পর্ব – ১৩৫
রমানাথ বললেন, গতকাল দিনটা যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবে শেষ হল না। সমস্ত জিনিসটা উল্টোপাল্টা হয়ে গেল।
শ্যামলী বলল, আজও কিন্তু আপনার বাড়িতে অনুষ্ঠান। ব্রাহ্মণরা নিমন্ত্রিত। আসবেন। সিধা পাবেন। খাবেন।
রমানাথ বললেন, সব লোকজন ঠিক করা আছে। মা আমার উপর আর ভরসা রাখেন নি। আশ্রমের উপর সব ভার দিয়েছেন।
শ্যামলী বলল, সে তো আগে থেকেই ছিল।
রমানাথ বললেন, তবে আগে ওঁরা ছিলেন নেপথ্যে। এবার প্রকাশ্যে। কার বাবার শ্রাদ্ধ হচ্ছে কেজানে।
শ্যামলী বলল, এটা আপনার বলা ঠিক হল কি? জ্যাঠামশাই আপনার বাবা হলেও জ্যেঠিমার তিনি স্বামী। তর্কের খাতিরে বলতে আমি বাধ্য যে জ্যাঠামশাই আপনার বাবা হবার আগে জ্যেঠিমার স্বামী হয়েছিলেন।
রমানাথ বললেন, তুমি সমস্ত জিনিসকে এত সহজ করে দেখতে পারো কি করে?
শ্যামলী বলল, আসলে কোনো জিনিসটাই জটিল নয়। আমরা জটিল ভেবে ফেলি।
রমানাথ বললেন, আমার মায়ের ওপর তোমার কোনো রাগ হচ্ছে না?
শ্যামলী বলল, একটুও না। ওঁর জায়গায় গিয়ে ভাবলে বুঝতে পারবেন, উনি একেবারে ঠিক ঠিক কাজ করেছেন।
রমানাথ বললেন, শ্যামলী তোমাকে যতই দেখি আশ্চর্য হয়ে যাই।
শ্যামলী বলল, ভাগ্যিস বলেন নি, তুমি ফিরে ফিরেই নূতন, তুমি বারে বারেই নূতন।
রমানাথ বললেন, কি মুশকিল, আমি যে ওই কথাটাই বলব ভাবছিলাম। তুমি জানলে কি করে?
শ্যামলী বলল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে দিয়েছেন।
রমানাথ বললেন, কাল একটিবার তোমাকে রেগে যেতে দেখেছি। চামেলি পিসিকে তুমি বললে, রমানাথকে আমি বিয়ে করব না। তুমি খুব রেগে গিয়ে বলেছিলে, না?
শ্যামলী বলল, ওহো মিস্টার নন্দী, সেই জন্যে আপনার রাতে ঘুম হয় নি, সকাল হতেই আপনি সব কাজ ফেলে এখানে চলে এলেন?
শ্যামলীর মা একটু দুধ আর একটু খই আর দুটো কাঁঠালি কলা এনে টেবিলে রাখলেন। বললেন, সেই কোন্ সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছ, এগুলো খাও। আমি জানি এই খাবারে কোনো দোষ নেই। এই পাশেই কল ঘরে বেসিন আছে। হাতে সাবান দিয়ে ধুয়ে নাও। শ্যামলী দে না মা ওকে একটা নতুন সাবান বের করে।
শ্যামলী উঠল না।
রমানাথ বলল, আমি খুঁজে নিচ্ছি।
হাত ধুয়ে এসে রমানাথ দেখল শ্যামলী বিছানার উপর মেরুদণ্ড সোজা করে চোখ বুজে বসে আছে।
রমানাথ তাকে দেখে বললেন, ধ্যান করছ না কি?
শ্যামলী চোখ বুজে থেকেই বলল, ভাবছি।
রমানাথ বললেন, কি ভাবছ?
শ্যামলী বলল, শনিগ্রহের কথা।
রমানাথ আশ্চর্য হয়ে বললেন, শনিগ্রহ নিয়ে নতুন করে ভাবনার কি আছে?
শ্যামলী বলল, শনির ওই যে বলয়, যার কারণে শনি দেখতে এত সুন্দর তা কিন্তু চিরকাল থাকবে না।
রমানাথ বললেন, কোনো কিছুই চিরকাল থাকে না।
শ্যামলী বলল, তবুও মানুষ ভাবে, সব কিছু ঠিকঠাক থাকবে।
মানুষ খালি চোখে দেখে জানত শনিগ্রহের পর সব অজানা। তারাগুলো যে আরো অনেক অনেক বেশি দূরে, তা মানুষ ঠিক মতো জানতই না। এমন সময় হার্শেল আর তাঁর বিদুষী বোন ক্যারোলিন আবিষ্কার করেছেন ইউরেনাস। সেটা ১৭৮১ সাল। কিন্তু ইউরেনাসের চলন অঙ্কের হিসেবে যেমনটি হওয়া উচিত ছিল, তেমনটি বাস্তবে হচ্ছিল না বলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা চিন্তিত ছিলেন। কেউ কেউ আন্দাজ করেছিলেন আরেকটি গ্রহ থাকতে পারে, যার টানে ইউরেনাসের চলনের গোলমাল হয়। প্রায় পঁয়ষট্টি বছর পর ১৮৪৬ সালে জোহান গেল নেপচুন আবিষ্কার করেন।
অবশ্য ১৮৪০ সাল নাগাদ বিজ্ঞানী আরবেন ভেরিয়ার বলে রেখেছিলেন কোনো একটা গ্রহের কথা। আর ক্লাইড টমবাও ১৯৩০ সালে খুঁজে পেলেন প্লুটোকে। ততদিনে নেপচুন আবিষ্কারের বয়স পঁচাশি। আমাদের চিন্তার পরিধি নিয়মিত পালটে পালটে যাচ্ছে।
রমানাথ বললেন, আমি যে কারণে ছুটে এলাম, সেটা নিয়ে যদি বলতে!
আপনার ছুটে আসার দুটো কারণ আমি জানি। এক হচ্ছে, আমি কাল বলেছি আপনাকে বিয়ে আমি করব না। দ্বিতীয় হচ্ছে,
রমানাথ বললেন, তোমার জন্য দুশ্চিন্তা ছিল।
শ্যামলী বলল, না, তাহলে আপনি সকালে ফোন করে খোঁজ নিতেন। আপনার ছুটে আসার দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে, আমার ঘোষণাটা স্থির কি না।
রমানাথ বললেন, তুমি একটিবার বলো না, রেগে গিয়ে মুখ ফসকে তুমি বলে ফেলেছ?
শ্যামলী বলল, আচ্ছা রমানাথ, বিয়ে জিনিসটা আপনার কাছে ঠিক কি?
রমানাথ বললেন, একটা পবিত্র সম্পর্ক।
শ্যামলী বলল, উঁহু, মা ছেলের সম্পর্ক কি কম পবিত্র? পিতা পুত্রের? ভাই বোনের? আমাদের শাস্ত্র কোন্ সম্পর্কটাকে অশ্রদ্ধেয় বলেছেন?
রমানাথ বললেন, আশ্চর্য তো, বিবাহ একটা পবিত্র সম্পর্ক নয় বলতে চাও?
শ্যামলী বলল, বিবাহ সম্পর্ক আমাদের শাস্ত্রকারদের বিচারে বেশ কয়েক রকম। দৈব, ব্রাহ্ম, আর্ষ, প্রজাপত্য, গান্ধর্ব, আসুরিক, রাক্ষস ও পৈশাচ, এই আট রকম বিবাহের কথা হিন্দু শাস্ত্র বলেন। তো নন্দী মশায়, আপনি কোন্ বিবাহের কথা বলছেন?
রমানাথ বললেন, দ্যাখো, আমাদের বাঙালি ঘরে যে বিবাহ চলে, যা চলে আসছে, আমি ঠিক সেই বিবাহকে পবিত্র সম্পর্ক বলছি।
একটু অপেক্ষা করে রমানাথ আরো বললেন, বিষয়টা কি এতটা জটিল?
শ্যামলী বলল, না। আদৌ জটিল নয়। আমাদের বাঙালির ঘরে, ছোটলোকের ঘরের কথা তুলছি না, বর্ণশ্রেষ্ঠ কুলীন ব্রাহ্মণদের কথা বলছি, তাঁরা অনেকগুলি করে বিয়ে করতেন। তারপর কচি কচি শিশুদের বিয়ে করতেন, যাদের এমনকি যৌনতার কোনো বোধই তৈরি হয় নি। কাপড়টা পর্যন্ত পরিয়ে দিতে হয় যে বয়সের বাচ্চাদের, তেমন পঞ্চমবর্ষীয়া কন্যাকে পাত্রস্থ করাকে বলা হত গৌরীদান। আর তাতে নাকি কন্যাদাতার প্রচুর পুণ্য হত। এই বিবাহকে আপনি পবিত্র সম্পর্ক বলতে চান তো?
শশাঙ্ক পাল ঘরে ঢুকলেন। রমানাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কি তোমাদের আলোচনায় যোগ দিতে পারি?
রমানাথ বললেন, আমাদের আলোচনার একমাত্র বক্তা হচ্ছেন শ্যামলী। আমি টুকটাক প্রশ্ন তুলছি মাত্র।
শশাঙ্ক পাল মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি রে, আমি যদি বসে শুনি, তাতে কি তোর আপত্তি আছে?
মেয়ে বলল, বাবা, মিস্টার নন্দী বিবাহকে পবিত্র সম্পর্ক বলতে চাইছেন, আর আমি বিবাহ সম্পর্কে হিন্দুদের পুরাণ মহাকাব্য থেকে কিছু নজির টেনে আলোচনা করতে চাই।
শশাঙ্ক বললেন, তা বেশ তো, গতকাল শুনলাম পুরুতঠাকুর দুজনকে গীতার শ্লোক কখানা বলে অবাক করে দিয়েছিস। তো আজ হিন্দু শাস্ত্র নিয়ে দুচারটে কথা শুনে রাখি।
শ্যামলী বলল, আমি বিয়ের আলোচনা শুরু করব সেরা ব্রাহ্মণ দিয়ে।
শশাঙ্ক বললেন, কে তোর সেরা ব্রাহ্মণ?
শ্যামলী বলল, বাবা, ব্রাহ্মণ কথাটার গোড়ায় গেলে ব্রহ্মাকে পাবে।
শশাঙ্ক বললেন, বেশ। ব্রহ্মা আমাদের হিন্দুদের তিনটি মোস্ট ইমপরট্যান্ট দেবতাদের একজন। তো শোনা তার বিয়ের গল্প।
শ্যামলী বলল, দেবী সরস্বতী উদ্ভূত হয়েছিলেন কৃষ্ণের কণ্ঠ থেকে। তো সেই অর্থে সরস্বতীকে কৃষ্ণের কন্যা বলতে হবে। তো সরস্বতী কৃষ্ণকে কামনা করে বসলেন। কৃষ্ণ কি করে কন্যাস্থানীয়া সরস্বতীর সাথে বিহার করবেন? তিনি কায়দা করে দেখিয়ে দিলেন চতুর্মুখ ব্রহ্মাকে। সরস্বতী ব্রহ্মাকে বিবাহ করলেন।
সবিতাপিসি শশাঙ্কের জন্য চা বিস্কুট এনেছিলেন। তিনি বললেন, এই শ্যামলী, বিহার মানে কি রে?
শ্যামলী বলল, বিহার মানে সেক্স রিলেশন।
সবিতা বললেন, ছি ছি, বাপের সামনে বসে বসে এইসব বিচ্ছিরি কথা বলছিস্! দাদা, তুমি মেয়েটাকে একটু শাসন করতে পারো না?
শশাঙ্ক হেসে বললেন, ষোলো পেরোলে ছেলেমেয়েদের বন্ধু ভাবতে হয়। তা শ্যামলী যে আমার সাথে বন্ধুর মতো গল্প করছে, এতো ভালো জিনিস। আর ও তো সুন্দর একটা শব্দ বাছাই করে বলল।
সবিতা রাগ দেখিয়ে বলল, দাও না, আরো লাই দাও। আমার কি, মেয়ে তোমাদের, যা ইচ্ছে করো।
রমানাথের দিকে তাকিয়ে শশাঙ্ক বললেন, তুমি একটু চা খাবে না কি?
সবিতা বলল, এই সময় ওদের চা খেতে আছে কি না, সে তো আমি জানি না।
শশাঙ্ক বললেন, নকুড়দাদার চায়ের নেশা ছিল বেশ। তা এককাপ চা খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
সবিতা বললেন, দুধ গরম করেছি। এনে দেব?
রমানাথ বললেন, না না এই একটু আগে খই দুধ খেয়েছি। কাকিমা দিয়ে গেলেন। আর এখন দুধ খাব না।
শশাঙ্ক সবিতাকে বললেন, ওরে, তুই রমার জন্য দুধই আন্, তবে তাতে চা মিশিয়ে আনবি।
সবিতা শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে, তুই দাঁত মেজেছিস্?
শ্যামলী বলল, না। এই মাজব।
সবিতা বললেন, দ্যাখো দাদা, ও এই বাসি মুখে ঠাকুর দেবতা নিয়ে কথা বলছে। আর তুমি বসে বসে শুনছ।
শশাঙ্ক পাল মেয়েকে বললেন, তো নেক্সট গল্পটা দাঁত ব্রাশ করে এসে বল্। মেয়েকে উঠতে বলে তারপর রমানাথকে বললেন, চলো আমার ঘরে চলো। ও ফ্রেশ হয়ে নিক। অন্যদিন খুব সকালে তৈরি হয়ে যায়। আজ কোনো কারণে একটু অন্য রকম।
ফ্রেশ হয়ে একটা শার্ট প্যান্ট পরে বাবার ঘরে এল শ্যামলী।
শশাঙ্ক বললেন, কোথাও বেরোবি না কি?
শ্যামলী বলল, চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আগে ব্রাহ্মণদের বিয়ের আরেকটা গল্প বলি। ব্রহ্মার মানসপুত্র ছিলেন পুলস্ত্য। সরস্বতীর একটি নাম মানসী। তো মানসপুত্র বলতে অনেক কিছুই ভাবতে পারো। আমি কিন্তু বায়োলজিক্যাল বেবি ধরে নিচ্ছি।
শশাঙ্ক বললেন, বেশ। তারপর।
শ্যামলী বলল, তো এই পুলস্ত্য হচ্ছেন সপ্তর্ষির এক ঋষি। তার ছেলে বিশ্রবা। তিনি এমন যে বেদপাঠ করতে করতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। ওইজন্য নাম হয়েছিল বিশ্রবা। ভেবে দেখো কি সাংঘাতিক ব্রাহ্মণ। তো কৈকসী, যার অন্য নাম নিকষা, তার খুব ইচ্ছে ছিল সদ্ ব্রাহ্মণের ঔরসে তার গর্ভে সুসন্তান হোক।
শশাঙ্ক পাল বললেন, মা হিসেবে মোটেও খারাপ ইচ্ছে নয়। তারপর?
মেয়ে বলল, তারপর আর কি? চারটি রাক্ষস সন্তান জন্মাল। রাবণ, কুম্ভকর্ণ, শূর্পনখা আর বিভীষণ।
শশাঙ্ক বললেন, কিন্তু মুনির সন্তান হল রাক্ষস, বলিস্ কি? কেন?
শ্যামলী বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, সেই প্রশ্ন তো কৈকসীও করলেন বিশ্রবা মুনিকে। হে মুনিঠাকুর, আমার গর্ভে সব রাক্ষস জন্মাল কেন?
শশাঙ্ক পাল বললেন, তখন বিশ্রবা মুনি কি বললেন?
শ্যামলী বলল, মুনিঠাকুর কৈকসীকে বললেন, দ্যাখো, তুমি প্রদোষকালে, মানে সন্ধ্যাবেলায় বিহার করেছিলে তো, তাই সব রাক্ষস হয়েছে। কৈকসী তো মুনির পায়ে লুটিয়ে আছাড়িপিছাড়ি খেতে খেতে কাঁদছেন। চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। তার অতো কান্নাকাটি দেখে বিশ্রবা মুনির একটু দয়া হল। বললেন, নাও নাও ওঠো। আচ্ছা, অতো কাঁদছ যখন, তোমার একটা সন্তানের মধ্যে ধর্মভাব থাকবে। কৈকসীর সেই একমাত্র ধর্মভাবসম্পন্ন সন্তান হলেন বিভীষণ। ওকে আমাদের সমাজে ঘরশত্রু বলা হয়।
রমানাথ অবাক হয়ে বললেন, কি আশ্চর্য, সব দায় মায়ের, বাবা হিসেবে বিশ্রবা মুনি অন্য কিছু করতে পারতেন না? প্রদোষকালে সেক্স করলে রাক্ষস জন্মায় ওঁর জানা থাকলে, তা তিনি করলেন কেন? এই কি জ্ঞানী ব্যক্তির পরিচয়?
শ্যামলী বলল, নন্দীবাবু, দিস ইজ় ইওর ভারি পবিত্র সম্পর্ক।
শশাঙ্ক রমানাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, রমা, তোমাকে আজ আর আটকাব না। তোমার বাড়িতে সবাই নিশ্চয়ই তোমার পথ চেয়ে আছেন। দেরি দেখলে তাঁরা বিরক্ত হবেন।
রমানাথ চলে যাবার সময় শ্যামলী তাকে এগিয়ে দিতে গেল গেট অবধি। গাড়ি যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা গেল সে হাত নেড়ে গেল।