পর্ব – ১২৫
বাবা বললেন কেমন করে হিংয়ের কচুরি করবি শুনি?
মেয়ে বলল, এই যে কলাইয়ের ডাল ভিজিয়ে বেটে রাখা আছে। বাটার সময়েই কাঁচালঙ্কা মিশিয়ে বেটে রেখেছিল। এবার কড়ায় তেল ঢেলে তাতে একটু হিং দিচ্ছি। মৌরি দিচ্ছি। এরপর এই ডালবাটা দিয়ে দিলাম। একটু নুন দিলাম। এবার নাড়ছি। একটু বাদেই কচুরির পুর তৈরি হয়ে যাবে।
গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে । গন্ধই টেনে এনেছে শান্তু অন্তু দুই ভাইকে। সবিতাপিসি ওদের সামনে প্লেট সাজিয়ে দিল। বাটিতে ঘুগনি দেওয়া মাত্র চামচে করে তুলে মুখে পুরতে শুরু করল অতনু। বাসন্তীবালা তাকে বললেন ও কি, কচুরি কটা ভাজুক, তারপর তো দেবে! মায়ের কথা সে কোনো দিনই কানে নেয় না, আজও নিল না।
তারপর বাসন্তীবালা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই বা কেমনধারা মেয়ে, চটপট ভাজবি তো?
শ্যামলী বলল, মা, ওটা স্টার্টার। এরপর আলুরদম আছে। তুমি মোটেও চিন্তা কোরো না।
কয়েকটা কচুরি ভাজা হতে সবিতা ওদের পরিবেশন করা শুরু করল। সাথে দিল আলুরদম।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তোর রান্নার হাতটা যে চমৎকার হয়েছে রে?
মেয়ে বলল বাবা, রান্নাঘর জিনিসটা আসলে কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরি। ঠিক মতো ভাজা হলে, নুন মশলা ঠিক পরিমাণে হলে, খেতে ভাল হবে। ওই ধারণাটা তৈরি হয়ে গেলে অসুবিধা হয় না।
বাসন্তীবালা মেয়েকে ধমক দিলেন, বকবক করতে হবে না। উনুন সামনে রেখে বকবক করতে নেই।
শান্তনু অতনু চটপট মুখ চালাচ্ছে। তাদের চাইতে একটু বেশি গতিতে হাত চালাচ্ছেন সবিতা।
শশাঙ্ক পাল বললেন, কলকাতায় হাতিবাগানে স্টার সিনেমার পাশে কচুরি খাওয়াতেন তোর অনসূয়া দিদির বাবা। বড্ড দিলদরিয়া মানুষ ছিলেন। কোনো কোনোদিন কলেজ স্কোয়ারের কাছে মির্জাপুর সিটি কলেজের পাশে পুঁটীরামের দোকানে কচুরি খাওয়াতেন। নর্থ ক্যালকাটায় অনেক ভাল ভাল খাবারের দোকান। ভীম নাগের সন্দেশ কত খেয়েছি। নকুড়ের সন্দেশ।
অতনু বলল, বাবা শুধু গল্প শোনাবে না বলে দিচ্ছি। তার খাওয়া শেষ হয়ে এসেছে দেখে শ্যামলী বলল, শেষ পাতে রাবড়ি আছে। উঠে যাবে না কেউ। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শশাঙ্ক বললেন, তুই আবার রাবড়িও এনেছিস? শ্যামলী হাসল। বাবা, তুমি লেখক শিব্রাম চক্রবর্তীর নাম শুনেছ? তিনি কলকাতার মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে থাকতেন। শিব্রাম বনেদি জমিদার বাড়ির ছেলে। কিন্তু সব ছেড়ে ছুড়ে সামান্যভাবে থাকতেন। মিষ্টি খেতে বড্ড ভালবাসতেন। মিষ্টির মধ্যে রাবড়ি ছিল তাঁর ফেভারিট।
অতনু বলল দিদি, তোর অঙ্ক নিয়ে পড়াটা ঠিক হয়নি।
শশাঙ্ক পাল বললেন, কেন?
অতনু বলল, দিদি এমন চমৎকার করে বলতে পারে, ইতিহাস বা বাংলা নিয়ে পড়লে ভাল মাস্টারি করতে পারত।
শশাঙ্ক পাল বললেন, যাক্, তোর দিদির গুণগান একটু হলেও করলি বলে ভাল লাগল।
শ্যামলী বলল, বাবা রাবড়ির কথা বলছিলাম, শিব্রাম রাবড়ি এত ভালবাসতেন যে হরলিক্সকে রাবড়িচূর্ণ বলতেন।
শশাঙ্ক পাল বললেন ওই যে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট বলছিস না, ওখানে বল বেয়ারিংয়ের মার্কেট। সব পর পর বল বেয়ারিংয়ের দোকান। খুব ঘুরতাম ওই সব জায়গায়। চোখ বুজলে ছবির মতো দেখতে পাই।
অতনু বলল, রাবড়ির গল্প বলতে বলতে আমাকে আর একটু দাও। বাসন্তীবালা মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, অন্তু কি হচ্ছেটা কি? আমরা খাব না বুঝি? শ্যামলী শান্তুকে খানিকটা দিয়ে বাকি সবটা অতনুর বাটিতে ঢেলে দিল।
শশাঙ্ক পাল বললেন, ও কি রে, তোদের একটু রাখলি না?
শ্যামলী হেসে বলল, বাবা, আজ আমার জন্মদিন!
বাসন্তীবালা লজ্জায় জিভ কেটে বললেন, সাত ঝামেলায় একদম ভুলে গিয়েছি। সত্যিই তো, আজই তো সতেরই কার্তিক। তোর জন্মদিন।
শ্যামলী বলল, ওইজন্য তোমাদের রেঁধে খাওয়ালাম।
অতনু বলল, দিদি অঙ্কের কোনো কায়দায় বছরে দু তিনবার করে জন্মদিন হয় না?
সবিতা বলল, আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি অবস্থাপন্ন ঘরে শুধু ছেলেদের জন্মদিন হত। মায়েরা গলায় আঁচল জড়িয়ে পিদ্দিম জ্বালিয়ে শাঁক বাজিয়ে…
শ্যামলী বলল, পিসি কথাটা শাঁক নয়। বলো শাঁখ। শঙ্খ থেকে শাঁখ।
সবিতা বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা, অতো ভুল ধরতে হবে না। তো মায়েরা শাকভাজা, মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল, আর চালের পায়েস দিত। মেয়েদের ওসব হত না।
বাসন্তীবালা বললেন, সে কি, আমি বেশ দেখেছি, সন্ধ্যেবেলা জলখাবার দেবার সময়ে মা দুটি মণ্ডা ধরিয়ে দিত।
সবিতা বললেন, তাই তো আমি বললাম, ছেলেদের একরকম, আর মেয়েদের একরকম। আর আমার যে জন্মদিন কবে, সেটাই মা আমায় বলে যায় নি। লোকের ছেলেমেয়েদের জন্মদিন হয়, বিয়ের বছরকি হয়…
শ্যামলী বলল, পিসি বছরকি বলে কোনো কথা হয় না, বার্ষিকী বলো।
সবিতা বলল হ্যাঁ, ভুল ধরার জন্য একটা মানুষ তোর রয়ে গেল।
অতনু বলল, দিদি, গাধা পিটে ঘোড়া বানানোর প্র্যাকটিশ খুব শুরু করে দিয়েছিস, না?
শশাঙ্ক পাল বললেন, তোর জন্মদিন, এই কথাটা সকাল থেকে বেশ চেপে রেখেছিলি তো?
শ্যামলী বলল, বাবা, মার্ক টোয়েন নামে এক আমেরিকান লেখক ছিলেন। তিনি জন্মদিন বিষয়ে একটা চমৎকার কথা বলে গিয়েছেন।
খাওয়া হয়ে গেছে বলে শান্তু অন্তু দুভাই উঠে পড়ল। শ্যামলীর কি বলছে শোনার কোনো প্রবৃত্তি তাদের নেই।
শশাঙ্ক পাল ওদের উঠে চলে যাওয়া দেখতে দেখতে বললেন, দাঁড়া দাঁড়া, মার্ক টোয়েন কথাটা শোনা শোনা মনে হচ্ছে।
শ্যামলী বলল, হ্যাঁ বাবা, ভূপেন হাজারিকার গলায় শুনেছ। সে একটু সুর করে শুনিয়ে দিল, মার্ক টোয়েনের সমাধিতে বসে গোর্কির কথা বলেছি
বারে বারে আমি পথের টানেই পথকে করেছি ঘর
তাই আমি যাযাবর, তাই আমি যাযাবর।।
শশাঙ্ক পাল বললেন, দেখ্ তো, কত চেনা গান, তাইতে মার্ক টোয়েন কথাটা কানে এসেছিল। তো তাঁর কথা তুই কি বলছিলি?
শ্যামলী বলল, তিনি বলেছিলেন, মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দুটো দিনের একটা হল, যে দিনটা সে জন্মাল, আর আরেকটা হল, যে দিনটা সে বুঝতে পারে আমি কেন জন্মালাম, আমার জন্মের সার্থকতাটা কি!
শশাঙ্ক পাল বললেন, বাঃ, অদ্ভুত একটা কথা বললি তো!
শ্যামলী উৎসাহ পেয়ে বলল, আমাদের আরেকজন লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ জন্মদিন নিয়ে কি বলেছেন জানো? মানুষ মায়ের কোলে যেদিন জন্মায়, শুধু সেটাই তার জন্মদিন নয়, তাকে সার্থক হতে হলে নিজেকে প্রতিটি দিন নতুন নতুন করে জন্ম দিতে হয়।
বাবা বললেন, আশ্চর্য তো?
শ্যামলী বলল, একজন জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনআওয়ার কি বলেছেন জানো? বলেছেন, আমাদের যাপনের প্রতিটি দিন যেন এক একটা ছোট্ট জীবন। প্রতিটি সকালে জেগে ওঠা যেন একটা নতুন করে জন্ম নেওয়া, আর ঘুমাতে যাওয়ার মানে হল একটু একটু করে মৃত্যুকে মেনে নেওয়া।
সবিতাপিসি বললেন, ওমা, কি হবে গো, এ যে জন্মদিন নিয়ে বিরাট লেকচার শুরু করে দিল গো, কোথায় যাব?
সবিতার কথায় হেসে উঠে শশাঙ্ক পাল বললেন, নে মা, এবার তোরা খেয়ে নে। তোদের খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।
ক্রমশ…