দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১১০)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১১০
একজন বয়স্ক শিখ মহিলা শ্যামলীর সঙ্গে রয়েছেন। তাঁর কোমরে ছোট কৃপাণ বাঁধা। শ্যামলী ঘুরে ঘুরে খুঁজতে লাগল গুরশরণকে। সে দেখল, অনেকেই তার সমবয়সিনী মেয়ে, অনেক তরুণী বধূ, অনেক প্রৌঢ়া, অনেক অশীতিপর বৃদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন গুরুদ্বারে। সকলের মুখে চোখে আতঙ্ক। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারতের অঙ্গচ্ছেদের মুহূর্তে যে দুটি অঙ্গরাজ্য কাটা পড়েছিল, তার একটি বাংলা, অপরটি পঞ্জাব। সে সময় বহু মানুষকে তাদের পুরুষানুক্রমে বাস করা ভিটেবাড়ি, দালান পুকুর সব ফেলে, প্রায় এক কাপড়ে দেশছাড়া হতে হয়েছে। সেই সময় বহু মেয়ে শরণার্থী শিবিরে ধর্ষিতা হয়েছে। কতো মেয়ে সেই লজ্জায় আত্মঘাতী হয়েছে। কত মেয়ে মরণান্তিক আঘাতে বোবা হয়ে গিয়েছে। কত মেয়ে অবাঞ্ছিত সন্তানের জন্ম দেবে না বলে নিজের উত্তল হয়ে ওঠা পেটে আঘাতের পর আঘাত করে গর্ভপাত করতে চেয়ে বিপুল রক্তপাতে মৃত্যু ডেকে এনেছে। অনেক মেয়ে মুখ বুজে অনিচ্ছার সন্তানকে প্রসব করতে বাধ্য হয়েছে। নিরপরাধ শিশুর মুখ চেয়ে মরতে পারেনি। গুমরে গুমরে কেঁদেছে।
তাদের কান্না, তাদের অপমান স্বাধীনতার পতাকাকে মলিন করে দিয়েছে। সাধারণতন্ত্র দিবসে ভারতের আকাশে যুদ্ধ বিমান নিয়ে যত কেরদানিই করা হোক্ না কেন, দেশভাগজনিত দাঙ্গাপীড়িত নরনারীর যন্ত্রণা তাতে লঘু হয়ে যায় না। এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার হয়ে স্বাধীনতা আনতে হল, এত বড় মাপের গ্লানি ভারতের অহিংস ইমেজের উপর কালো আলকাতরা বুলিয়ে দিয়েছে।
শ্যামলী কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না গুরশরণকে। অথবা সব সমবয়সিনী মেয়ের মুখমণ্ডলে ও গুরশরণকে দেখতে পাচ্ছিল। সাথে থাকা শিখ মহিলা ওকে বলল, এবার চলুন। আপনার সময় পেরিয়ে গেছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা কোণে একটা থামের আড়ালে ও দেখতে পেল গুরশরণকে। শ্যামলী তার কাছে যেতেই সে যেন আঁতকে উঠল। প্রবল আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে ওর মুখ। পাশে শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধা। তিনি আশা করছেন দিল্লিতে তাঁর বড়ছেলে এখনো বেঁচে আছে। তাকে যে তরোয়াল দিয়ে কংগ্রেসী গুণ্ডাবাহিনী কুচি কুচি করে কেটেছে সে কথা হতভাগিনী মাকে শোনানো হয়নি। বৃদ্ধার ছোটো ছেলের ইলেকট্রনিক আইটেমের দোকান লুঠ হয়ে গেছে। মাথায় আঘাত পেয়ে পঞ্জাবি দোকানদার জ্ঞান হারিয়েছিল। গুরশরণ যেন ভেবেই পাচ্ছে না যে কেন, কোন্ অপরাধের দায়ে তার বাবা কাকার এই শাস্তি হল। বুদ্ধ গান্ধী বিবেকানন্দ স্বামীর যে ভারতের অহিংস প্রবণতার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবত দর্শনের ছাত্রীটি, প্রবন্ধ লিখত, তা যে বাস্তবে কতটা নড়বড়ে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তাই কি ভাবছিল গুরশরণ? অথবা সে কোনো কিছুই ভাবতে পারছিল না, কেবল একটা জান্তব বাঁচার ইচ্ছা তার সমস্ত স্নায়ুকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল।
শিখ মহিলা আবার বললেন, এই মেয়ে, তোমার সময় ফুরিয়েছে। বাইরে চলো।