মদতেই।
অতএব দেখা যাচ্ছে ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে প্রবেশের সময় থেকেই এক প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন।এই বাংলাদেশে আর কোনও রাজা বা জমিদার বন্দি হন নি। মানভূমবাসীর এই বিরোধিতার প্রতিশোধ ব্রিটিশরা নিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে তাদের চিরতরে নির্বাসিত করেছিল, বিহার- উড়িষ্যা প্রদেশে অন্তর্ভু
ক্ত করে।
৪.
১৯১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে মানভূমের এই আন্দোলন চলেছিল ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর অব্দি।সারাদেশ যখন স্বাধীনতার সুখ আস্বাদন করছে, তখন পুরুলিয়া জেলাব্যাপী সূচনা হচ্ছে আরেক লড়াই,কষ্টের,বঞ্চনার প্রতিবাদে আন্দোলনের প্রস্তুতি।
এই জেলার প্রশাসনিক এলাকাকে এতবার পরিবর্তন করা হয়েছে তা এক রেকর্ড বলা যেতে পারে।
প্রথম জেলা হল পাঁচেট ১৭৭৩ সদর – রঘুনাথপুর
দ্বিতীয় জেলা হল জঙ্গল মহল ১৮০৫ সদর- বাঁকুড়া
তৃতীয় ও শেষবার করা হল, জেলা মানভূম ১৮৩৩ সদর- মানবাজার
কোম্পানি এই এলাকায় বারবার প্রতিরোধ আন্দোলনের সম্মুখীন হওয়ার ফলে বারেবারে জেলাকে,জেলার প্রশাসনিক ক্ষেত্রকে বিভাজন করেছে।১৮৪৫,১৮৪৬, ১৮৭১,১৮৭৯ তে এসে মানভূম জেলার আয়তন হয় ৪১১২ বর্গমাইল। মানভূম জেলা তৈরির সময় এর আয়তন ছিল ৭৮৯৬ বর্গ মাইল। সাঁওতাল ও সিপাহী বিদ্রোহের পনের বছরের মধ্যেই আয়তন প্রায় অর্ধেক কমে যায়। মানভূমের সংগ্রামী মানসিকতা ও রাজার প্রতি প্রজাদের আনুগত্য চিরকাল তাদের ব্রিটিশ বিদ্বেষী করে রেখেছিল।
১৯৩৬ এ যখন রাজ্য পুনর্গঠন হয়। আলাদা উড়িষ্যা রাজ্য গঠিত হয় তখন মানভূমবাসীরা ভেবেছিলেন তাঁদের এবার হয়ত বঙ্গভুক্ত করা হবে। কিন্তু তা না করে তাদের বিহার রাজ্যের মধ্যেই রাখা হয়।এবারেও হল না। এবার তারা লড়লেন জানপ্রাণ লড়িয়ে স্বাধীনতার লড়াই। এল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা কিন্তু বঙ্গভুক্তি হল না। হওয়ার কোন লক্ষণও দেখা গেল না। যার পরিণতিতে ১৯৪৮ থেকে আবার শুরু হল এক ঐতিহাসিক লড়াই। এ লড়াই মানভূমের ভাষার জন্য,নিজেদের কৃষ্টির জন্য,বঙ্গভুক্তির জন্য। যার সমাপ্তি হয় ১৯৫৬ র ১ নভেম্বর। কিন্তু মানভূম জেলার ধানবাদ মহকুমার লক্ষ লক্ষ বাঙালীর প্রাণের ভাষা হারিয়ে গেল চিরতরে। বিহার সরকারের মাত্রাতিরিক্ত হিন্দিপ্রেমের জন্য।
সারা ভারতে মানভূমবাসীরাই প্রথম নিজেদের ভাষার জন্য, নিজেদের ভূখন্ডের দাবীতে অহিংস আন্দোলনে সামিল হন।
৫.
মানভূম জেলাকে বিহার-উড়িষ্যায় সংযুক্তির বিরুদ্ধে প্রথমদিন থেকেই মানভূমে বিক্ষোভ হয়েছিল। কোলকাতা থেকে পুরুলিয়া শহরের দূরত্ব রেলপথে ৩২৬ কিমি, অপরদিকে পাটনার দূরত্ব ছিল ৩৮০ কিমি ( সূত্র : গুগল)। এই দূরত্ব শতবর্ষ আগে অতিক্রম করা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। প্রত্যন্ত বাংলাভাষী এই এলাকাটি কেন বাংলাদেশে বা স্বভূমে থাকতে পারবে না?সেকথা জানতে চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি দেওয়া হয়,আন্দোলনও হয়।এই আন্দোলনের নেতৃত্বদান করেন পুরুলিয়া আদালতের আইনজীবী রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন প্রমুখ।তাঁদের সহায়তা করেন কলিয়ারি মালিক,ব্যবসায়ী ও কয়েকজন জমিদার। সরকার এর পরিপ্রেক্ষিতে বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশের গভর্ণরকে এবিষয়ে রিপোর্ট দিতে বলেন।
মানভূমের বিশিষ্ট গবেষক সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, ” বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা উপলব্ধি করতে পারেন নি যে মানভূম ও ধলভূমের বাংলা ভাষাভাষী এক বৃহৎ অংশকে বিহার- উড়িষ্যা রাজ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে,সে অঞ্চলগুলি প্রাচীন কাল থেকেই বঙ্গদেশেরই অংশ হিসাবে গণ্য হয়ে এসেছে। ” আবুল ফজলের “আইন- ই-আকবরী” গ্রন্থেও দেখা যায় সে সময় সুবা বাংলা যে ১৯ টি সরকারে বিভক্ত ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল মান্দারন। ধলভূম ও মানভূম ছিল মান্দারন সরকারের অন্তর্ভূক্ত।
১৯১২ থেকেই মানভূমবাসী বিহার- উড়িষ্যা প্রদেশে সংযুক্তির প্রতিবাদে আবেদন- নিবেদনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছেন।তারা ব্রিটিশ সরকারকে আবেদনে জানালেন, মানভূমের ভৌগোলিক ও জাতিগত অবস্থান, ইতিহাস,ভাষা, আইনকানুন, জমি ও শাসনবিধি,বিচারের সাধারণ নিয়মকানুন প্রচলিত আইন সবকিছুই তাদের বাংলাদেশের মতো, তবে কেন তাদের বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে! তাঁরা ভারত সরকারকে জানান, তাঁরা বাংলাদেশের মধ্যেই থাকতে চান। তাঁরা এও বলেন, বিহারিদের কাছে তারা কোনদিন মর্যাদা পাবেন না এমন কি আইনসভায় নিজেদের প্রতিনিধি ঠিকঠাক পাঠাতে পারবেন না। ব্রিটিশ সরকার এই সব যুক্তি মানেন নি। বিহার ও উড়িষ্য প্রদেশের প্রধান সেক্রেটারি যে রিপোর্ট দিলেন, তাতে বলা হল, ওসব ভীতি অমূলক। দিল্লী দরবারে ভারতের বড়লাট আনুষ্ঠানিক ভাবে যে ঘোষণা করেছেন তাকে বানচাল করা হলে জনগনের মধ্যে সরকারের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দেবে। তিনি মন্তব্য করেন, “It seems very desirable from all points of view that further agitation on the subject should be discourage ”
প্রথমদিকের এই আবেদন-নিবেদনের পরিণতি দাঁড়ায় এই। এর কারণ কি? বিভিন্ন গবেষকগণের মত থেকে বলতে পারি,
১/ এরকম একটি বিষয় নিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা।
২/ সেই সময় সর্বজনগ্রাহ্য নেতৃত্বর অনুপস্থিতি।
৩/ বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে তাদের বোঝানোর ব্যর্থতা।
৪/ আবেদন- নিবেদন পদ্ধতির উপর আস্থা রাখা।
৫/ পুরুলিয়া কোর্টের কয়েকজনমাত্র আইনজীবী এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। তাঁরা, তাঁদের পেশাগত কারণেই সেইসময় প্রবল ব্রিটিশ বিরোধীতা করতে পারেন নি।
৬/ বিষয়টি নিয়ে সারা বাংলাদেশে জনমত ও আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারা।
৭/ বাংলা দেশ প্রদেশের নেতৃবৃন্দ সে সময় বঙ্গভঙ্গ রদ করতে পেরেছেন এই সাফল্যটি বড়ো করে দেখাতে চেয়ে মানভূমের বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশের অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি সেভাবে প্রচার ও প্রতিবাদ করেন নি।
৮/ নিজেদের স্বতন্ত্র কোন সংগঠন না থাকা।

(মানভূম ভাষা আন্দোলনের ছবি, ফেসবুক সূত্রে সংগৃহীত)