• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে দিলীপকুমার মিস্ত্রী

ঐতিহাসিক  কোর্ট  অর্ডার

দুটো-ছাব্বিশের গেদে লোকাল। কাঁচরাপাড়া স্টেশনে ঢুকল পাক্কা আঠারো মিনিট লেটে। এমনিতেই দুপুরে অনেক্ষণ বাদে এই প্রথম ট্রেন। প্ল‍্যাটফর্মে থিক্ থিক্  ভীড় । রামনরেশ অতিকষ্টে সপরিবারে ট্রেনে উঠে পড়ল।  পরিবার বলতে তার স্ত্রী আর আট বছরের মেয়ে পার্বতী।

            রামনরেশ নামবে কাঁকিনাড়া স্টেশনে। কিন্তু ভীড়ের ঠেলায় সে পরিবার নিয়ে নামতেই পারল না। পরের স্টেশন জগদ্দল। সেখানে ট্রেন দাঁড়াল না।  অগত্যা সে পরিবার নিয়ে অনেক চেষ্টায় নামল শ‍্যামনগরে।

               প্ল‍্যাটফর্মে দু’পা এগোতেই তার পথ আটকে দাঁড়াল একজন টিটি। সে রামনরেশের কাছে টিকিট দেখতে চাইল। রামনরেশ পকেট থেকে তিনটি টিকিট বের করে টিটিকে দেখাল। কিন্তু টিকিট দেখে টিটি উল্টো রেগে গেল।  তখন দু’জনের মধ্যে বেধে গেল জোর  তর্কাতর্কি। শেষে রামনরেশ সাতশো আশি টাকা ফাইন দিয়ে ছাড়া পেল।

                বাড়ি ফিরে ক্ষুব্ধ রামনরেশ সোজা চলে গেল পরিচিত এক উকিলের বাড়ি। তাঁকে সমস্ত বিষয়টি বিশদে জানাল। তারপর সে উকিলমশাইকে বলল, রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সে মামলা দায়ের করবে। কোটি টাকা‌র মানহানি মামলা।

            এরপর মাসকয়েক পরের ঘটনা। হাইকোর্টে সেই মামলার শুনানি চলছে প্রধান বিচারপতির এজলাসে। বিচারপতি রেল কর্তৃপক্ষের উকিল মশাইয়ের কাছে শুনতে চাইলেন তাঁর বক্তব্য। তিনি বিস্তারিতভাবে জানালেন সেদিন স্টেশনে ঠিক কি ঘটেছিল।

                তা শুনে বিচারপতি রামনরেশের দিকে  তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,” উকিল মহাশয় যা বললেন, তা কি ঠিক  ?”

                                     রামনরেশ উত্তর দিল, “আঙ্গে হ‍্যাঁ, ঠিক। “

               বিচারপতি খানিকটা অবাক হয়ে রামনরেশকে আবার প্রশ্ন করলেন,

           “তবে আপনি রেলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন কেন ? এটা কি ঠিক হল ?”

                রামনরেশ বিচারপতির মুখে স্থিরভাবে তাকিয়ে আবেগতাড়িত কন্ঠে বলতে লাগল।

                  “ হুজুর, সাতশ আশি টাকা জরিমানা দেয়ার জন্য নয়। এই মামলা আমি দায়ের করেছি আমার সম্মানহানির জন্য। সেদিনের ঘটনা আমাকে আমার পরিবার, স্টেশনে উপস্থিত  অসংখ্য মানুষের সামনে ভীষণভাবে লজ্জা দিয়েছে। আমি চূড়ান্ত অপমানিত হয়েছি। সত্যি বলছি, জীবনে আমি প্রথমবার এমন অপদস্থ, অপমানিত হয়েছি । তাই মামলা দায়ের করেছি।“

                                       বিচারপতি আবার প্রশ্ন করলেন,

                 “এতে রেল কর্তৃপক্ষের দোষটা কোথায় ? “

                         রামনরেশ কাঁধ থেকে গামছা টেনে মুখে বুলিয়ে নিল। তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলতে লাগল।

                       “ হুজুর, আপনি আমার কথাটা একটু  দয়া করে, মন দিয়ে শুনবেন।  আমি সেদিন যেভাবে অপমানিত হয়েছি তার জন্য আমার কোনো দোষই ছিল না। রেলই তার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী‌। কারণ, আমি কাঁকিনাড়া যাবার জন্য টিকিট কেটে ট্রেন ধরতে  কাঁচরাপাড়া স্টেশনে অপেক্ষা করছিলাম। দুটো ছাব্বিশের গেদে লোকাল অনেক লেটে এল। আমি অতিকষ্টে পরিবার নিয়ে ট্রেনে উঠেছিলাম। কিন্তু অসম্ভব ভীড়ের কারণে কাঁকিনাড়া স্টেশনে নামতে পারিনি। ট্রেন পরের স্টেশন জগদ্দলে  দাঁড়ায়নি। আমি বাধ্য হয়েই পরিবার নিয়ে শ‍্যামনগরে নেমেছিলাম।

             রামনরেশ একটু থামল। চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দেখল। তারপর  বিচারপতির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগল।

         “ হুজুর, শ‍্যামনগর স্টেশনে টিটি আমার সংগে অত‍্যন্ত দুর্ব‍্যবহার করেছে । আবার ফাইন করে টাকাও নিয়েছে।“

                        “ আপনার টিকিট কাটা ছিল কাঁকিনাড়া অবধি। তাহলে, টিটি ফাইন করে কী অন‍্যায় করেছেন ?” প্রশ্ন করলেন বিচারপতি।

                  রামনরেশ উত্তরে বলল,  “হুজুর, সেদিন ট্রেন লেট করায় কাঁচরাপাড়া স্টেশনে অসম্ভব ভীড় ছিল। আমি ভীড়ের জন‍্যই কাঁকিনাড়া নামতে পারিনি। কিন্তু পরের স্টেশনে যে নেমে যাব, সে উপায়ও ছিল না। ট্রেন জগদ্দলে দাঁড়ালই না। অথচ গেদে একটি লোকাল ট্রেন। মানে সব স্টেশনেই দাঁড়াবে, এমনটাই তো আমরা সবাই জানি। তাহল জগদ্দলে যে এই ট্রেন  থামবে না, এমন ঘোষণা তো কাঁচরাপাড়ায় একবারের জন‍্যও করা হয়নি। তাহলে আমার দোষ কোথায় ?  আমি যে সুস্থভাবে পরিবার নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় ঠিক সময়ে পৌঁছোতে পারিনি—তার জন্য রেল কর্তৃপক্ষ কেন দায়ভার নেবে না। আমি কি টিকিট কাটিনি ? ট্রেন কেন সময়মতো চলাচল করে না ?  যাত্রী অনুপাতে ট্রেনের সংখ্যা  কম কেন ? যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ কেন মাথা ঘামাবে না ? আমরা কি তাদের পয়সা দিইনা ? সেদিন আগাম ঘোষণা ছাড়া গেদে লোকাল কেন জগদ্দলে দা়ঁড়ায়নি, সেই কৈফিয়ৎ শুধু আমাকে নয়, সেদিনের অনেক যাত্রীদেরই দেওয়া অবশ্যই উচিৎ ছিল রেল কর্তৃপক্ষের।“

                রামনরেশ এবার একটু থামল।  বিচারপতি সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলেন,

               “আপনার আর কিছু বলার আছে ?”

               রামনরেশ ঘাড় নেড়ে জানাল, “ না। “

               এরপর বিচারপতি বলতে লাগলেন,

         “রামনরেশ,কোর্ট-অফিসার আপনার অতীত সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে আমার কাছে জমা দিয়েছেন। সেই সব বিচার করে আপনার সম্পর্কে বা এই মামলার রায় ঘোষণা করতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তবুও আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব। সঠিক উত্তর দেবেন।  আপনি কি কাজ করেন ? “

                    রামনরেশ হাত জোড় করে উত্তর দিল,

          “হুজুর, আমি রিস্কা চালাই।“

       রামনরেশের উত্তর শুনে কোর্টে হাস‍্যরোল উঠল। বিচারপতি সঙ্গে সঙ্গে হাতে হাতুড়ি তুলে নিয়ে টেবিলের ওপর জোরে জোরে তিনবার ঠুকে, গম্ভীরকন্ঠে বলে ওঠলেন,

        “অর্ডার, অর্ডার, অর্ডার।“

     নিমেষে হট্টগোল থেমে গেল। এরপরই বিচারপতি পরপর প্রশ্ন করতে থাকলেন আর রামনরেশ পরপর উত্তর দিতে লাগল।

     “আপনি রেলওয়ের বিরুদ্ধে এত বিশাল অংকের মানহানি মামলা দায়ের করেছেন কা’র পরামর্শে ?”

               “হুজুর, আমি রিস্কা চালাই একথা ঠিক। কিন্তু কাঁকিনাড়ায় আমার একটা আলাদা ইজ্জত আছে। সে ইজ্জতের দাম এরচেয়েও অনেক বেশি। রেল কর্তৃপক্ষ কেন, তা কেউ আমাকে  দিতে  পারবে না।“

                  “ ওহ!  আচ্ছা, কাঁকিনাড়ার কোনো বাসিন্দা এই মামলায় আপনার হয়ে স্বাক্ষী দিতে  রাজি হবেন ?  পরের তারিখে একজনকেও হাজির করতে পারবেন ? “

                “ হুজুর, আপনি আদেশ করলে, পরের তারিখে আমি একজন কেন দশজনকে নিয়ে আসতে পারব। তাঁরা কেউ আমার মতো রিস্কা চালায় না। সবাই এলাকার নামযাদা, ভালো মানুষ।“

                    “আচ্ছা, আপনি নাকি পরের উপকার করে বেড়ান ?”

                   “কি যে বলেন হুজুর। রিস্কা চালিয়ে পেট চলে। আমার ক্ষমতা আর কতটুকু।  তবে একথা ঠিক, অন‍্যায় দেখলে, লোককে বিপদে পড়তে দেখলে, আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি।  তখন নিজের বা পরিবারের কথাও ভাবিনা।“

               “ কিছুদিন আগে আপনি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেটা  কি কারণে ? “

                   “ হুজুর, সেদিন এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে আমার রিস্কায় চেপে রথতলা যাচ্ছিলেন।  মাঝপথে তিনজন দুষ্কৃতী আমার রিস্কা আটকে ওনাদের টেনে নামায়। ওনাদের হাতে থাকা একটি ব‍্যাগ কেড়ে নিতে চেষ্টা করে। দুষ্কৃতীরা ওদের খুব মারধর করছিল। তখন  আমি  সহ্য করতে না পেরে ওদের  উপর  ঝাঁপিয়ে পড়ি।  হুজুর, দেশে থাকতে সাতবছর আখড়ায় কুস্তি শিখেছি।  আমার সঙ্গে পেরে ওঠা অতো সহজ  কথা!  ওরা না পেরে , শেষকালে আমার হাতে কয়েকবার ভোজালির কোপ মারল।  ততক্ষণে  এলাকার অনেক লোকজন ছুটে এসেছে। তারাই দুষ্কৃতীদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল।“

                 “এরজন্য ওই  ব‍্যবসায়ী  আপনাকে  নাকি অনেক টাকা দিয়েছিলেন ।  টাকার পরিমানটা ঠিক কত ?”

             “ কী যে বলেন হুজুর। উনি আমাকে অনেক টাকা দিতে চেয়েছিলেন একথা ঠিক। কিন্তু  আপনি বিশ্বাস করুন হুজুর, আমি একটি টাকাও ওনার কাছ থেকে নেই নি।  তবে হ‍্যাঁ, আমি অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে থাকাকালীন ওনারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে রোজ   আমাকে দেখতে আসতেন। সঙ্গে ফলটল  নিয়ে আসতেন। এখনও ওনাদের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। ওনারা আমাকে খুব ভালোবাসেন। ওইতো, ওইতো ওনারা আজও কোর্টে এসেছেন আমার জন্য।“

                     “প্রোমোটার ভজনলাল নেওটিয়ার কাছ থেকে আপনি নাকি অনেক অনেক টাকা পেয়েছেন ? সেই টাকায় আপনি নাকি দেশে জমি-বাড়ি করেছেন ? তা ব‍্যবসায়ী  ভজনলাল আপনাকে অতো টাকা দিতে গেলেন কেন ?”

                       “ হুজুর, মিথ্যে কথা। ডাহা মিথ‍্যে কথা। ভজনলালবাবু শহরের মস্ত বড়ো ব‍্যবসায়ী। তার মেয়েকে গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে আমি তিন-তিনটি গুলি খেয়েছিলাম। ঈশ্বরের কৃপা, মানুষের ভালোবাসা, আর ভজনলালবাবুর  টাকার জোরে সেদিন  আমি প্রাণে বেঁচে  গিয়েছিলাম। এজন্য ভজনলালবাবুকে আমি কোনদিন ভুলতে পারবনা । ভজনবাবু, পরে আমাকে কয়েক লক্ষ টাকা , আর আলিপুরে একটা ফ্ল্যাট দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তা নেই নি। হুজুর, আমার কথা বিশ্বাস না হলে, ওইতো  ভজনবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। ওনাকে ডেকে জিঙ্গেস করুন। উনি তো সত্যি কথাটা বলবেন।“

                 রামনরেশের দীর্ঘ ভাষণে রেলের  উকিলমশাইয়ের ধৈর্যচ‍্যুতি ঘটল। ভয়ানক রাগও হল। তাঁর চোখে-মুখে  প্রচণ্ড বিরক্তির ছাপ ভেসে  উঠল।  সহ‍্যের  সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে  গেল।  অবশেষে, চিৎকার করে তিনি বিচারপতির উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন,

              “মি লর্ড, এইসব অবান্তর, অসাংবিধানিক কথাবার্তা বলে উনি আদালতকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন।  আদালতের মহামূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাইছেন। একজন সামান্য রিক্সাচালক, রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোটি টাকার মানহানি মামলা দায়ের করেছেন। এটি শুধুমাত্র হাস‍্যকর বিষয় নয়, দেশের মধ্যে বিষ্ময়কর ,বিরলতম ঘটনাও বটে। আমি আদালতের কাছে দরখাস্ত করছি, আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য ওনাকে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেয়া হোক। একজন সাধারণ রিক্সাওয়ালার এমন স্পর্ধা——।“

             উকিলমশাইয়ের কথা শেষ হতে পারল না।  তার মুখের  কথা  প্রায় কেড়ে নিয়ে  বিচারপতি হাতের হাতুড়ি দিয়ে  টেবিলের ওপর প্রচণ্ড শব্দে তিনবার আঘাত করলেন। সেইসঙ্গে  অত‍্যন্ত  দৃঢ়তার সঙ্গে,  উচ্চকন্ঠে বলে উঠলেন,

                “ অর্ডার, অর্ডার, অর্ডার !”

                      প্রধানবিচারপতির এমন ক্রোধ এবং ডমিনেটিং রোল কোর্টের অভ‍্যন্তরে এরআগে কেউ কখনও দেখেনি।  আজকে তাঁর এমন হিস্টোরিক‍্যাল অ্যাটিচুট  কোর্ট ইতিহাসে এক নতুন নজীর  স্থাপন করল বলে আদালতে হাজির  সকলেই বলাবলি করতে লাগল।                                              

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।