• Uncategorized
  • 0

পুরুলিয়া জেলার জন্মদিনে বিশেষ রচনা :

ভাষা আন্দোলন : মানভূম

(এক গৌরবজনক ইতিহাস সমৃদ্ধ পুরুলিয়া। এখানকার ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস আছে তা ভারতের আর কোথাও নেই! পুরুলিয়া বা মানভূমের ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেকেই জানেন কিন্তু না জানা মানুষই  বেশী। পৃথিবীর সকল ভাষা শহিদদের প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু করলাম এই লেখা। পাঠক,প্রিয় পাঠক, যদি আপনারা লেখাটি পড়ে কোথাও কোন অসঙ্গতি খুঁজে পান তবে অবশ্যই জানাবেন।)

(বঙ্গভুক্তি দাবিতে পাকবিড়রা থেকে কোলকাতা পদযাত্রার ছবি। ছবিটি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

১.

”  তাড়িত দুঃখের মতো চতুর্দিকে স্মৃতির মিছিল
রক্তাক্ত  বন্ধুদের মুখ,উত্তেজিত হাতের টঙ্কারে
তীরের,ফলার মতো
নিক্ষিপ্ত ভাষার চিৎকার :
বাংলা বাংলা —
কে নিদ্রামগ্ন আমার মায়ের নাম উচ্চারণ করো? ”
আল মাহমুদ : নিদ্রিতা মায়ের নাম( সংক্ষেপিত)
ভাষা একটা মাধ্যম। বহুমুখী একটি মাধ্যম। ভাষার জন্ম হয়,মৃত্যু হয়।বিয়ে হয়,পরকীয়া হয় মাতৃত্ব হয়।সংসার,পরিবার,ঘর, কখনো সখনো বেঘরও হয়।এই পৃথিবীর নানা দিকে নানান মানুষ। তাদের প্রকৃতি-পরিবেশ-পরিস্থিতি, সেই মানুষদের শারীরিক গড়ন,রঙ,বেশভূষা,যাপন ও মুখের ভাষা ঠিক করে অনেকাংশেই।
বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দেবনারায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়  সেদিন বলছিলেন,এক আলোচনা সভায়, তিনি কোলকাতার মানুষ। বাঁকুড়ায় তাঁর থাকার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলেন তিনি। সেই প্রথম এসেছেন বাঁকুড়ায়।বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে। তো, একদিন তাঁর এক করণিক বললেন, ” স্যার, আমি বইগুলি বাগিয়ে নি সব।” উনি বললেন –আমি তো শুনে থ! ‘বাগিয়ে নেওয়া’ মানে তো আমরা জানি “হাতিয়ে নেওয়া” বা ” সরিয়ে নেওয়া ” বা ” নিয়ে নেওয়া “।বাঁকুড়ায় এই বাগিয়ে নেওয়ার অর্থ যে “গুছিয়ে ঠিক করে রাখা ” তা তিনি জেনেছেন অনেক পরে।আমরা শুনে হাসলাম। ভাবলাম শুধু এই রাঢ় বাংলাতেই ভাষার কত কত রকমফের! তাহলে পৃথিবীতে আরো কত কত ভাবুন! কিন্তু সকলেরই তাঁর মাতৃভাষা নিয়ে গৌরব আছে, থাকবেই। তাকে রক্ষা করা,লালন করা সকলেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত। দীর্ঘ আন্দোলনের পর এই তো কদিন আগে পুরুলিয়াতে কুড়মালি ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হলো। সে যাই হোক, সকল ভাষার মিল অমিলের মধ্যেও তো একটি অন্তঃসলিলা যোগাযোগ তো আছেই। তবুও একদিন ভাষা নিয়ে দাঙ্গা হয়,তা কি ধর্মীয় দাঙ্গা থেকে কিছু আলাদা! একদল মানুষের কাজ হল লড়াই লাগানো।
ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে একটা গল্প আছে।গল্পটি টাওয়ার অফ ব্যাবেল নামেই বেশি পরিচিত। গল্পটি একটু বদলে নিলে তা মোটামুটি এরকম :
ঈশ্বর একদিন মানুষ সৃষ্টি করলেন। তাদের সকলের মুখের ভাষা ছিল এক। তারা সব সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তিতে বাস করতে করতে একদিন ঠিক করলো তারা সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের কাছে যাবে।তিনি যে আকাশপারের স্বর্গে থাকেন সেখানে যাবে তারা। তাই তারা শুরু করলো এক সুউচ্চ টাওয়ার তৈরির কাজ। দিনে দিনে তা উচুঁ হতে থাকে। ঈশ্বর স্বর্গে বসে দেখলেন,তাই তো এরা তো সকলে মিলে এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবে। ব্যাস!শুরু হলো সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের চক্রান্ত। তিনি মানুষদের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করার জন্য,তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য,  দিলেন সেই মানুষদের ভাষা আলাদা আলাদা করে।ফলে দেখা গেল এক চরম ব্যবেল, বিশৃঙ্খলা।মানুষেরা সব জানতেও পারলো না কি হলো? কেউ কারো কথা আর বুঝতে পারলো না। ফলে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে যে টাওয়ার তৈরির কাজ করছিল তা ভেঙে পড়ল,সম্পূর্ণ হলো না।ঈশ্বর দুশ্চিন্তা মুক্ত হলেন।তার আর ক্ষমতা হারাবার ভয় থাকলো না।মানুষেরা আর কেউ সশরীরে তার কাছে আসতে পারবে না। আর সেই সব বিভিন্ন ভাষার মানুষরা ছড়িয়ে পড়লেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। ঈশ্বর হলেন এখানে সার্বভৌম শক্তির প্রতীক। সাধারণ মানুষ যখনই জোটবদ্ধ হয় তাদের সেই জোট ভেঙে ফেলার ইতিহাস যে কত প্রাচীন তার স্মরণেই এই গল্পের অবতারণা।

২.

পাঠক মনে করুন,১৯০৫- এর উত্তাল বাংলার কথা। বিপ্লববাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। অবিভক্ত বাংলাদেশ জুড়ে সংহত হচ্ছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। ভারতের অন্য প্রদেশে তখনো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। যত ঝামেলা সব বাংলা প্রদেশে। তাই ব্রিটিশ সরকার ঠিক করলেন এই বাংলাভাষী মানুষদের আলাদা করতে হবে।তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, ভাঙো , বাংলাকে ভাঙো।ওদের ভাষা, ওদের সংস্কৃতিকে ভাঙার পণ নিয়ে লর্ড কার্জন সাহেবের ফরমান জারি হলো (১৯০৫ এর ১৯ জুলাই), বাঙলাকে ভাঙো। ভেঙে নতুন একটি প্রদেশ গঠিত হবে।যার নাম হবে পূর্ববঙ্গ ও আসাম। এর মধ্যে থাকবে ঢাকা,রাজশাহী, চট্টগ্রাম, মালদহ,পার্বত্য ত্রিপুরা ও আসাম।যার রাজধানী হবে ঢাকা। অবশিষ্ট বাংলা,বিহার, উড়িষ্যাকে নিয়ে বাংলা প্রদেশ গঠিত হবে যার রাজধানী হবে কোলকাতা।১৯০৫, ১৬ অক্টোবর এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে স্থির হয়। কার্জনের ” partition of Bengal is Settle fact ” কে unsettle করার জন্য রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ, কবিগুরু সহ সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসন্তোষ।বাঙলার শিক্ষিত মানুষজন দলেদলে আন্দোলনে যোগদান করেন। জাতীয়স্তরে ছড়িয়ে পড়ে সেই আন্দোলন।সরকার সাবধান ও সচেতন হয়ে সরকার বিরোধী, শাসক বিরোধী এই জনবিক্ষোভকে প্রশমন করার চেষ্টা করেন। প্রায় ছয় বছর পর ১২ ডিসেম্বর, ১৯১১, দিল্লির দরবার উৎসবে রাজা পঞ্চম জর্জ সরকারের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
♦বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করা হয়।
( এ কি রকম রদ? শুধু আন্দোলন বন্ধ করার একটি কৌশল, দৃষ্টি ঘোরানোর, ভাষা বদলের একটি কায়দা নয় কি? )
♦রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লিতে চলে যাবে। ( নিরাপদে থাকার জন্য।আন্দোলন,ডেপুটেশন, বিদ্রোহ,  অন্তর্ঘাত এসব এড়ানো যাবে। বাঙলা ও বাঙালীজাতির থেকে দূরে থাকা যাবে।)
♦বাঙলাদেশকে আবার দুভাগ করে দুটি রাজ্য হবে। ( তাহলে রদ আর কি হলো?)  তার একটি রাজ্য বাঙলাদেশ (পূর্ববঙ্গ সহ), রাজধানী কোলকাতা। অপরটির নাম হবে বিহার-  উড়িষ্যা,রাজধানী হবে পাটনা।
♦♦ দরবারি ঐ ঘোষনায় মানভূম জেলাকে
বিহার – উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করা হয়।তৎকালীন মানভূম,বর্তমান পুরুলিয়া জেলার মানুষদের কাছে এই সিদ্ধান্তটি মেনে নেওয়া ছিল খুবই কষ্টকর।
১ এপ্রিল,১৯১২ থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়।মানভূমবাসীদের সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যার ইতিহাস,অর্থনীতি,রাজনীতির যোগ তো কোনকালেই তেমন ছিল না।মানভূমের সঙ্গে তো বরাবর বাংলাদেশের যোগাযোগই বেশি। আগেও ছিল এখনো আছে।শুধু মানভূম নয় সূবর্ণরেখা নদী পেরিয়ে রাঁচি এমনকি টাটা বা জামশেদপুর  পর্যন্ত এক বিরাট এলাকার মানুষ ছিলেন বাংলাভাষী।অনেকেই এই এলাকাকে  ‘গ্রেটার বেঙ্গল’ বলার পক্ষপাতী। তাসত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার বাংলাভাষায় কথা বলা এই বিরাট এলাকাকে ঠেলে দিল বিহার-উড়িষ্যা রাজ্যে বা প্রদেশে। কোন যুক্তির তারা ধার ধারেন নি। সেই বিভেদের কৌশলে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করা ছাড়া তারা তো আর কিছু চান নি।

৩.

অনেকে মনে করেন মানভূমবাসীদের প্রতি ব্রিটিশ সরকার ক্রোধ ও প্রতিহিংসাবশত  এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।১৭৬৫, ১২ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি  কোম্পানি দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার,উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করার পরেই,জমির উপর সার্বিক কতৃত্ব স্থাপন ও চড়াহারে খাজনা আদায় করার জন্য জমি জরিপ করে এই ভূখন্ডকে নানা সময়ে নানান প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিভাজন করে। পুরুলিয়া জেলার উত্তরদিকে,কোম্পানি আমলের প্রথম জেলা হল পাঁচেট।পঞ্চকোট রাজ্যকেই পাঁচেট জেলা নাম দিয়ে তার জেলা সদর করা হয় রঘুনাথপুরে।(১৭৭৩,১৯ জানুয়ারি) প্রথম কালেক্টার নিয়োজিত হন মিঃ এস জি হল্লি। মাত্র সাত বছরে কোম্পানি খাজনা বাড়াতে বাড়াতে প্রায় দ্বিগুণ করে তোলে।এক হিসেব থেকে জানা যায়,১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি নির্ধারিত খাজনা ছিল ( টাকার হিসেবে) ৩০,০০০/  তা ১৭৮৩ তে করা হয় ৭৫,৫৩২/ যা প্রায় দ্বিগুণের বেশী, পরে তা কমিয়ে করা হয় ৫৫,৭৯৪/ টাকা।
সকলেই জানেন সেসময়কার জমিদাররা নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে খাজনা দিতে না পারলে জমিদারি নিলামে তোলা হত।১৭৯৮,৯ জুলাই পাঁচেট জেলার লধুড়কা,চৌরাশী,চেলিয়ামা,ছড়রা,লাগদা,মহিসারা,শেরগড় প্রভৃতি পরগনা নিলাম হয়ে যায়। রঘুনাথপুর আদালতে যারা জমিদারিগুলি নিলামে কিনেছিলেন তারা প্রায় সকলেই ছিলেন কোলকাতার বাসিন্দা। পঞ্চকোট রাজার প্রজারা বিদ্রোহ করলেন। তারা বললেন, পঞ্চকোট রাজা ছাড়া আর কাউকে তারা রাজা হিসাবে মানবেন না, অন্য কারোর অধীনে থাকবেন না। ফলে নিলামে কেনা জমিদারি কেউ দখল নিতে পারলেন না।এরফলে কোম্পানি নিলাম রদ করে পঞ্চকোটের রাজাকে পুনরায় তার জমিদারি ফিরিয়ে দেন কিন্তু সেরগড় পরগনার ১৮ টি মৌজা আর ফিরে এল না।
প্রজাদের বিদ্রোহের কাছে ক্ষমতাধর কোম্পানিকে এখানে পিছনে হাঁটতে হয়েছিল।
জেলার দক্ষিণ দিকে জঙ্গলময়,পাহাড়ঘেরা,দুর্গম। কোম্পানি এই এলাকায় পৌঁছে যায় ১৭৬৭ নাগাদ।খাজনা নির্ধারণের সময় থেকে এই অংশের প্রজাদের সঙ্গে শুরু হয় কোম্পানির লড়াই। এ লড়াইয়ের ইতিহাস প্রায় পঁয়ষট্টি বছরের।১৭৬৭-১৮৩২। ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী ও ঐতিহাসিকরা এদিককার স্বাধীনচেতা সাধারণ অন্তজ মানুষদের এ লড়াইকে নাম দিলেন ” চুয়াড়” বিদ্রোহ বলে। দেশীয় ইতিহাসবিদরাও সেই নামই মেনে নিলেন বিনা বাক্যব্যয়ে। প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলন ছিল সাধারণ অন্তজশ্রেণির আন্দোলন। ১৮৩২ এ “গঙ্গানারায়ণ সিংহ-র হাঙ্গামা” এই অঞ্চলে এক ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল। ১৮৫৫ তে সাঁওতাল বিদ্রোহের আগুন অল্প পরিমাণে হলেও মানভূমে লেগেছিল।এই আন্দোলনের প্রথম ইতিহাসকার  দিগম্বর চক্রবর্তী। তাঁর পিতা পঞ্চানন চক্রবর্তী  মানভূম থেকে পাঁকুড়ে গিয়েছিলেন। পাঁকুড়ের রানী ক্ষেমাসুন্দরী দেবী দিগম্বর বাবুর বোন। ( অরুণ চৌধুরীর প্রবন্ধ – ” দিগম্বর চক্রবর্তী “, দেশহিতৈষী ১৬ জুলাই,১৯৯৯) ১৮৫৭তে পুরুলিয়া তথা মানভূম জেলায়  সিপাহীবিদ্রোহের প্রভাবও ছিল। যার ফলস্বরূপ পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিং কে দশমাস ব্রিটিশ কারাগারে কাটাতে হয়।কেউ কেউ বলেন তাকে অন্তরিন রাখা হয়েছিল। এখানে আদিবাসী সাঁওতালরা সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের রাজার মদতেই।
অতএব দেখা যাচ্ছে ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে প্রবেশের সময় থেকেই এক প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন।এই বাংলাদেশে আর কোনও রাজা বা জমিদার বন্দি হন নি। মানভূমবাসীর এই বিরোধিতার প্রতিশোধ ব্রিটিশরা নিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে তাদের চিরতরে নির্বাসিত করেছিল, বিহার- উড়িষ্যা প্রদেশে অন্তর্ভু
ক্ত করে।

৪.

১৯১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে মানভূমের এই আন্দোলন চলেছিল ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর অব্দি।সারাদেশ যখন স্বাধীনতার সুখ আস্বাদন করছে, তখন পুরুলিয়া জেলাব্যাপী সূচনা হচ্ছে আরেক লড়াই,কষ্টের,বঞ্চনার প্রতিবাদে আন্দোলনের প্রস্তুতি।
এই জেলার প্রশাসনিক এলাকাকে এতবার পরিবর্তন করা হয়েছে তা এক রেকর্ড বলা যেতে পারে।
প্রথম জেলা হল পাঁচেট ১৭৭৩ সদর – রঘুনাথপুর
দ্বিতীয় জেলা হল জঙ্গল মহল ১৮০৫ সদর- বাঁকুড়া
তৃতীয় ও শেষবার করা হল, জেলা মানভূম ১৮৩৩ সদর- মানবাজার
কোম্পানি এই এলাকায় বারবার প্রতিরোধ আন্দোলনের সম্মুখীন হওয়ার ফলে বারেবারে জেলাকে,জেলার প্রশাসনিক ক্ষেত্রকে বিভাজন করেছে।১৮৪৫,১৮৪৬, ১৮৭১,১৮৭৯ তে এসে মানভূম জেলার আয়তন হয় ৪১১২ বর্গমাইল।  মানভূম জেলা তৈরির সময় এর আয়তন ছিল ৭৮৯৬ বর্গ মাইল। সাঁওতাল ও সিপাহী বিদ্রোহের পনের বছরের মধ্যেই আয়তন প্রায় অর্ধেক কমে যায়। মানভূমের সংগ্রামী মানসিকতা ও রাজার প্রতি প্রজাদের আনুগত্য চিরকাল তাদের ব্রিটিশ বিদ্বেষী করে রেখেছিল।
১৯৩৬ এ যখন রাজ্য পুনর্গঠন হয়। আলাদা উড়িষ্যা রাজ্য গঠিত হয় তখন মানভূমবাসীরা ভেবেছিলেন তাঁদের এবার হয়ত বঙ্গভুক্ত করা হবে। কিন্তু তা না করে তাদের বিহার রাজ্যের মধ্যেই রাখা হয়।এবারেও হল না। এবার তারা লড়লেন জানপ্রাণ লড়িয়ে স্বাধীনতার লড়াই। এল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা কিন্তু বঙ্গভুক্তি হল না। হওয়ার কোন লক্ষণও দেখা গেল না। যার পরিণতিতে ১৯৪৮ থেকে আবার শুরু হল এক ঐতিহাসিক লড়াই। এ লড়াই মানভূমের ভাষার জন্য,নিজেদের কৃষ্টির জন্য,বঙ্গভুক্তির জন্য। যার সমাপ্তি হয় ১৯৫৬ র ১ নভেম্বর। কিন্তু মানভূম জেলার ধানবাদ মহকুমার লক্ষ লক্ষ বাঙালীর প্রাণের ভাষা হারিয়ে গেল চিরতরে। বিহার সরকারের মাত্রাতিরিক্ত হিন্দিপ্রেমের জন্য।
সারা ভারতে মানভূমবাসীরাই প্রথম নিজেদের ভাষার জন্য, নিজেদের ভূখন্ডের দাবীতে অহিংস আন্দোলনে সামিল হন।

৫.

মানভূম জেলাকে বিহার-উড়িষ্যায় সংযুক্তির বিরুদ্ধে প্রথমদিন থেকেই মানভূমে বিক্ষোভ হয়েছিল। কোলকাতা থেকে পুরুলিয়া শহরের দূরত্ব রেলপথে ৩২৬ কিমি, অপরদিকে পাটনার দূরত্ব ছিল ৩৮০ কিমি ( সূত্র : গুগল)। এই দূরত্ব শতবর্ষ আগে অতিক্রম করা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। প্রত্যন্ত বাংলাভাষী এই এলাকাটি কেন বাংলাদেশে বা স্বভূমে থাকতে পারবে না?সেকথা জানতে চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি দেওয়া হয়,আন্দোলনও হয়।এই আন্দোলনের নেতৃত্বদান করেন পুরুলিয়া আদালতের আইনজীবী রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন প্রমুখ।তাঁদের সহায়তা করেন কলিয়ারি মালিক,ব্যবসায়ী ও কয়েকজন জমিদার। সরকার এর পরিপ্রেক্ষিতে বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশের গভর্ণরকে এবিষয়ে রিপোর্ট দিতে বলেন।
মানভূমের বিশিষ্ট গবেষক সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, ” বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা উপলব্ধি করতে পারেন নি যে মানভূম ও ধলভূমের বাংলা ভাষাভাষী এক বৃহৎ অংশকে বিহার- উড়িষ্যা রাজ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে,সে অঞ্চলগুলি প্রাচীন কাল থেকেই বঙ্গদেশেরই অংশ হিসাবে গণ্য হয়ে এসেছে। ” আবুল ফজলের “আইন- ই-আকবরী”  গ্রন্থেও দেখা যায় সে সময় সুবা বাংলা যে ১৯ টি সরকারে বিভক্ত ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল মান্দারন। ধলভূম ও মানভূম ছিল মান্দারন সরকারের অন্তর্ভূক্ত।
১৯১২ থেকেই মানভূমবাসী বিহার- উড়িষ্যা প্রদেশে সংযুক্তির প্রতিবাদে আবেদন- নিবেদনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছেন।তারা ব্রিটিশ সরকারকে আবেদনে জানালেন, মানভূমের ভৌগোলিক ও জাতিগত অবস্থান, ইতিহাস,ভাষা, আইনকানুন, জমি ও শাসনবিধি,বিচারের সাধারণ নিয়মকানুন প্রচলিত আইন  সবকিছুই তাদের বাংলাদেশের মতো, তবে কেন তাদের বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে! তাঁরা ভারত সরকারকে জানান, তাঁরা বাংলাদেশের মধ্যেই থাকতে চান। তাঁরা এও বলেন, বিহারিদের কাছে তারা কোনদিন  মর্যাদা পাবেন না এমন কি আইনসভায় নিজেদের প্রতিনিধি ঠিকঠাক পাঠাতে পারবেন না। ব্রিটিশ সরকার এই সব যুক্তি মানেন নি। বিহার ও উড়িষ্য প্রদেশের প্রধান সেক্রেটারি যে রিপোর্ট দিলেন, তাতে বলা হল, ওসব ভীতি অমূলক। দিল্লী দরবারে ভারতের বড়লাট আনুষ্ঠানিক ভাবে যে ঘোষণা করেছেন তাকে বানচাল করা হলে জনগনের মধ্যে সরকারের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দেবে। তিনি মন্তব্য করেন, “It seems very desirable from all points of view that further agitation on the subject should be discourage ”
প্রথমদিকের এই আবেদন-নিবেদনের পরিণতি দাঁড়ায় এই। এর কারণ কি?  বিভিন্ন গবেষকগণের মত থেকে বলতে পারি,
১/ এরকম একটি বিষয় নিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা।
২/ সেই সময় সর্বজনগ্রাহ্য নেতৃত্বর অনুপস্থিতি।
৩/ বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে তাদের বোঝানোর ব্যর্থতা।
৪/ আবেদন- নিবেদন পদ্ধতির উপর আস্থা রাখা।
৫/ পুরুলিয়া কোর্টের কয়েকজনমাত্র আইনজীবী এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। তাঁরা, তাঁদের পেশাগত কারণেই সেইসময় প্রবল ব্রিটিশ বিরোধীতা করতে পারেন নি।
৬/ বিষয়টি নিয়ে সারা বাংলাদেশে জনমত ও আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারা।
৭/ বাংলা দেশ প্রদেশের নেতৃবৃন্দ সে সময় বঙ্গভঙ্গ রদ করতে পেরেছেন এই সাফল্যটি বড়ো করে দেখাতে চেয়ে মানভূমের বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশের অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি সেভাবে প্রচার ও প্রতিবাদ করেন নি।
৮/ নিজেদের স্বতন্ত্র কোন সংগঠন না থাকা।

(মানভূম ভাষা আন্দোলনের ছবি, ফেসবুক সূত্রে সংগৃহীত)

৬.

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ যে সকল স্বাধীনতা সংগ্রামী কংগ্রেসের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন,কারাবরণ করেছিলেন,পুলিশী নির্যাতন সয়েছিলেন তাঁরাই আবার স্বাধীনতার পর ক্ষমতা পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করে আবার এক নতুন সংগ্রামের নিজেদের নিয়োজিত করলেন।তার জন্য তাঁরা ত্যাগ করলেন তাঁদের প্রিয় কংগ্রেস দল। গড়ে তুললেন নিজেদের সংগঠন।
কংগ্রেসের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন প্রতিষ্ঠা হয়  “লোকসেবক সংঘ”। মানভূম জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি সত্তোরোর্ধ্ব অতুলচন্দ্র ঘোষ হলেন যার প্রধান কান্ডারি। এই নতুন জেলাভিত্তিক দলটির ব্যবস্থাপক মন্ডলীর অন্যান্য সচিবগণ ছিলেন : বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত ( তিনি মানভূম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক ছিলেন), সত্যকিঙ্কর মাহাত, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ ( পুরুলিয়ার ‘মা’), ভজহরি মাহাত,জগবন্ধু ভট্টাচার্য, ভীমচন্দ্র মাহাত,অরুণ চন্দ্র ঘোষ প্রমুখ।
১৯৪৮-৭৮ অব্দি পুরুলিয়া জেলার রাজনীতিতে আদ্যন্ত গান্ধিবাদী লোকসেবক সংঘের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।মানভূমের চিরন্তন সংস্কৃতি রাষ্ট্র শক্তি বিরোধীতা করার প্রেরণা জুগিয়েছিল বলা যেতে পারে।
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় কংগ্রেস দলকে পাশে পাবেন না বুঝেই তাদের নতুন দল তৈরি করা। মানভূম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি,সম্পাদক ছাড়াও জেলা কমিটির মোট চল্লিশ জন সদস্য সেদিন কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে নতুন দলটিতে যোগদান করেছিলেন সকল প্রলোভন ত্যাগ করে।

৭.

“বাংলা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করা যাবে না”– বিহার সরকারের এমন ফরমানের ( নোটিফিকেশন নং –
১১৯৪ ই আর তাং ০৪/১১/১৯৩০) বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু হয় এবং তার সমাপ্তি ঘটে পুঞ্চা থানার পাকবিড়রা থেকে কোলকাতা পদযাত্রার ( পদযাত্রার সূচনা হয় ২০ এপ্রিল, ১৯৫৬) মাধ্যমে।
মানভূমের মানুষদের এই ভাষা আন্দোলনকে প্রথম থেকেই ভালো চোখে দেখেন নি বিহার সরকার।রাষ্ট্র শক্তির সাহায্যে তারা এই আন্দোলনের সবরকম বিরোধীতা করেছে। “বিহার জন নিরাপত্তা আইন” নামে একটি কালাকানুনের সাহায্যে আন্দোলনকারীদের উপর দমনপীড়ণ করা হয়।তিয়াত্তর বছর বয়সী মানভূমের সর্বজনশ্রদ্ধেয় জননেতা অতুলচন্দ্র ঘোষ মহাশয়কে মাতৃভাষার জন্য,স্বভূমের স্বীকৃতির জন্য যে যন্ত্রণা সহ্য করেছেন তা উল্লেখ করতেই হয়। স্বাধীনদেশের সরকারের কাছে এই প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী অনুমতি না নিয়ে টুসুগানের দল নিয়ে শোভাযাত্রা করেছিলেন, এই অভিযোগ ও ‘অপরাধ’এ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
” তিনি ক্রনিক প্লুরিসিতে ভুগছিলেন। তার কাশি হচ্ছিল।মোকদ্দমার দিনগুলিতে তাকে দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কিছুসময় কোর্টে বাকিসময় মলমূত্রযুক্ত হাজতে রাখা হত।জেলে তার জ্বরও হচ্ছিল। সকলেই জানেন লোকসেবক সংঘ জরিমানা দিতেন না — অতএব ৬ মাসের সাথে ১০০০ টাকা জরিমানার অনাদায়ের জন্য আরও তিনমাসের জেল হল ৭৩ বৎসরের মানভূমের স্বাধীনতা যোদ্ধার। বিচারের সময় তাকে দাঁড়িয়েই থাকতে হত। “( মানভূমের ভাষা আন্দোলন ও পুরুলিয়ার বঙ্গভূক্তি – দিলীপকুমার গোস্বামী, বজ্রভূমি প্রকাশনী,  ২০০৬)  এখানেই শেষ নয়, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে (২৬ /২/৫৪) কনকনে ঠান্ডায়, রাতের বেলায় একটি খোলা ট্রাকে আরো তেরজন সত্যাগ্রহীর সঙ্গে তাঁকে পুরুলিয়া জেল থেকে ১৩৫ কিমি দূরের হাজারিবাগে  জেলে পাঠানো হয়।
এই হোল স্বাধীন দেশের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রতি রাষ্ট্রের ব্যবহার। তিনি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছিলেন,সরকারি দলের সংশ্রব ত্যাগ করে নিজের দলের মনোনীত প্রার্থীকে সংসদে প্রেরণ করতে পেরেছেন তার ওপর আবার ভাষার জন্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাই রাষ্ট্র তাঁকে ছেড়ে কথা বলে নি।আন্দোলনে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

৮.

স্বাধীনতার পর বিহার প্রাদেশিক সরকার একের পর এক সার্কুলার জারি করেন।যার লক্ষ্য ছিল মাতৃভাষার উপর আক্রমণ। বাংলাভাষী সব বিদ্যালয় পরিদর্শককে মানভূম জেলা থেকে ট্রান্সফার করা হলো বিহারের নানান জায়গায়।
ডি. আইয়ের মাধ্যমে আদেশ দেওয়া হল, প্রতিটি বিদ্যালয়ে সরকারি নির্দেশ মত হিন্দি সাইনবোর্ড লাগাতে হবে।হিন্দি পড়ালেই কোন বিদ্যালয়ের অনুমোদন মিলবে,আবার কোন বিদ্যালয় যদি হিন্দি না পড়ায় তবে তার অনুমোদন বাতিল বা স্থগিত করা হবে।স্বাধীনতার আগে পাঠ্যবইগুলি হিন্দি ও বাংলায় ছাপা হত। স্বাধীনতার পর ( ১৯৪৮-৪৯)  এই প্রথম মাধ্যমিক স্তরের কোন পাঠ্যপুস্তক বাংলা ভাষায় ছাপা হল না। ১৮/৩/৪৮ দুটি সার্কুলার জারি হয় ডি. আই. অফিস থেকে। তাতে জেলার পুরাতন স্কুল গুলিতে (aboriginal) প্রচলিত বাংলা মাধ্যমের পরিবর্তে বাধ্যতামূলকভাবে হিন্দি মাধ্যমে পড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয় এবং দেবনাগরী হরফে সাইনবোর্ড টাঙানোর আদেশ দেওয়া হয়।স্কুলের খাতাপত্র হিন্দিতে লেখা,রামধূন গাওয়া প্রভৃতি আদেশ দেওয়া হয়।বিভিন্ন সংস্থাকে সাহায্যদানের টোপ দিয়ে বলতে বলা হয়, মানভূমের ভাষা হল হিন্দি।এরকমই প্রস্তাব দেওয়া হয় ১৯২১ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত ” হারিপদ সাহিত্য মন্দির ” কে।
ভাষা আন্দোলনের হাতিয়ার টুসু সত্যাগ্রহে টুসু গান লেখার জন্য লোকসভার নির্বাচিত সাংসদ ভজহরি মাহাতকে কোমরে দড়ি বেঁধে সাধারণ একজন আসামীর মত জেল থেকে কোর্ট হাজত পর্যন্ত হাঁটিয়ে আনা হয়।স্বাধীন ভারতে নির্বাচিত লোকসভা সদস্য ভজহরি মাহাত-র এক বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড ও একশ টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে আরো একমাস কারাদণ্ড দেওয়া হয়।মাতৃভাষার জন্য টুসুগান রচনা ও সেই গান নিয়ে শোভাযাত্রা করাই ছিল তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ।তারজন্য তার জেল ও জরিমানা, ভাবা যায়! সারাভারতে এ দৃষ্টান্ত প্রায় বিরল। এসব ঘটনায় জনমানসে যেমন ক্ষোভ বাড়ে, তেমনি বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে  ও ভারতের লোকসভায় বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হয়।

৯.

টুসু গান মানভূমের একটি জনপ্রিয় লোকগান।মানভূমকে অনেকে গানভূমও বলে থাকেন। লোকসেবক সংঘ এই টুসুগানকে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। টুসুগানকে অবলম্বন করেই সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়। এর বৈশিষ্ট ছিল,  এটি হত অহিংস। অহিংস অান্দোলন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হলে কেউ জামিন নিতেন না ও জরিমানা হলে তারা তা কখনো দিতেন না। ফলে সংঘের নেতা,কর্মীদের বারবার জেল হয়েছে। কতবার যে জেল হয়েছে তার হিসেব গবেষকগণও করে উঠতে পারেন নি।
টুসু সত্যাগ্রহ প্রথম শুরু হয় ৯ জানুয়ারি, ১৯৫৪।  দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন চলে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর চলে এই আন্দোলন। অপরদিকে টুসু সত্যাগ্রহ জন জাগরণের রূপ নিলে বিহার সরকার সাধারণ মানুষদের উপর দমনপীড়ন শুরু করে।পুলিশ টুসুগান গাইতে দেবে না ঠিক করে। টুসুগান গাইলেই গ্রেপ্তার ও জরিমানা করে। অপরদিকে লোকসেবক সংঘ ” টুসু গানে মানভূম ” শিরোনামে টুসুগানের বই ছাপিয়ে লক্ষ কপি বিক্রি করার ব্যবস্থা করেন।গানগুলির বিষয় ছিল বিহার সরকারের দ্বারা বাংলা ভাষা দমন, নিপীড়ন। কিছু বিখ্যাত গান,  ভজহরি মাহাত-র ” ও বিহারি ভাই তোরা রাখতে লারবি ডাঙ দ্যাখাই “, অরুণ ঘোষের
” বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে “, জগবন্ধু ভট্টাচার্যের ” প্রাণে আর সহে না হিন্দি কংগ্রেসিদের ছলনা “।এরকম আরো বহু টুসু গান সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফিরতো সেই সময়।

১০.

মানভূমের এই আন্দোলনে সারাদেশব্যপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।পাঁচজন লোকসভা সদস্য যৌথভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ পত্র দিয়েছিলেন। এঁরা হলেন,এন সি চ্যাটার্জী, সুচেতা কৃপালনী, হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জী,এস এন মোরে ও ভি জি দেশপান্ডে ( মুক্তি, ১ মার্চ,১৯৫৪)।
১৯৫৩,ডিসেম্বরে, রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয়। তাদের প্রথম সভা হয় ১৯৫৪, ১০ ফেব্রুয়ারি। ২৩ ফেব্রুয়ারি কমিশন হঠাতই ঘোষণা করে সকলের দাবি,বক্তব্য ও মতামত ২৪ এপ্রিলের মধ্যে
কমিশনের কাছে জানাতে হবে।
লোকসেবক সংঘ এসময় আন্দোলন বন্ধ করে কমিশনের জন্য কাগজপত্র তৈরি করতে উদ্যোগী হন। কাজে নেমে তাঁরা বুঝলেন এত স্বল্প সময়ে এত এত তথ্য যোগাড় করা সহজ কাজ না। তাই তাঁরা কমিশনের কাছে সময়সীমা বাড়ানোর দাবি জানান।তা মঞ্জুর হয়। ৩১মে অব্দি দিন বাড়ানো হয়।লোকসেবক সংঘ ঐদিন, মানে একেবারে শেষদিনে ১২০০ পাতার( পরে আরো ৪০০ পাতা দেওয়া হয়)  স্মারকলিপি কমিশনের কাছে জমা করেন।
এছাড়াও সদর লোকাল বোর্ড,পুরুলিয়া বার এসোসিয়েশন, মানভূম বাঙালি সমিতি,সংযুক্ত প্রগতিশীল ব্লক,মানভূম নাগরিক সংঘ,হরিপদ সাহিত্য মন্দির, ধানবাদের জনসাধারণও নিজেদের নিজেদের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গভুক্তির স্বপক্ষে স্মারকলিপি জমা করেন।
এছাড়াও প্রাদেশিক ও সর্বভারতীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মানভূম ও ধলভূমকে পশ্চিমবঙ্গভুক্তির স্বপক্ষে স্মারকপত্র জমা করেন কমিশনের কাছে।এদের মধ্যে ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার,বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি, ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতীয় হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ,
ভারতীয় প্লান্টারস এসোসিয়েশন পভৃতি।
বিহার সরকারও মানভূমকে এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে ছিল না। বিহার সরকার ও কংগ্রেস দল যৌথভাবে মানভূমের বাঙলা ভাষাভাষীদের প্রতি বিদ্বেষ জ্ঞাপন করে শুরু করেন অপপ্রচার। ১৯৫৪ র ৭-৯ জুন পুরুলিয়া শহরের বেলগুমায় বিহার প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সম্মেলন হয়।বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ সহ সব মন্ত্রীরাও উপস্থিত ছিলেন।সম্মেলন উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রায় যেসব ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড করা হয়েছিল তাতে লেখা ছিল মানভূম ” বিহার মে রহেঙ্গে “, “বাঙ্গাল মে নেহি যায়েঙ্গে”।
এখানে তিনদিন ধরে বাঙালিদের নাম ধরে ধরে কুৎসা করা হয়।স্বাধীন ভারতে  প্রাদেশিক কংগ্রেসের  এই অধিবেশনে এত ” নিম্নমানের জাতিবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতার প্রচার” হয় যার নজির আর কোথাও পাওয়া যায় না।শুধু মাত্র ভাষাকে কেন্দ্র করে বিহারি ও বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।বঞ্চনা করা হয় চাকরি ক্ষেত্রে,ব্যবসার ক্ষেত্রেও। এমনকি সাধারণ মানুষ যাঁরা বনে জঙ্গলে কাঠ পাতা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করতো তাদেরও হয়রানি করা হয়।বিহার সরকার পুরো মানভূম জেলা জুড়ে সরকারি ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সভা-সমিতি সংগঠন করে নিজেদের পক্ষে। সেখানে শ্লোগান দেওয়া হয়, ” মানভূম বাঙ্গাল মে নেহি যায়েগা “, জানে পর খুন কি নদী বহা দেঙ্গে “।
লড়াই চলে বিহার বিধানসভার ভেতরেও।উচ্চ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে বিধায়ক ভীমচন্দ্র মাহাত
১ মার্চ ১৯৫৪,খ্রিস্টাব্দে যে বক্তৃতা করেন তা ইতিহাস হয়ে আছে।
সরকার তার কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজ্য পুনর্গঠন  কমিশনের কাছে ‘মানভূম বিহারে থাকবে, বাংলায় যাবে না ‘ তা কীভাবে বলতে হবে সে ব্যাপারে ভালো করে বুঝিয়ে দেয়।এদিকে ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছিল সরকার। জগবন্ধু ভট্টাচার্যকে ১৭ ডিসেম্বর,১৯৫৪ মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। ঝালদার এক জনসভায় যুবক শিশির গুপ্তকে সেখানকার দারোগার উপস্থিতিতে লাঠিপেটা করা হয়। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বিহার সরকারের রাজস্বমন্ত্রী কৃষ্ণবল্লভ সহায়। বান্দোয়ান, রঘুনাথপুর, নিতুড়িয়া ছাড়াও ধানবাদ মহকুমার ঝরিয়া,সিন্দ্রি,ধানবাদের অবস্থা আরো খারাপ ছিল।সেখানে বাঙালিদের বাড়িতে অব্দি আক্রমণ করা হয়েছে।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন মানভূম জেলা পরিদর্শন করে ফিরে যাওয়ার (৬/২/৫৫) পর এই অঞ্চল পরিদর্শনে আসেন অতুল্য ঘোষ। বিহার সরকারের কাছে অনুমতি চেয়েও তিনি এই এলাকা পরিদর্শনের অনুমতি পান নি। তাসত্ত্বেও তিনি আসেন। ৭-৮ ফেব্রুয়ারি,১৯৫৫ তিনি এই এলাকা ঘুরে দেখেন।স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে, স্বচক্ষে দেখার পর ১২ ফেব্রুয়ারি,১৯৫৫ (তিনি তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন) তাঁর একটি বিবৃতি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, “এই ব্যাপক সফরের ফলে আমি যে দুঃখদায়ক অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি তাহা অবর্ণনীয়। বাংলাভাষী জনগণ যাহাতে রাজ্য সীমানা পুনর্গঠন কমিশনের নিকট স্বাধীনভাবে বক্তব্য পেশ করতে না পারেন, তদুদ্দেশ্যে গত প্রায় একমাসকাল বিহারের কংগ্রেসি সরকার বাংলাভাষী অধিবাসীদের ভীতি প্রদর্শনে তাহাদের সাধ্যমত করিয়াছেন।সম্মেলন, শোভাযাত্রা,জনসভা ইত্যাদির অনুষ্ঠান করা হইয়াছে এবং বাংলাভাষী অধিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে বড় বড় লাঠি লইয়া কুচকাওয়াজ করা হইয়াছে। ” তাঁর এই বক্তব্যে বাংলাভাষার মানুষদের ওপর সন্ত্রাসের ছবিটি স্পষ্ট হয় ও তা প্রচার হওয়ার ফলে জনমতও গঠিত হয়।
বিধানচন্দ্র রায় বিহার সরকারের প্রতি প্রথম থেকেই নরম মনোভাবাপন্ন ছিলেন।অতুল্য ঘোষের মন্তব্যে তিনিও তাঁর ভুল বঝতে পারেন।গবেষকরা বলেছেন, বিধানচন্দ্র রায় ” বাংলাভাষার জন্য আন্দোলনকারী জনগণের দাবীগুলির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না। ”
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে তাতে নানান সুপারিশের সঙ্গে মানভূম জেলাকে খন্ডীকরণ করা হয়।জেলার দুটি মহকুমার একটিকে অর্থাৎ ধানবাদ মহকুমার দশটি থানাকেই বিহারে রাখার সুপারিশ করা হয়। আবার পুরুলিয়া সদর মহকুমার চাষ থানায় হিন্দিভাষীর সংখ্যা বেশি থাকায় সেটিও বাদ যায়।ফলে সদর মহকুমার একুশটি থানার একটি বাদ দিয়ে কুড়িটি থানাকেই পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভূক্ত করার সুপারিশ করা হয়।
কমিশনের সুপারিশ সকল বাংলাভাষী মানুষকে খুশী করতে পারেনি। ধানবাদ,ধলভূম,সাঁওতাল পরগণা, কাছাড়,গোয়ালপাড়া প্রভৃতি এলাকার (প্রায় পনের হাজার বর্গমাইল) কুড়ি লক্ষ বাঙালিকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে রাখা হলো।
কমিশনের সুপারিশের ওপর প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ, শিক্ষা মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ ও কংগ্রেস সভাপতি ইউ,এন. দেবরকে নিয়ে রাজ্য পুনর্গঠন সাবকমিটি গঠিত হয়েছিল তারা আবার ঝালদা, জয়পুর, বাঘমুন্ডি, বরাবাজার,বান্দোয়ান থানাকেও বিহারে রাখার পক্ষে কথা বলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ঘোষিত হওয়ার আগেই তা প্রকাশ হয়ে যায় এবং তার ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও মানভূমের বাংলাভাষী মানুষদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া হওয়ায় সরকার তা কার্যকরী করা থেকে পিছিয়ে আসেন।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, টাটাকোম্পানীর স্বার্থে বিধানচন্দ্র রায় কীভাবে সুকৌশলে চান্ডিল, ইচাগড় ও পটমদা থানার প্রায় ছশো বর্গমাইল এলাকা বিহারকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।শেষপর্যন্ত পুরুলিয়া সদর মহকুমার ষোলটি থানা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভূক্ত হয়।

১১.

কমিশনের রিপোর্ট পেশের পরবর্তী ঘটনা খুবই উল্লেখযোগ্য।১৯৫৫,২০ ডিসেম্বর দক্ষিণ মানভূম কেন্দ্রের লোকসেবক সংঘের দুই লোকসভা সদস্য, ভজহরি মাহাত ও চৈতন মাঝি লোকসভায় কমিশনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আবার শুরু হয় টুসু সত্যাগ্রহ। ১৯৫৬ র ১৬ জানুয়ারি কমিশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হলে তার পরদিন বিহারব্যাপী হরতাল পালনের ডাক দেওয়া হয়।সেই ডাকে পুরুলিয়া শহর ও মানভূম জেলা সাড়া না দিলেও হরতালকে কেন্দ্র করে,তা সফল করার জন্য সরকারি তৎপরতা ছিল তুঙ্গে।
আবার ২১ জানুয়ারি, ১৯৫৬ মানভূমসহ সারা পশ্চিমবঙ্গে হরতাল ও অরন্ধন পালিত হয়।এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়  ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন যেহেতু কমিশনের রায়ে দুটি রাজ্যই সন্তুষ্ট নয়, তাই পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারকে সংযুক্ত করে একটি পৃথক রাজ্য গঠিত হবে।তার নাম হবে, ” পশ্চিমবঙ্গ বিহার সংযুক্ত প্রদেশ “।সরকারি ভাষা হবে বাংলা ও হিন্দি ইত্যাদি।এই ঘোষনায় সারা বাংলায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।প্রস্তাবটি সর্বত্র  ধিকৃত ও নিন্দিত হয়।২৪ ফেব্রুয়ারি,১৯৫৬ প্রস্তাবের বিরোধীতায় অনুষ্ঠিত হয় হরতাল।এর প্রতিবাদে কংগ্রেস ছাড়া সকল রাজনৈতিক দলের শ্রমিক,কৃষক,ছাত্র,যুব, মহিলাদের নিয়ে কোলকাতার সিনেট হলে সারা বাংলা সম্মেলন হয়।বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এই সম্মলনে সভাপতিত্ব করেন।তিনি ছাড়াও এই সম্মেলনের অন্যান্য বক্তারা হলেন হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, জ্যোতি বসু, মোহিত মৈত্র,গোপাল হালদার,দাশরথি তা,সত্যপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীন সেনগুপ্ত,কাজী আবুল ওদুদ প্রমুখ।
লোকসেবক সংঘের নেতৃত্বে এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে লাগাতর আন্দোলন, বিক্ষোভ কর্মসূচি রূপায়িত হয়। ১৯৫৬-র ২০ এপ্রিল তাঁরা এক পদযাত্রার আয়োজন করেন।১০০৫ জন পদযাত্রী  পুঞ্চা থানার ঐতিহাসিক স্থান ও প্রত্নস্থল পাকবিড়রা থেকে কোলকাতা পৌঁছান  ৬ মে সকাল দশটায়। পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র পথের দুপাশে মানুষজন ভীড় করে তাঁদের সাহায্য ও সমর্থন করেন,সম্বর্ধিত করেন। ৭ মে তাঁরা অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ করে ৯৬৫ জন কোলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে ১৪৪ ধারা অমান্য করে কারাবরণ করেন। ৯ মে আরো ৩৪ জন একই জায়গায় আইন অমান্য করে কারাবরণ করেন।তাঁদের প্রেসিডেন্সি, আলিপুর,আলিপুর স্পেশাল জেলে বন্দি করা হয়। ১৩ দিন কারাবাসের পর তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।
১৭ আগস্ট, ১৯৫৬ মানভূম জেলার পুরুলিয়া মহকুমা পূর্বোল্লিখিত থানাগুলি বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং তা কার্যকরী হয় ১ নভেম্বর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে।তার আগে বিহার সরকার জেলা গ্রন্থাগার থেকে আলমারিসহ সব দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ,কোর্টের সব রেকর্ড এমনকি সার্কিট হাউস থেকে ফার্নিচার,এমনকি পর্দাসহ সবকিছুই রাতারাতি ট্রাকে করে ধানবাদ ও অন্যত্র চালান করে দেওয়া হয়।
শেষপর্যন্ত  নির্দিষ্ট দিনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সহধর্মীনী বাসন্তী দেবীর সভানেত্রীত্বে বর্তমান  পুরুলিয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভূক্ত হয়।
মাতৃভাষার জন্য স্বভূমির এই লড়াই ভারত ইতিহাসের এক অনালোকিত দিক আজো।এই বিষয়ে পুরুলিয়ার বিদ্বজ্জনেরা বেশকিছু গবেষণামূলক কাজ করেছেন,কিন্তু সেগুলির তপমন প্রচার ও স্বীকৃতি নেই। সামগ্রিক বিষয়টি নিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে এর আলোচনা খুব একটা দেখা যায় না তা কি হিন্দি ভাষাকে মেনে নিতে না পারার জন্য?
সংগ্রামী মানভূমের মানুষদের সংগ্রাম কিন্ত আলো পাওয়ার যোগ্য।তাঁদের আত্মত্যাগের ফলেই আজ আমরা পুরুলিয়া জেলাকে পেয়েছি।

বিশেষ সহায়ক গ্রন্থ :

১/ মানভূমের ভাষা আন্দোলন ও পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি- দিলীপকুমার গোস্বামী, বজ্রভূমি প্রকাশনী,পুরুলিয়া ২০০৬।

ঋণ:

১/ পুরুলিয়া : তরুণদেব ভট্টাচার্য্য, ফার্মা কে এল এম, কোলকাতা : ১৯৮৬।
২/ পশ্চিমবঙ্গ ( পুরুলিয়া জেলা সংখ্যা),জুন, ২০০৭।
৩/ অহল্যাভূমি পুরুলিয়া : সম্পাদনা, দেবপ্রসাদ জানা, দীপ প্রকাশন, কোলকাতা : জুলাই, ২০০৩।
৪/ আমাদের যেটুকু আকাশ : সম্পাদক : মানবেন্দু রায়,সোমনাথ দাস,তারপদ হাজরা,প্রান্তর, দুর্গাপুর,২০০৭।
৫/ ফেসবুক ( ছবি এখান থেকেই নেওয়া)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।