• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১১৬)

পর্ব – ১১৬

নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শ‍্যামলী চিঠির তাড়া নিয়ে বসল। আহা, কত চিঠি লিখেছেন প্রবাল সেন। লেখার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে আমস্টারডাম শহরটা।
প্রবাল বলেছিলেন যে নিজের এক পিসির একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি প্রচুর টাকা ও সম্পত্তি পেয়েছেন। তার ভরসাতেই নিজের পেশা ছেড়ে আঁকার নেশাকে পুষ্টি যোগাতে তিনি বিদেশে পাড়ি জমান। কিন্তু প্রবাল যে নেদারল্যান্ডস চলে গিয়েছেন সে খবর শ‍্যামলী শোনেনি। কিন্তু প্রবাল মাঝে মাঝেই শ‍্যামলীকে চিঠি লিখে আমস্টারডাম শহরে তাঁর জীবন কে তুলে ধরেছেন। চিঠিতে শহরের বর্ণনা, ইতিহাস আর সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ বেশি। ব‍্যক্তিগত‌ তথ‍্য একেবারেই নেই তা নয়। তবে   এমন কোনো কিছুই নেই, যাতে কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে মজা পেতে পারে। একটি শব্দ লিখেছেন প্রবাল, সেটি ক‍্যাবারে। সেই শব্দের নিচে লাল কালি দিয়ে কয়েকবার দাগ দিয়েছে শান্তু। আর প্রবাল লিখেছেন এখানে মেয়েদের মধ‍্যে জড়তা খুব কম। নেই বললেই চলে। সেখানেও শান্তু কলমের খোঁচা দিয়ে রেখেছে। একটা ব‍্যথার হাসি হাসল শ‍্যামলী। যে ছেলে সহোদর ভাইকে নিয়ে যৌনপল্লীতে জুয়ার আড্ডায় বসে মারামারি করে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, সে যখন ক‍্যাবারে শব্দটি দেখে হেডমাস্টারি ভঙ্গিতে লাল কালিতে দাগ দেয়, বা মেয়েরা সহজ ভাবে মেশে জেনে অস্থির বোধ করে, তার চরিত্রের অগভীরতা সহজেই অনুমান করা যায়।
ঘড়ির কাঁটায় অক্টোবর মাস শেষ হয়ে নভেম্বর শুরু হয়ে গেল। শ‍্যামলী গভীর আগ্রহে প্রবালের চিঠিগুলি তারিখ অনুসারে সাজিয়ে নিয়ে মন দিয়ে পড়া শুরু করল।
প্রথম চিঠিতে প্রবাল লিখেছেন হোটেলে কয়েকটি দিন কাটানোর পরে একটি মধ‍্যবিত্ত পরিবারে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকার সুযোগ খুঁজে নিয়েছেন তিনি। তাদের চিলেকোঠার একটি স্টোররুমে তিনি থাকেন। পরিবারের বুড়ো কর্তা হুইল চেয়ারে বন্দী। তাঁকে সকাল বিকেলে খানিকটা সময় ধরে পার্কে ঘুরতে নিয়ে যান প্রবাল। তাদের সবজি বাগানে খানিকটা পরিশ্রম করেন আর এঁটো বাসনকোসন ধুয়ে ফেলতে হাত লাগান। সে বাড়িতে সন্ধ্যায় আটটার আগেই খাওয়া দাওয়া হয়ে যায়। তারপর গানের আসর বসে। নেদারল্যান্ডস এর লোকজন গান নাচ নাটক ছবি আঁকা খুবই পছন্দ করে। শিক্ষা দীক্ষার আগ্রহ খুব। নিছক পুঁথিপোড়ো হয়ে থাকতে চায় না আমস্টারডাম শহরের লোকেরা। শহরের বুকে অনেকগুলি মিউজিয়াম রয়েছে। সময় সুযোগ পেলেই মানুষ সেখানে যায়।
 প্রবাল লিখেছেন বাড়িতে কয়েকটি তরুণী মেয়ে আছেন। প্রবাল ভারতীয় শুনে ভারত সম্বন্ধে তাদের জানার খুব আগ্রহ। প্রবাল তাঁদের কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত আর দুটি সংস্কৃত শ্লোক শিখিয়ে দিয়েছেন।
 প্রবাল তাঁর দ্বিতীয় চিঠিতে বলেছেন আমস্টারডাম নেদারল্যান্ডসের রাজধানী শহর। একই সাথে সারা পৃথিবীর অন‍্যতম সমৃদ্ধিশালী বন্দর নগরী। এই শহরের বন্দরটি ব‍্যবসার নিরিখে সারা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম বলে গণ‍্য।
 প্রবাল লিখেছেন, আমস্টারডাম শহরটি ভেনিসের উদীচী সংস্করণ বলেও পরিচিত। তার কারণ হল এই শহরে খালের আধিক্য। গোটা শহরের বুকে খালের দৈর্ঘ্যই একশো কিলোমিটার এর মতো। আর এর অনেকটাই নৌবাহনযোগ‍্য।
 নদী আর জলের কথা লিখতে গিয়ে প্রবালের কলম উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে।
 প্রবাল লিখেছেন স্রেফ এই খাল আর নৌকা নিয়ে ভ্রমণের সুযোগের জন‍্য ইউনেস্কো এই শহরকে বিশেষ ঐতিহ্যবাহী শহরের তকমা দিয়েছে।
 তিনি আরো লিখেছেন, আমস্টারডাম শহরটা সমুদ্রতলের দু মিটার বা সাড়ে ছয়ফুটের বেশি নিচে। লিখেছেন, আমস্টেল নদীর ড‍্যাম বা বাঁধ থেকে আমস্টারডাম নামের উৎপত্তি।
 ওই সূত্রে প্রবাল জোসেফ কনরাড নামে পোল‍্যাণ্ডের ঔপন্যাসিক এর আত্মজৈবনিক রচনা দি মিরর অফ দ‍্য সী এর কথা লিখেছেন। ওই সূত্রে কনরাড সাহেবকে নিয়ে কখানা কথা এসেছে তাঁর কলমে। ভারতের সিপাহি বিদ্রোহের বছরে ১৮৫৭ সালের ডিসেম্বরে জন্মেছেন কনরাড। ছেষট্টি বছর বেঁচে অনেক উপন্যাস গল্প আর প্রবন্ধের সৃষ্টি করেছেন কনরাড। ১৮৯৬ সালে কনরাড লিখেছেন অ্যান আউটকাস্ট অফ দি আইল‍্যাণ্ডস। ওই একই সালে লিখেছেন দি লেগুন। ১৯০২ সালে কনরাড লিখেছেন টাইফুন। তারপর বলেছেন অতি সম্প্রতি ১৯৮০ তে গেওর্গে মোজা়র মারিয়া কার্টা কে নায়িকা করে ফিল্ম বানিয়েছেন আন রিয়েটের দেল আইসোল। ওর গল্পটা ওই আউটকাস্ট থেকে নেওয়া।
তারপর প্রবাল উল্লেখ করেছেন, কনরাড তাঁর মিরর অফ দ‍্য সী তে সমুদ্র সৈকত থেকে আমস্টারডাম নগরীকে কেমন লাগে সেই ব‍্যাপারে একটু লিখেছেন।
 বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গিয়েছেন প্রবাল। কিন্তু সব কথাই আমস্টারডাম শহরকে খুঁটিয়ে চেনানোর জন‍্য। পড়তে পড়তে নেশা লেগে যায়। প্রবাল লিখেছেন, সারা পৃথিবীর সবচাইতে পুরোনো শেয়ার বাজার রয়েছে আমস্টারডাম শহরে। শ‍্যামলীর মনে পড়ে তার বাবা নিজের সোনালি সময়টায় শেয়ারের দরদাম খোঁজ রাখতেন। একবার বাবার সাথে গাড়ি করে কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পিছনে কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ দেখে এসেছিল সে। তারপর বাবা তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামে। নিচু ক্লাসের ছাত্রী মিউজিয়াম ঘুরতে ঘুরতে নোটবুকে কি কি লিখে ফেলছে দেখে ইউরোপীয় পর্যটকেরা উৎসাহ দিয়েছিলেন। আজ কোথায় গেল সেইসব খাতা, ভেবে শ‍্যামলীর বুকের ভেতরটা একটু মোচড় দিয়ে উঠল।
প্রবাল লিখেছেন আমস্টারডাম শহরের স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করে ডাচ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি। সেটা ১৬০২ সাল। শ‍্যামলীর মনে পড়ে বাবা বেলুড়মঠ থেকে একবার মেজো মাসির বাড়ি বরানগরে নিয়ে গিয়েছিলেন। গঙ্গা নদীর তীরে ডাচকুঠি ছিল।
প্রবাল লিখেছেন, ব‍্যাঙ্ক অফ আমস্টারডাম নেদারল্যান্ডসের রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের কাজ করে ১৬০৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সেই ব‍্যাঙ্ক। শ‍্যামলীর মনে পড়ে বেঞ্চ কথাটি হতে ব‍্যাঙ্ক শব্দের উৎপত্তি। আর মনে পড়ে কলকাতায় জিপিওর পাশে রিজার্ভ ব‍্যাঙ্কের অতো বড়ো দরজাটা দেখে সে অবাক হয়েছিল। বাবাকে জিজ্ঞাসা করে ছিল বাবা, রিজার্ভ ব‍্যাঙ্ক কি করে? বাবা তাকে একটা দুটাকার নোট দিয়ে বলেছিলেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়, তাহলে বুঝতে পারবি।
সেই দুটাকার নোটটা মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে। তাতে ভারতীয় মহাকাশ উপগ্রহের ছবি আঁকা। ওটা অষ্টম শতকের ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট এর নামে চিহ্নিত। ছোটবেলা থেকেই শ‍্যামলী ক‍্যুইজে আগ্রহী। বেশ মনে করতে পারে বাবার উপহার দেওয়া নোটটা সে অত্যন্ত যত্ন করে রাখতে চেয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ঊনিশে এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কাপুস্তিন ইয়ার থেকে কসমস থ্রি এম রকেটে চড়ে আর্যভটের নামাঙ্কিত ভারতীয় প্রথম উপগ্রহ মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছিল। সাড়ে চারফুটের একটু বেশি ডায়ামিটারের আর্যভটের চেহারা ছিল পলিহেড্রনের মতো। তার ছাব্বিশটি তল। পৌনে সাতানব্বই মিনিট সময়ে সে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে ফেলত। অপসূর আর অনুসূর কথাটা মনে পড়ে শ‍্যামলীর। পৃথিবী থেকে যখন সবচেয়ে বেশি দূরে যেত আর্যভট, তখন তার দূরত্ব হত ছশো ঊনিশ কিলোমিটার। আর সবচেয়ে কাছে যখন আসত, তখন দূরত্ব দাঁড়াত পাঁচশো তেষট্টি কিলোমিটার। তিনশো ষাট কেজি ভরের আর্যভটের ঊনিশ শো একাশির মার্চ অবধি কাজ করার কথা ছিল।
কিন্তু তার শক্তি সরবরাহের সংকটের কারণে মাত্র চারদিনের মাথায় উপগ্রহটি আর কাজ করতে পারে নি। পরদিনই তার সাথে সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাবার দেওয়া দুটাকার নোটটাকে খুব মনে পড়ে শ‍্যামলীর। হারিয়ে গিয়েছে সে চিরতরে। তবুও চেতনার জগতে সে রয়ে যায় নি? তাহলে কেন কবি বলেন, তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না কো কভু।
এমন সময় দরজায় শব্দ হল। দরজা খোলার আগে শ‍্যামলী সাড়া নিল। পিসি উঠে এসেছে। বললেন, কি রে, তোর ঘরে আলো জ্বলছে দেখে উঠে এলাম। ঘুম আসছে না, না রে?
শ‍্যামলী বলল, এই যে, এবার ঘুমোবো।
পিসি বলল, চিঠির মধ‍্যে একটা মানুষ কি করে যেন লুকিয়ে থাকে। আমায় পড়ে শোনাবি?
শ‍্যামলী বলল, আমি পুরোটা পড়ে নিই। তারপর তোমাকে গল্প বলব। পিসি নিজের ঘরে চলে গেল। তখন একটা কাক হঠাৎ আধো ডেকে উঠল পাকুড়ের ডাল থেকে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।