নারী জীবন এবং সমাজে নারীর আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত বেশ কতকগুলি চরিত্র রবীন্দ্র সাহিত্যে চিত্রায়িত হয়েছে। এরমধ্যে ‘নগরলক্ষ্মী’ কবিতার সুপ্রিয়া চরিত্রটি উল্লেখের দাবি রাখে। রবীন্দ্র রচনাবলী বিশ্বভারতী সুলভ সংস্করণে কবিতাটি ‘কল্পদ্রুমাবদান’ অবলম্বনে লিখিত এরকম আভাসিত হয়েছে। রচনার তারিখ রয়েছে ২৭ আশ্বিন, ১৩০৬.
এই কবিতায় দেখা যাবে, বুদ্ধের জীবৎকালে একবার বিখ্যাত নগরী শ্রাবস্তীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। বুদ্ধ নিজের ভক্তদের প্রত্যেককে অনুরোধ করলেন দুর্ভিক্ষকাতর ক্ষুৎপীড়িত মানুষকে আহার যোগানোর দায়ভার কে নিতে পারবেন।
বলা দরকার যে, বুদ্ধদেব দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন এবং তাঁর সক্ষম সময়েই সমাজের বহু বিশিষ্ট ও অগ্রণী ব্যক্তি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আলোচ্য দুর্ভিক্ষ ও সেই সূত্রে ক্ষুধাকাতর জনতাকে অন্নদান প্রকল্পের দায়ভার গ্রহণের কথা বুদ্ধ যখন নিজের ভক্তদের বলেছিলেন, তখন ধনাঢ্য রত্নাকর শেঠ, সামন্ত রাজা জয়সেন, এবং বিপুল কৃষি জমির অধিকারী ধর্মপাল এবং আরো সকলেই নিজের নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। ধনী ব্যক্তি হোন বা লোকবলে বা জমির উপর স্বত্ব ও দখলে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও শ্রাবস্তী পুরীর ক্ষুধার্ত জনতার ক্ষুধা মেটানোর মনোবল সেই সব ব্যক্তিদের ছিল না।
বলা দরকার, বুদ্ধ মোটের উপর যাঁদের বদান্যতা আশা করেছিলেন, তাঁরা কেউ শ্রেষ্ঠী , কেউ সামন্তরাজা, আবার কেউ বিশাল ভূ সম্পত্তির মালিক হলেও যে বিচারবুদ্ধির প্রভাবে নিজের সর্বস্ব দান করে সাধারণের কল্যাণে উৎসর্গ করা যায়, এই হৃদয়বত্তার অভাব তাঁদের ছিল। বড় বড় সম্পত্তির মালিক হওয়া এক জিনিস, আর জন কল্যাণে সেই বিপুল সম্পত্তি উৎসর্গ করা আর এক জিনিস।
এমন সময়ে একটি মেয়ে উঠে দাঁড়ালো। সে অনাথপিণ্ডদের কন্যা। সে নিজে একজন ভিক্ষুণী। সে বললো, খাদ্যহারা মানুষকে অন্ন যোগানোর ভার সে গ্রহণ করলো।
এইখানে উল্লেখ করতে হয়, বুদ্ধের জীবৎকালে ভিক্ষুজীবন যথেষ্ট কষ্টের মধ্যে কাটত। ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার প্রশ্নই ছিল না। পোশাকও অতি সামান্য, হয়তো মাত্র একটিই। কোনো মান্যগ্রন্থে পড়েছি, মেয়েরাও মাত্র একটি পোশাকের কারণে নদীতে স্নানের সময়ে যথেষ্ট আত্মনিগ্রহ করতেন। বুদ্ধের অনুশাসন ছিল এতটাই কঠিন। তো সেই রকম একজন ভিক্ষুণী কি করে ক্ষুধার্ত জনতাকে খাদ্য দেবার অঙ্গীকার করছেন, তা সমবেত ভক্তদল বুঝতে অক্ষম হলেন। যে ধনাঢ্য শ্রেষ্ঠী , যে সামন্তরাজ, যে বিপুল ভূ সম্পত্তির অধিকারী, নিজের কাঁধে প্রভু বুদ্ধের আবেদন বহন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেই হিসেবি বুদ্ধির লোকেরা এক ভিক্ষুণীর প্রত্যয়ের কাছে নিজেদের ছোটো হতে দেখে যেন ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হল। ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া শুধু তো বুদ্ধের চরণাশ্রিতা একজন নারী মাত্র নয়, সে যে অনাথপিন্ডদের কন্যা। কে অনাথপিণ্ডদ, কি তার পরিচয়? ভিক্ষুজীবনেও পিতৃপরিচয়ের ধারা বজায় রাখে হিসেবি বুদ্ধির লোক।
সমাজের নিচের থাকের একজন লোক, ব্রাত্যজন, সেও মাথা তুলে বড় কাজের দায়িত্ব পালনের ঘোষণা করবে : আর কেমন ধরণের বড় কাজ? যে কাজের সামনে শ্রেষ্ঠী রত্নাকর, সামন্ত জয়সেন, ভূস্বামী ধর্মপাল কুঁকড়ে যাচ্ছেন; সেই ক্ষুধার্ত বিশাল শ্রাবস্তীপুরীর দুর্ভিক্ষ ঘোচানোর কাজ? মেয়েটি কি পাগল হয়ে গেল? না কি, এ একটা অর্বাচীন দায়িত্বজ্ঞানহীন অহংকার?
বুদ্ধ কিছু বলেন না। বলে তো কিছু হয় না। প্রত্যেককে নিজেকে বুঝে উঠতে হয়। হয়ে উঠতে হয়। পরের বচনের উপর নির্ভর করে সত্যি সত্যি কেউ চলে না। সকলেই চলে নিজের উপলব্ধির উপর ভর করে। তার মন, মেধা, বুদ্ধি তাকে যে শলা দেয়, সেই ইঙ্গিতে সে চলে। বুদ্ধ বলেন আত্মদীপ ভব। তুমি নিজে নিজে বোঝো, নিজে নিজে ভাবো।
এইবার ভিক্ষুণী একটা সাংঘাতিক কথা বলবে। সে যে একজন সর্বত্যাগী ভিক্ষুণী সেটা তো সত্য। সেই সত্যের জোরে সে তার ভিক্ষাপাত্র নিয়ে যাবে সকলের কাছে। সকলে সাধ্য মতো ভিক্ষা দেবে এই নারীকে, যে অন্ত্যজের কন্যা। ভিক্ষা চেয়ে বেড়ালে ভিক্ষুণীর সম্ভ্রম ক্ষুণ্ন হয় না।
একজন ধনী মানুষ নিজের ধন বিলিয়ে দিয়ে সর্বত্যাগী হয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে। ধনকুবের হন্যে হয়ে প্রাণের আরাম, মনের শান্তি খুঁজতে নিজের অর্থ সাম্রাজ্য তুচ্ছ করেছেন, এটাও সম্ভব। কিন্তু সাধারণভাবে ধনী কখনোই নিজেকে সকলের সাথে এক পংক্তিতে দেখতে চায় না। ধনের প্রকৃতিই অসাম্য। অন্যের থেকে নিজেকে আলাদা করে উঁচুতে না দেখতে পেলে ধনীর অস্তিত্বের সংকট তৈরী হয়। সেই মানসিক গঠনের জন্যেই শ্রেষ্ঠী রত্নাকর, সামন্ত জয়সেন বা ভূস্বামী ধর্মপাল ভিক্ষুণীর প্রত্যয়ের সামনে নিজেদের আক্রান্ত বোধ করে। সুপ্রিয়ার এই কাজকে তারা অহংকারে মেতে ওঠা বলে চিনতে চায়। সে মেয়ের কাছে কোনো গোপন ভাণ্ডার আছে কি না, সে বাবদে প্রশ্ন তোলে।
মেয়েদের এমন কথা তো শুনতেই হয়। এমন গবেষণা চলে যেখানে প্রতিপাদ্য থাকে যে মেয়েরা প্রকৃতিগত ভাবে দুর্বল ও নিম্নমানের মেধা ও মননের যোগ্য। বলা হয়ে থাকে যে, মেয়ের শরীরী কাঠামো যথেষ্ট ঝক্কি বহনের যোগ্যই নয়। বিজ্ঞানের নামে টেকনিক্যাল কতকগুলি ঝলমলে রাংতা মুড়ে দেখানো হতে থাকে মেয়েরা দ্বিতীয় শ্রেণীর হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স। তারই সূত্র ধরে নারীজন্ম ও নারীমর্যাদার উপর আঘাত হানা হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। মেয়েরা বিজ্ঞানচর্চা করলে, তাকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে অত্যাচার করো, মেয়েরা সাহিত্য লিখলে, ‘ও শুধু মেয়েদের পাঠ্য’ বলে নাক সিঁটকে থাকো, মেয়েরা প্রশাসনের দায়িত্ব নিতে চাইলে নানাভাবে হেয় করো।
এই রকম মনের কাঠামো হতেই সমবেত নাগরিক ভিক্ষুণী সুপ্রিয়ার দিকে তাকায়। কি আছে তোমার? তুমি তো অন্ত্যজের কন্যা? তুমি কি করে এহেন দায়িত্ব পালন করবে? প্রগলভা হয়ো না নারী।
এইবার সুপ্রিয়া যে জবাবটি দেয়, তা অসামান্য। সুপ্রিয়া তার অস্ত্রটি প্রকাশ করে। সেটি একটি ভিক্ষাপাত্র মাত্র। নিজের সামাজিক অবস্থান নিয়ে তার মনে কোনো ধোঁয়াশা নেই। নিজেকে ভুল বোঝানোর কোনো প্রচেষ্টা নেই। সে জানে সে সর্বহারা ভিক্ষুণী। তার উপর সে অনাথ পিণ্ডদের কন্যা। সে যে তথাকথিত সমাজে দীন হীন এবং অক্ষম পর্যায়ভুক্ত, সে কথা তার বলতে লজ্জা হয় না। কেন না সে জানে তার ভিক্ষাপাত্র একটি সামাজিক আন্দোলনের অমোঘ অস্ত্র। সে জানে তার জীবন ইতিমধ্যেই মানবের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনে সে নিশ্চুপে উৎসর্গ করে দিয়েছে। আর এই দেওয়াটা নিয়ে তার কোনো দোলাচল নেই। সকলের সমবেত সাধু উদ্যোগই সমাজকে বাঁচাবার পথ দেখাতে পারে। এ বাবদে যিনি পথিকৃৎ হতে চাইবেন, তাঁকে সকলের কাছে যেতে হবে। সকলের কাছে যাবার জন্য ছোটো হতে হয়। যথার্থ বড়ো হবার অন্যতম রাস্তা এই ছোটো হওয়া। শ্রেষঠী রত্নাকর, সামন্ত জয়সেন বা ভূস্বামী ধর্মপাল ধরনের ব্যক্তি ওই রাস্তা চেনেন না। তাই তাঁদের অগাধ ধন সম্পদও বাস্তব প্রয়োজনের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। এগিয়ে যাবার এই একটাই পথ। সকলের সহযোগিতাকে সমন্বয় করে, সূচিমুখ করে সমসার মোকাবিলা করা। এটা যিনি করতে চান, তাঁকে নিজের ভেতর একটা বড় যুদ্ধে জিততে হয়। নিজের ছোটো আমিকে জগতের বড়ো আমির পদতলে সঁপে দিতে হয়। সুপ্রিয়া এই লড়াইটা লড়ে। ভিক্ষা তার কাছে একটি আন্দোলন হয়ে ওঠে। ব্রতের মতো হয়ে যায়।
বৃহৎ সামাজিক প্রয়োজনের কাছে নিজের সমস্ত রকম অস্মিতাকে এই যে সানন্দে বিলীন করে দেবার ক্ষমতা একটি মেয়ে দেখায়, এর সামাজিক মূল্য বিপুল। এই পথে আলোকযাত্রা। এই পথই যথার্থ শ্রী ও সমৃদ্ধির পথ। এই পথে একটি মেয়ে গোটা নগরের শ্রী ও কল্যাণের মূর্তিমতী অস্তিত্ব হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা “সবলা” : একটি পুনঃপাঠ ( রোজা লুক্সেমবার্গকে মনে রেখে)
১৩৩৫ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে “সবলা” নামে যে কবিতাটি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, সেটি “মহুয়া” কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। সঞ্চয়িতাতেও স্থান পেয়েছে। কবিতার একেবারে সূচনাতেই বলেন “নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার”
একেবারে সোজাসাপটা প্রশ্ন, দয়া নয়, করুণা নয়, সমবেদনা নয়, নারী নিজের দুর্গতি নিজে নিরসন করবে।
মেয়ের মন নিয়ে কবি লিখছেন ” নত করি মাথা
পথপ্রান্তে কেন রব জাগি…” মেয়ে বলছে ” কেন নিজে নাহি লব চিনে
সার্থকের পথ?”
‘সার্থক’ শব্দটার ব্যবহার লক্ষ্য করতে হবে। সফল এক জিনিস। সার্থকতা পূর্ণতর। সুশিক্ষিত আর স্বশিক্ষিত কথা দুটির মধ্যে যেমন এক গুণগত পার্থক্য থাকে, স্বচ্ছল ও স্বনির্ভর এর মধ্যে যেমন ভাবগত পার্থক্য থাকে, ঠিক সেই গুণগত ভাবগত পার্থক্য এঁকে দিয়েছেন ‘সার্থক’ শব্দের প্রয়োগে।
মেয়ে যুদ্ধ করবে। তেজ, দুর্ধর্ষ, দৃঢ়, দুর্জয়, দুর্গম, দুর্গ, প্রাণপণ, বীর্য, দৃপ্ত, রুদ্রবীণা, এই সব শব্দগুলি আছড়ে পড়তে থাকে।
মেয়ে জীবন চায় সম্মান। তার জন্য নিজেকে সে যোগ্য করে তোলে। দয়া নয়, করুণা নয়, সমবেদনাও নয়। সম্মান। বীরের প্রতি বীরের ব্যবহার চায় একটি নারীমন। হ্যাঁ, ‘সবলা’ কবিতায়।
মুসলমানীর প্রেম: একটি রবীন্দ্র গল্পপাঠের অভিজ্ঞতা।
মৃদুল শ্রীমানী।
রবীন্দ্রনাথের ‘দুরাশা’ নামে গল্পটি বেশ মনে আছে। দার্জিলিঙে ক্যালকাটা রোডের ধারে এক মুসলমান মেয়ের সাথে দেৎখা হয় গল্পকথকের। সে মেয়ে এক মুসলমান ভুস্বামীর কন্যা । অন্দর মহল থেকে সে কখনো দেখেছে তাদের বাড়ির হিন্দু প্রতিরক্ষা কর্মীটিকে । হিন্দু লোকটির স্নান, আর নিয়ম পূজা পাঠ সব মিলে তার মনে এক গভীর মায়াময় সম্ভ্রম তৈরি করে দিয়েছিল। মুসলিম মেয়েটির কল্পনার চোখে হিন্দু সিপাহীটি হয়ে ওঠে রক্তমাংসের দেবতা। তারপর বাধল সিপাহী বিদ্রোহ । হিন্দু সিপাহীটি জড়িয়ে পড়লো বিদ্রোহে । তার প্রতি ভেতরের শ্রদ্ধা ভালবাসার টানে ঘর ছাড়লো মুসলিম মেয়ে । মেয়ে সিপাহীটিকে জানে আপন করে। সিপাহীটি তাকে চেনে না। শুধু তার ব্রাহ্মণ্য আর নিয়মনিষ্ঠাকে অতিলৌকিক আভায় রাঙিয়ে একতরফা প্রেমে পথে নামে মেয়ে। যুদ্ধে আহত হয়ে হিন্দু সিপাহী যখন তৃষ্ণায় কাতর , মেয়ে তখন তাকে পরম ভালবাসায় বিপদ মাথায় করে জল এনে দেয়। ওই রক্তাক্ত পরিস্থিতির মধ্যেও হিন্দুয়ানি ছাড়ে নি সিপাহী । মুসলিম মেয়ে কেন জল খাইয়ে তার জাত মারবে? মেয়ের মাথায় কঠিন শক্ত হাতের আরো কঠিন লোহার বালা দিয়ে আঘাত করে সিপাহী । মূর্ছিত হয়ে পড়ে থাকে মেয়ে। কিন্তু হিন্দু নিয়মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ তরুণের প্রতি আস্থা আরো বেড়ে যায় তার। বাপ রে! হিন্দুয়ানি সোজা জিনিস ! কতো জন্মের পুণ্যফলে তা অর্জিত!
মেয়ে আবার খুঁজে চলে তার অন্তরের দেবতাকে । মাথায় পাওয়া কঠিন লোহার আঘাতকে সে দেবতার আশীর্বাদ বলে মনে করে । খুঁজে একদিন পায়। দূর থেকে দেখতে পায় তার রক্ত মাংসের দেবতাটিকে।
তার পর চূড়ান্ত হতাশা। সে হতাশার কথাই ব্যক্ত করেছে মুসলিম মেয়ে গল্পকথকের কাছে।
পরম নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ সমস্ত গরিমা বিসর্জন দিয়ে ভুটিয়া বস্তিতে সংসার পেতে ভুটিয়া স্ত্রী পুত্র সহযোগে ভুট্টা ক্ষেতে ফসল তুলছে । গল্পের নাম দুরাশা । যে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যকে সে পরম ও চরম ভেবে এসেছে, তার এই বাস্তবতা দেখে মুসলমান মেয়ের হৃদয় গুঁড়িয়ে গিয়েছে ।
ভেতরে আমার ছটফট করছে গল্পটি ।
রতন
রতনকে মনে পড়ে আমার। বালিকাটি পোস্টমাস্টারের ঘরের কাজ কর্ম দেখে দিত। বাপ মা হারা দুঃখী মেয়ে রতন। খাওয়া পরার সাংঘাতিক অভাব। না, ছোটো মেয়েটি রাঁধতে সেভাবে পারত না। পোস্ট মাস্টার কোনো মতে নিজেই রেঁধে নিতেন। রতন জল তুলত, বাসন মেজে আনত , আর কাপড় কাচত। সকালবেলার তরকারি রাখা থাকত। রাতে রতন কোনোমতে খানকতক রুটি গড়ত। তাই দিয়ে রাতেও দুজনের খাওয়া চলত। পোস্ট মাস্টারের ঘরে কাজ করে দেবার বিনিময়ে দুবেলা খেতে পেত রতন। পোস্ট মাস্টার ফাঁকা সময় পেলে রতনকে পড়ানোর চেষ্টাও করতেন। কখনো কখনো গল্পও বলতেন। সে সব কথা ছোটবেলায় কে না রবি ঠাকুরের কলমে পড়েছি ?
কলকাতার ছেলে পোস্ট মাস্টার। পাড়াগেঁয়ে এলাকায় পচা ডোবার ধারে তার পোস্ট অফিস। গ্রাম দেশে কি কেবলই ফাঁকা মাঠ? তা তো নয়, যেখানে মানুষের বসতি, সেখানে এঁদো পচা পূতিগন্ধময়। বর্ষাকালে পচা গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে থাকে। গ্রাম্য মানুষের মধ্যেও মন খুলে গল্প করার লোক বিশেষ পান না পোস্ট মাস্টার। রতন ছিল ওঁর গল্পের সঙ্গী। গল্পে গল্পে পোস্ট মাস্টারের বাবা, রতনের মুখে বাবা। তাঁর মা, রতনের মা। পোস্ট মাস্টারের পরিবারে তাঁর সাথে যাঁর যে সম্পর্ক,গল্প করতে করতে রতনের জন্যও তাঁরা তাই।
এমন কি কখনো কখনো মনের অগোচরে পোস্টমাস্টারও ভাবতেন এমন একটি স্নেহপুত্তলি তাঁর নিজের হোক।
পাড়াগেঁয়ে পরিবেশে বিষণ্ন দিন কাটাতে কাটাতে কলকাতার ছেলেটি ম্যালেরিয়ায় পড়লেন।রতন তার আপনজনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। সেবায় যত্নে সেরে উঠলেন পোস্টমাস্টার। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন এই পচা ডোবার পাশে আর নয়। চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে যাবেন তিনি।
রতন জানে, সেও কলকাতায় যাবে তার আপনজনের সাথে। কেননা ওঁর বাপ মাকে সেও বাপ মা মনে করে। দাদা দিদি বৌদিদের নিজের আপন জানে মনে মনে।
কিন্তু কলকাতার ছেলেটি জানিয়ে দিলেন যে রতনের তাঁর সাথে যাওয়া হবে না।
এটা রতনের ভারি বাজল। ফেলে রেখে যাবেন, এমন কথাও তিনি ভাবতে পারলেন?
টাকা নয়, সুপারিশ নয়, কোনো কিছুই আজ তার যন্ত্রণা কমাতে পারবে না। আপনজন তাকে ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছেন, এই বেদনা রতনকে গ্রাস করল।
সে সব দিনে তো রতনের বয়সেই লোকে মেয়ের বিয়ে দিত। পিতামাতাহীন অনাথ মেয়েটি পোস্টমাস্টারকেই জীবনের ধ্রুবতারা জেনেছিল। তাঁর পরিবারকে রতন নিজের পরিবার জেনেছিল। তাঁর আত্মীয়দের নিজের আত্মীয় জেনেছিল। তাঁকে শুধু অন্নদাতা হিসাবে নয়, শিক্ষাদাতা ও আশ্রয়দাতা হিসাবেও জেনেছিল।
কেন কলকাতার লোকটি এতখানি স্নেহ দিয়েছিলেন? কেন কাছে ডেকে বাড়ির গল্প বলতেন, লেখাপড়া শেখাতেন? পোস্টমাস্টার লোকটির
এক অদ্ভুত স্বার্থপর হৃদয়হীন চেহারা ধরা পড়ে রতনের চোখের সামনে।
সেই মানুষটা, যে বর্ষার দিনে কাছে ডেকে পড়তে বসাতো, বাড়ির সবার গল্প করতো, আজ সে এভাবেই ফেলে যাবে? তাহলে কি দরকার ছিল এতদিন এই স্নেহ দেবার? কলকাতার লোকটির স্বার্থপর চেহারাটা আমাদের কাছে বেআব্রু করে দেন রবীন্দ্রনাথ।
সুচরিতা ও তার মাসি
১
সেই যে সেই বিধবাদের গল্প বলছিলাম, আর বলছিলাম মায়ের চাইতে মাসির দরদ বেশি কমের কথা …তো আমাদের গোরা উপন্যাসে সুচরিতা, যার পিতৃদত্ত নাম হল রাধারাণী, যে তার বাপ মা অকালে মারা যেতে ছোটো ভাই সতীশ এর সাথে পিতৃবন্ধু পরেশবাবুর বাড়িতে মোটের ওপর স্নেহে সম্মানে বড় হচ্ছিল, সেই সুচরিতার মাসির কথা বলি।
পরেশবাবু ব্রাহ্ম। কিন্তু তাঁর আচার আচরণে ঋজু সরল ভদ্রতা ছাড়া আর কিছু নেই। শান্ত স্নিগ্ধ সৌম্য মানুষ বললে লোকে যা বোঝে পরেশবাবু মানুষটি তাই। বিপরীতে তাঁর ব্রাহ্মিকা স্ত্রী বরদাসুন্দরী একেবারে জাঁদরেল মহিলা। কোন জিনিসটা ব্রাহ্ম পরিবারে খাটে আর কোনটা খাটে না, এ একেবারে তাঁর কণ্ঠস্থ। তিনি যে পাড়াগেঁয়ে সংকীর্ণ পরিবেশে লেখাপড়ার সংশ্রব না পেয়ে খামোখাই ব্রাহ্ম ভদ্র পরিবারে এসে পড়েছেন, এই বাস্তবতাকে বেশ করে ভুলতে চাইতেন। পরেশবাবু তাঁর স্ত্রীর মেজাজের অন্ধিসন্ধি বেশ জানতেন আর তাঁকে তিনি বিশেষ ঘাঁটাতেন না। গোলমাল থেকে যতটা সম্ভব সাবধানে এড়িয়ে পারিবারিক শান্তিরক্ষা ছিল তাঁর লক্ষ্য।
এই পরিবারে হঠাৎ এসে পড়লেন বিধবা হরিমোহিনী, সুচরিতার আপন মাসি। সুচরিতার এই মাসি মোটের ওপর প্রবীণা। তার উপর শ্বশুরবাড়ি থেকে একরকম বিতাড়িত। এহেন ভদ্রমহিলাকে নিজের ব্রাহ্ম পরিবারে সুচরিতার মুখ চেয়েই আশ্রয় দিলেন পরেশবাবু। ভাবলেন, যত যাই হোক, হিন্দুর ঘরের অসহায় বিধবা, বেচারি যাবেন কোথায় ?
হরিমোহিনীকে পরেশবাবুর বাড়িতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হত। কিন্তু সুচরিতা ক্রমে ক্রমে নিজের মাসির সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক অনুভব করত।
সুচরিতাকে বরদাসুন্দরী বিশেষ দেখতে পারতেন না। তিনি বেশ জানতেন বিয়ের বাজারে যাকে সুন্দরী মেয়ে বলে সেই মাপকাঠিতে সুচরিতা তাঁর পেটের মেয়েদের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে। সেই মনের ক্ষোভে বরদাসুন্দরী কিছুতেই সুচরিতাকে সহজভাবে নিতে পারতেন না। কিন্তু তাঁরই মেয়ে ললিতা সুচরিতাকে অত্যন্ত ভালবাসত। ললিতার ভাষা ছিল শক্ত। সে তার মায়ের অন্যায় আচরণ মেনে নিত না। বরদাসুন্দরী তার এই মেয়েকে বেশ একটু সমঝে চলতেন। ধাক্কাটা গিয়ে পড়ত সুচরিতার ঘাড়ে, আর সেই সূত্রে তার মাসির উপরেও। পরেশবাবু এসব দেখেশুনে সুখের চেয়ে শান্তি ভাল ভেবে সুচরিতার জন্য নিকটেই পৃথক বাড়ি দেখে দিলেন। সে সঙ্গতি অবশ্য সুচরিতার জন্মদাতা পিতা রেখে গিয়েছিলেন। পরেশ ছিলেন তার অছি। নতুন বাড়িতে গিয়ে ক্রমে ক্রমে সুচরিতার বিধবা মাসিটি অন্য রূপ ধরলেন। দুর্বল যদি কখনো ক্ষমতার স্বাদ পায়, সে যে কী হয়ে ওঠে, দেখাতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। একদা দুর্বলের অত্যাচারী রূপ দেখে শঙ্কিত হই।
২
রাধারাণী জানতো সে আর তার সহোদর ভাই সতীশ পিতৃমাতৃহীন। তার পিতৃবন্ধু ব্রাহ্ম ভদ্রলোক পরেশবাবু অত্যন্ত উদার। তিনি পিতৃস্নেহে নিজের সন্তানদের সাথে সমান মর্যাদায় তাদের দুই ভাই বোনকেও পালন করছেন। নানা কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ রাধারাণীর হয় নি। কিন্তু পরেশবাবু নিজের উদ্যোগে তাকে নানা বিষয়ে পুষ্ট করে থাকেন।ছোট ভাইটি স্কুলে যায়।
পরেশবাবু উদার হলেও তাঁর স্ত্রী বরদাসুন্দরী আদৌ উদার নন। বরং তিনি প্রয়াত বন্ধুর সন্তানদুটির প্রতি পরেশবাবুর এই মায়া মমতাকে নিচু চোখেই দেখেন। বন্ধুর অনাথ সন্তানদের প্রতি এই দায়িত্ব পালনকে তিনি বোকামি বলেই বিবেচনা করেন। বরদাসুন্দরী ব্রাহ্মধর্ম বলতে বোঝেন হিন্দুর পৌত্তলিকতাকে প্রাণপণে ঘৃণা করা। কিন্তু এই পৌত্তলিক অভ্যাস ছাড়া হিন্দুয়ানির অন্যান্য বদভ্যাস তিনি নিজের ভিতরে সযত্নে লালন করেন। ধর্মপালন তাঁর মতে কতকগুলি বাঁধা ধরা নিয়ম আর পদ্ধতির অনুবর্তন। নিজের সম্প্রদায়ের বাইরে কোনো সুসভ্য লোক থাকতে পারে এমন ধারণাকে তিনি আমল দেন না। আর যে কোনো কিছু গ্রহণীয় বা মান্য কি নয়, তা বোঝার জন্য ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের আচার অভ্যাসের পক্ষে তা কতটা অনুকূল, সেটাই তিনি একমাত্র বিবেচ্য মনে করেন। তিনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্ম মহিলা হিসেবে রাধারানীকে যথেষ্ট ব্রাহ্ম করে তোলার তাগিদে তার পিতৃদত্ত নাম ছেঁটে সেটাকে সুচরিতা বানিয়ে দিয়েছেন। বাড়িতে ও সমাজে মেয়েটির রাধারাণী পরিচয় লুপ্ত করেছেন। কিন্তু পরেশবাবুকে তিনি এই জায়গায় এঁটে উঠতে পারেন নি। পরেশবাবুকে দেখে ভদ্রতা নম্রতার বাস্তব উদাহরণ মনে হলেও ভেতরে ভেতরে তিনি অত্যন্ত ঋজু। তিনি মেয়েটিকে তার পিতৃদত্ত রাধারাণী নামেই ডাকেন। বরদাসুন্দরী তাকে নানাভাবে হেনস্থা করে চললেও পরেশবাবু তাকে স্নেহভরে “রাধে” বলে ডেকে তার সব কষ্ট ঘুচিয়ে দেন।
একটি ব্রাহ্ম পরিবারে সুচরিতা ও রাধারাণী, এই দুই আলাদা পরিচয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে একটি সুশ্রী মার্জিত মনের মেয়ে।
গোরার মা আনন্দময়ী
১ আনন্দময়ী
আমাদের দেশে এক মহৎ কবি গোরা উপন্যাসে এক অসাধারণ মাতৃচরিত্র সৃজন করেছেন। গোরা উপন্যাসে আমরা কৃষ্ণদয়াল বাবুর দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী
হিসেবে আনন্দময়ীকে দেখতে পাই। আনন্দময়ীর বাবা মা জীবিত ছিলেন না। তিনি ছোটো থেকেই বিশিষ্ট সংস্কৃত পণ্ডিত পরম গুরুজনের কাছে কাশীতে মানুষ হয়েছিলেন। কাশীর সংস্কৃত পণ্ডিতের আশ্রয়ে রুচি ও সংস্কৃতির অভাব ছিল না। আর ছিল ঘরোয়া শিক্ষা। মার্জিত ভদ্র সুস্থ মনের চর্চা। পণ্ডিতের ছাত্রদের কাছে বালিকাবয়সী আনন্দময়ী সুপ্রচুর স্নেহ ভালবাসার পরিবেশ পেয়েছেন। এই স্নেহপূর্ণ পরিবেশ আনন্দময়ীর ব্যক্তিত্ব সৃজনে ও পরিস্ফুটনে সদর্থক ভূমিকা পালন করেছিল। আনন্দময়ীর স্বামী কৃষ্ণদয়াল ছিলেন ব্রিটিশের পদস্থ কর্মচারী। ব্রিটিশের আস্থাভাজন হতে চেয়ে তিনি সনাতনী হিন্দু রুচি ও আচার ত্যাগ করেন। মদ্য মাংসে তাঁর বিলক্ষণ রুচি ছিল। সেকালের নিয়মানুযায়ী নিজের পত্নীকে তিনি অবরোধের মধ্যে রাখেন নি। আনন্দময়ীকে তিনি প্রথার বাইরে গিয়ে সায়া সেমিজ ও জুতা মোজা পরতে উৎসাহ দিতেন। সেকেলে হিন্দুনারীর পক্ষে এ ছিল নিতান্ত খ্রিষ্টানি। কিন্তু এ সবটাই ছিল কৃষ্ণদয়ালের অভ্যাস। আর অনেকটাই ব্রিটিশ প্রভুর আস্থাভাজন হবার ট্যাকটিক্স।
এই সময় সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭) বাধল। রবীন্দ্রনাথ নিজে জন্মেছেন ১৮৬১ সালে। সিপাহীরা ক্ষেপে উঠেছিল। তাদের মূল অভিযোগ ছিল ভারতীয় সিপাহীদের অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনা। ব্রিটিশ সৈন্যদের তুলনায় ভারতীয় সিপাহীদের পাওনা গণ্ডা ছিল নামমাত্র।
কিন্তু সিপাহীদের ক্ষেপে ওঠার আশু কারণ ছিল ধর্মভয়। ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমান অশিক্ষিত সিপাহীরা দীর্ঘদিনের আর্থিক বঞ্চনার রুদ্ধমূখ ক্ষোভের ফেটে পড়ার পরিস্থিতি হল ধর্মীয় অনুষঙ্গে।
ক্ষেপে উঠে সিপাহীরা ব্রিটিশ সৈন্যদের ও ঊর্ধ্বতন সেনাকর্তাদের আক্রমণ করে। বাধ্য ও অনুগত, অদৃষ্টে বিশ্বাসী সরলপ্রাণ ভারতীয় সিপাহীদের এহেন মারমুখী আক্রমণের সামনে প্রথমে ব্রিটিশ সেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এমন কি তাদের ঘরের মেয়ে বউকে পর্যন্ত নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছিল সিপাহীদের হাতে।
পরিকল্পনাহীন, দিশাহীন, সমন্বয়হীন সিপাহীদের একটি অংশ গর্ভবতী মেয়েদের পর্যন্ত আক্রমণ করে।
আমাদের গোরা উপন্যাসের গৌরমোহন এই রকম এক আইরিশ মহিলার সদ্যোজাত সন্তান। কাতর আইরিশ মা কৃষ্ণদয়ালের গৃহবধূ আনন্দময়ীর কাছে শিশুকে রেখে মৃত্যুমুখে পতিত হন। আনন্দময়ী ছিলেন নিঃসন্তান। কিন্তু তাঁর মন ও চরিত্রের গঠন ছিল মাতৃত্বে পরিপূর্ণ।
বিদেশি অপরিচিতা মৃত্যুপথযাত্রিণীকে মুখের ভাষায় নয়, আঁতের ভাষায় আনন্দময়ী কথা দিয়েছিলেন সদ্যোজাত শিশুটিকে সুরক্ষিত রাখবেন।
এই হল গৌরমোহন তথা গোরার জন্মবৃত্তান্ত।
শারীরিক ভাবে প্রসবের সূত্রে মা না হয়েও আনন্দময়ী গোরার মা হয়ে উঠতে আদৌ সময় নিলেন না। কাশীবাসী পণ্ডিতের নাতনির বাধল না ম্লেচ্ছ সন্তানকে বুকে তুলে নিতে। মাতৃত্বের রসে ভরা একটি উদার হৃদয়ের নারী এমন একটি সন্তানেরই অপেক্ষায় ছিলেন।
গোরার চেহারা ছবিতে আইরিশ জিন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কৃষ্ণদয়াল অস্বস্তিতে পড়ছিলেন। তিনি যে ব্রিটিশের অনুগত কর্মচারী। কেন ইউরোপীয় শিশুকে সময়মত সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয় নি, তার যুৎসই জবাব দেবার সহজ স্পষ্ট সরল বুদ্ধি তাঁর ছিল না। তিনি ইংরেজের খিদমতগারির প্রতিদানে বিস্তর রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট পেয়েছিলেন।
রিটায়ারমেন্টের পর কৃষ্ণদয়ালের অদ্ভুত ও বিসদৃশ পরিবর্তন আমরা দেখব। মদ্যমাংসে যাঁর বিলক্ষণ রুচি ছিল, যিনি গৃহবধূকে অবরোধের মধ্যে রাখেন নি, সেই কৃষ্ণদয়াল রিটায়ার করে তেড়ে ফুঁড়ে হিন্দু হয়ে উঠলেন। ফোঁটা তিলক বার ব্রত পূজা উদযাপনে কোনো খামতি রইল না।
গোরা শুরু করল আরেক আখ্যান। সে কলেজে ভালই পড়াশুনা করেছিল। কিন্তু তার নিজের কাছে নিজের পরিচয় ছিল ভারতীয় সনাতনী হিন্দু।
গোরা নিজের জন্মবৃত্তান্ত জানত না। কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ী ছাড়া আর কেউই সে কথা জানত না। অথচ জিনকে তো লুকোনো যায় না। পিতৃপুরুষের অদৃশ্য লিপি থাকে তাতে। গোরার দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা, অপরিসীম মনোবল আর উদ্যম, স্পষ্ট জোরালো জেদালো ভাষণের প্রতি আত্যন্তিক আগ্রহ তাকে অন্য পাঁচটা বাঙালির চেয়ে বিস্তর আলাদা করে দেখাত।
এই জিনগত চেহারা বৈশিষ্ট্য তাকে যতই আলাদাভাবে চেনাত, ততই গৌরমোহন নিজেকে ভারতীয় সনাতনী হিন্দু প্রতিপন্ন করতে অস্থির হয়ে উঠত। সে কিছুতেই ভাবতে পারত না, তার জন্মের ব্যাপারে কিছু রহস্য থাকা সম্ভব। অথচ তার পিতা কৃষ্ণদয়াল যেন তার সঙ্গে কিছুতেই সহজ হতেন না, হতে চাইতেন না। গোরাকে কৃষ্ণদয়াল এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে যেতেন। গোরা তার ধর্মগোঁড়া হিন্দু বাবাকে দেখত। তাঁর ফোঁটা তিলক আচমন জপ তপ বার ব্রতের ঘটা দেখত আর নিজের জোরালো হিন্দু সাম্প্রদায়িক উচ্চকিত ঘোষণা তুল্যমূল্য যাচাই করত, আর কিছুতে বুঝে পেত না বাপ বেটা দুই হিন্দুর এমন জল অচল তফাৎ কিসের।
গোরা যত বুঝতে পারত না, তত গোঁড়া হয়ে নিজেকে বেশি বেশি হিন্দুর সাম্প্রদায়িক খোলসে মুড়তে চাইত। এক অবোলা আইডেন্টিটি ক্রাইসিস তাকে তাড়িয়ে বেড়াত।
এদিকে গোরার ব্রাহ্মণসন্তান সুলভ উপবীতধারণ অনুষ্ঠান হয় নি। আনন্দময়ী চেয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সেধেছিলেন কৃষ্ণদয়াল। তিনি কিছুতেই ভুলতে চাইতেন না যে গোরা এক ম্লেচ্ছ সন্তান।
আনন্দময়ী পড়েছিলেন মাঝখানে। গোরাকে তিনি বুকে করে মানুষ করেছিলেন। প্রকৃত মাতৃহৃদয় থেকে গোরাকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। গোরা আর কৃষ্ণদয়ালের সম্পর্কের টানা পোড়েনে বিধ্বস্ত হচ্ছিলেন আনন্দময়ী।
ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে গোরার সঙ্গে একটি ভদ্র ব্রাহ্ম পরিবারের যোগাযোগ হয়। পরিবারের কর্তা পরেশ ভট্টাচার্য যে গোরার পিতা কৃষ্ণদয়ালের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ক্রমে তাও জানা গেল। ব্রাহ্ম পরিবারটিতে মেয়েদের শিক্ষা এবং সংস্কৃতিচর্চার ব্যবস্থা ছিল। তারা পরিবারের বাইরের পুরুষদের সামনে অসংকোচে বের হতে জানত এবং আলাপ আলোচনা তর্ক বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে তাদের বাধত না। সমপাঠী বিনয়ের সূত্রে গোরা প্রথমে পরেশবাবুর সাথে পরিচিত হয় ও পরে তাঁর কন্যাদের চাক্ষুষ করে।
গল্পের ধারাবাহিকতায় ওই ব্রাহ্ম পরিবারের বড়ো মেয়েটিকে দেখেই গোরা ভালবেসে ফেলে। এভাবে মেয়েদের ভালবেসে ফেলা চলে, গোরা কোনোদিন ভাবতে পারে নি। কিন্তু পুরুষের পক্ষে উপযুক্ত নারীর হৃদয়ের টান যে শুধুমাত্র মোহ নয়, গোরা তার অন্তর দিয়ে বুঝতে পারে।
সাধারণভাবে গোরার সাথে সুচরিতার ভালবাসার কোনো পরিণতিই হতে পারত না। কিন্তু গোরা যখন দেখল তার মা সুচরিতাকে আপন করে নিয়েছেন আর সমস্ত সাম্প্রদায়িক গণ্ডির বাইরে দাঁড়িয়ে কেবলমাত্র মানুষ বলেই মানুষকে ভালবাসা দিতে এগিয়ে এসেছেন, তখন গোরার এক উত্তরণ ঘটে। নিজের জন্ম রহস্য সে জানতে পারে। তথাকথিত সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় নিগড়ের বহু উচ্চে সে নিজেকে খুঁজে পায়। তার মা আনন্দময়ী তাকে এই নিজেকে খুঁজে পাওয়ার পথে দীক্ষা দেন। এই মাকেই সে ভারতবর্ষ হিসেবে উপলব্ধি করে, যে ভারত সর্বমানবের।
২ সাংসারিক সংকট ও আনন্দময়ী
আনন্দময়ী তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী। কৃষ্ণদয়াল তাঁর যৌবনে মদ্য মাংসে বিলক্ষণ রুচি প্রকাশ করেছেন। তাঁর বিলিতি মালিকেরা তাঁর বিলিতি আচার অভ্যাসে বিগলিত ছিলেন। অবসরের পর এই কৃষ্ণদয়াল কি করে এতখানি পালটে গেলেন, অবাক হয়ে লক্ষ্য করতে থাকেন আনন্দময়ী। স্ত্রীসঙ্গ দূরে থাক, বাড়ির মধ্যে একটা জায়গা আলাদা করে “সাধনাশ্রম” লিখে বোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছেন। বার ব্রত উপবাস আচার অভ্যাসের আর কোনো সীমা নেই। এদিকে কোলে তুলে নিয়ে পুত্রের সম্মানে স্নেহে যাকে মানুষ করলেন সেই গোরাই বা কি করছে! সে যেন পণ করেছে আচারে বিচারে ফোঁটা তিলকে গঙ্গাস্নানে পরম নৈষ্ঠিক হিন্দুকেও হার মানাবে সে। অথচ তার জন্ম বৃত্তান্ত তাকে জানাতে চান না মা। কত কষ্ট করেই যে তিনি তাকে সবার গঞ্জনা অবছেদ্দা সয়ে বড়টি করে তুলেছেন। নিজের ঘরে হিন্দুয়ানির উৎকট দু দুটো দৃষ্টান্ত দেখে গুমরে মরেন আনন্দময়ী।
৩ দু্ঃখ বিজয়িনী আনন্দময়ী
নিজের পেটের সন্তানকে যেভাবে মানুষ ভালবাসে, সেই মাতৃহৃদয় থেকেই হিন্দু জাগো আন্দোলন নিয়ে মাতামাতি মাকে আশঙ্কিত করেছিল। হুজুগ তো ভাল নয়। ভাল নয় অসহিষ্ণুতা। নিজের সন্তানের মধ্যে এই অসহিষ্ণুতা দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়তে থাকেন মা। স্বামী, পরিবার, এমন কি সন্তান স্নেহে যাকে বড়ো করে তুলেছেন, সত্যের আহ্বানে তারও বিরুদ্ধতা করতে তাঁর বাধে নি। গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে শত অবজ্ঞা সয়েও মাথা উঁচু রাখেন তিনি। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের বিপরীতে মহৎ সত্যের আহ্বান কান পেতে শুনতে জীবন বাজি রেখেছেন তিনি। সত্যকে আঁকড়ে ধরতে চেয়ে হয়ে উঠেছেন আনন্দময়ী। স্বার্থ, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যকে অনেক পিছনে ফেলে আনন্দের প্রকাশ। সত্যের সপক্ষে, অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই লড়তে লড়তে যথার্থ মা হয়ে ওঠেন আনন্দময়ী।
৪ বিনয়ের বিয়ে
বন্ধুকে ভালবাসতে গিয়ে কি মারাত্মক বিপর্যয় ই না ঘটাতে যাচ্ছিল একটি উচ্চশিক্ষিত প্রাণবন্ত যুবক। বন্ধু তার সহপাঠী ও অত্যন্ত অন্তরঙ্গ। এমন কি নিজের মা বাবা নেই বলে সে বন্ধুর মাকে ‘মা’ বলে ডাকে। প্রায় সময় বন্ধুর বাড়ি যায়, থাকে, খায়। কিন্তু কয়েকদিন হয় বন্ধুটি নিজের মত সাংঘাতিক ভাবে তার উপর চাপিয়ে দিতেন। বন্ধুর প্রতি স্নেহে অনুরাগে আর অনেকটা যেন আনুগত্যে সে মেনেও নিত। কিন্তু শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত মনের একটা বৈশিষ্ট্য হল ভেতরে ভেতরে যুক্তিবিচার করা। এটা যেন মগজের ভেতর হয়ে উঠতেই থাকে। ক্রমশঃ সে টের পায়, বন্ধু আর বুঝি বন্ধু নয়, সে প্রভু হয়ে উঠছে।
এই সময়েই একটি শিক্ষিত ব্রাহ্ম পরিবারে সে যাতায়াত করত। অনেকটাই সেই পরিবারের কর্তার রুচিশীল উদার স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে, আর তার চেয়ে বেশ বেশি ভাবেই ভদ্রলোকের সুন্দরী ও আকর্ষণীয় মেয়েদের জন্য। এমন মেয়ে সে কখনো দেখেনি। নারীত্বের তনুলতায় কমনীয়তার বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই, অথচ কি সহজ সাবলীল স্বচ্ছন্দ মেয়েগুলি ! বাঙালি শিক্ষিত যুবা যেন যুগে যুগেই এরকম সহজ সুন্দরীকে পেতে চেয়েছে। মেয়েগুলি যেমন সুন্দর, তাদের নামগুলিও খুব রুচিপূৰ্ণ। আর সেই ব্রাহ্ম পরিবারে শিক্ষিত মার্জিত যুবকের সাথে বেশ আলাপ গল্প করতে দিতে বাবা মায়ের তরফে কোনো সমস্যা নেই।
বন্ধুটির উপর খুব রাগ হচ্ছিল, যখন সে এমন একটি আলোকপ্রাপ্ত সুন্দর পরিবারের মেয়েদের সাথে মেলামেশাকে টিপ্পনী কাটতে শুরু করল। বন্ধুটি বিজ্ঞ, কিন্তু তার বিনয়ের দিকটি বিশেষ কম। বেশ গোঁড়া হয়ে উঠতে চাওয়া মানুষ। বন্ধু হয়ে উঠতে চাচ্ছে প্রভু।
কিন্তু বন্ধুকে কি ছাড়া যায়? তাহলে সে কি করবে? ব্রাহ্ম পরিবারটিতে আর যাবে না ? যে মেয়েগুলির হাসিখুশি বুদ্ধিদীপ্ত মুখগুলি সে শয়নে স্বপনে দেখতে পায়, তাদের অনায়াস সঙ্গ ভুলে যাবে?
সে রাজি হল প্রচণ্ড হিন্দু গোঁড়া হয়ে উঠতে চাওয়া বন্ধুটির ভাইঝি শশিমুখীকে বিয়ে করতে। সে জানে শশিমুখী নেহাত বালিকাটি। এমন কি শৈশবে মেয়েটিকে কোলেও নিয়েছে সে। এমন একটি বালিকাকেও সে বধূ হিসেবে ভাবছিল, শুধু সাঙ্ঘাতিক গোঁড়া হয়ে উঠতে থাকা বন্ধুটির সাথে সম্পর্ক রাখবে বলেই।
শশিমুখী নয়। গৌরমোহনের সাথে বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব টিঁকিয়ে রাখতে নিজের যৌবনকে জলাঞ্জলি দিতে চায় সে।
বাদ সাধলেন বন্ধুর মা। আনন্দময়ী। প্রশ্ন তুললেন যৌন কমপ্যাটিবিলিটির। আলোকপ্রাপ্ত মার্জিত যুবকের পক্ষে একান্ত বালিকাকে বধূ হিসাবে গ্রহণ করা অন্যায় হবে। বিবাহ হবে সমযোগ্য মানুষ এর মধ্যে। নইলে সে একটা বিশ্রী ব্যাপার। মনের মধ্যে আলো ধরেন রবীন্দ্রনাথ।
বিশ্ব মাতৃদিবস উপলক্ষে আনন্দময়ী মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি।