• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজে নিলয় নন্দী

লিপস্টিক

আজ নবমী। কাল এমন সময়…
রায়চৌধুরী বাড়ির বারদালানে তখন অঞ্জলির মন্ত্র।একমনে মা দুর্গার চোখের দিকে তাকিয়ে করপুট ও মায়াচোখ। কোনদিকে তাকাবে ভেবে পাচ্ছিলো না সাম্য। মনে মনে কি চাইবে? শ্রেয়ার চুল বেয়ে তখন নেমে আসছে স্নান জল। ভেজা ব্লাউজের পিঠ, এক আধটা চুল ও লেপটে। ঠোট রাখতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ। ওদিকে শিখাপিসিমা অঞ্জলির ফুল বাড়াচ্ছেন। একসাথে নিতে গিয়ে আঙুলে আঙুল। তাপ বাড়ছে। কোথাও কি থার্মোমিটার মিলবে এ সময়? চকিতে তাকালো কাজলনয়না। হাত থেকে ফুল গেলো পড়ে।
– “এমা, কি হল? ”
-” না, মানে! ”
– “এই নিন। আমার থেকে নিন। কিচ্ছু হবে না” বলে করপুট খুলে দিল আর আরো একবার, তড়িৎ  ছোঁয়া। সৃষ্টি স্থিতি বিনাশনাং শক্তিভূতে সনাতনী, গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণী নমোহস্তুতে। প্রায়  মন্ত্রমুগ্ধ সাম্যকে বার করে আনলো অনিরুদ্ধ, এ বাড়ির ছোট নাতি। সবার খুব আদরের রাজা দাদুভাই। একগাদা ভাইবোনেদের ভিড়ে সেলফির মধ্যে ঢুকে পড়লো সাম্য। এবং এখানেও আড়চোখ ধরা পড়ে গেলো।
” কি দেখছিলে গুরু? মিঠাইকে?”
– “দেখ রাজাদা, ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। এসব কি? ” শ্রেয়া ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
– “কেন বলবো না?  কেউ দেখেছিস সেলফি তোলার সময়েও তোর দিকে তাকিয়ে থাকে? ”
স্মিত হাসে শ্রেয়া। অকারণেই লজ্জা পায় এই একবিংশ শতকেও। দৌড়ে ছুটে পালায়। অকারণেই গীটার টা হাতে তুলে নেয় সাম্য। ” প্রিয় বন্ধুকে দিও এসো প্রিয় গান/ তার উড়োজাহাজের গায়ে এঁকে দিও কালবৈশাখী”….
এই গীটার আর ওর প্রিয়তম ডি.এস.এল.আর টা  নিয়ে এবার কলকাতা ছেড়ে অনিরুদ্ধদের এই বর্ধিষ্ণু শহরের পুরনো জমিদারবাড়ি তে সাম্য। ডিসেম্বর এর শুরুতেই গগনেন্দ্র আর্ট গ্যালারিতে একটা বিখ্যাত ফটোগ্রাফি এক্সিবিশন আছে। বিষয়, “বনেদী বাড়ির পুজো”। অরিজিৎদাকে বলতে গেলে প্রায় হাতেপায়ে ধরে ও এবার জায়গা পাবে, কথা আদায় করে নিয়েছে। এমনিতে সাম্য এখন উঠতি ফ্রিল্যান্সার, অনেকেই চেনে ওকে। ওর কিছু লাইট এন্ড শেডের ছবি নজর ও কেড়েছে বোদ্ধাদের। কিন্তু এই এক্সিবিশনে একটা কিছু নাড়িয়ে দেবার মত করে দেখাতে পারলে, ফটোগ্রাফিতে কেরিয়ার টা একটু এগোবে। অনিরুদ্ধ, সাম্যর ক্লাসমেট। যাদবপুর কেমিস্ট্রি। সামনে জ্যাম ট্যামের চাপও আছে। এতকিছু সামলে গীটার, ফটোগ্রাফি, কতটা কি করবে, কে জানে! এখানে এসে অনেক স্ন্যাপ নিয়েছে এ কদিনে। বোধন, কলাবৌ স্নান, দুর্গা অসুর ক্লোজি ক্লোজি, সিংহের হাঁ আর বাচ্চাদের ও, হরেক রকম। শুধু এই অষ্টমীর সকাল থেকে ক্যামেরাটা শুধু শ্রেয়া কে খুঁজে নিচ্ছে। শ্রেয়া, অনির কাজিন। অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধতা আছে ওর। নাকউঁচু  যাদবপুর ও ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ…
– “সাম্যদা, ময়ুরাক্ষী দেখতে যাবেন? ”
– “নদী। সে তো আমায় ডাকে রোজ। এখানে দেখা মিলবে বুঝি? ”
– ” দেখবেন, শরীরে তার ভরা জোয়ার। ধূসর রং। যেন মাটি আর গোধূলি বন্ধুতা পাতিয়েছে ওর সাথে”
– “আর ব্ল্যাক শার্ট আকাশ ওর বয়ফ্রেন্ড বুঝি? ”
– ” বাহ! কি দারুণ বললেন! কবিও নাকি? ”
– ” কেন, কবি খুব পছন্দ? ”
– “খুউউউব। যে আমার জন্য লিখতে পারে এক পৃথিবী। ”
বলেই দু হাত ডানা মেলে ভরা ময়ুরাক্ষীর দিকে উড়ে যায় ও। আর সাম্য, গীটারে ধরে, “প্রিয় বন্ধুকে প্রিয় ফুল, প্রিয় রং… তার হারানো জামার বুকে ভেঙে পড়ো কালবৈশাখী ” ওই তো স্ট্রাইপড শার্ট আর জিনসে উড়ে আসছে প্রিয় ফুল। গীটার নামিয়ে রেখে হাত প্রসারিত করে চোখ বোজে সাম্য। হারানো জামার বুকে…. চোখ খুলে দেখে অনেকটা উপরে উঠে গেছে শ্রেয়া। ভেঙে পড়েনি তো। রাস্তায় ও, অনিরুদ্ধ, আরো সব রায়চৌধুরীরা।
এ বাড়িতে চিলেকোঠা টাই পছন্দ হল সাম্যর। আরামে পা ছড়িয়ে ক্যামেরাতে একের পর এক ছবিগুলো দেখছিল ও। ময়ুরাক্ষী, শ্রেয়া, ওর ডিফারেন্ট অ্যাঙ্গেল। এই তো পাতলা ঠোট। জুম করে আনে। নামিয়ে আনে নিজের ঠোটদুটো। আর তক্ষুনি, শ্রাবণ এসে দাঁড়ায় শরতের দরজায়। ঝমঝমিয়ে বর্ষা নেমে পড়ে।
– “দেখি। দেখি। কার ছবিতে এসব? ”
চকিতে ক্যামেরা সরিয়ে নেয় সাম্য। ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রেয়া। আঁচল সরে যায়। ঝর্ণা হয়ে যায় নদী। সামলে নেয় শ্রেয়া। বোকার মত পড়ে থাকে সাম্য। ” এই দিনের আঁচলে ভাসে খড়কুটো / আমি দেখি তুমি সামলাও ঝড়মুঠো…. “
আজ নবমী। সারাদিন প্রচুর ছবি তুললো সাম্য। শ্রেয়া আড়চোখে বেশ কয়েকবার। অনিরুদ্ধ কি কিছু আঁচ করছে? হঠাৎই বেশ কড়া কথা শুনিয়ে দিল অকারণেই। অন্তাক্ষরীর আসর থেকে উঠে এলো ও। একাই একটা রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো শহর ঘুরতে। হোয়াটস অ্যাপে শ্রেয়া।
-” কি ব্যাপার, ফটোগ্রাফারের রাগ হয়েছে নাকি! রাজাদা ওরকমই। ভালো স্টুডেন্ট বলে বাড়ির সবাই ওকে মাথায় করে রাখে। যা চায় তাই আদায় করে নেয়। ”
– ” আরে না না। ও খুব ভাল বন্ধু আমার।”
– “না গো, মনে হচ্ছে ও জেলাস। এই যে আমরা সবাই মিলে তোমার ক্যামেরায় পোজ দিচ্ছি, গান শুনছি, ও মানতে পারছে না বোধহয় ”
– ” আমি তোমার খুব কম পরিচিত। এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে না বোধহয়। ”
অফলাইন হলো সাম্য। রিকশাওলা দিকশূন্য এখন।
নবমীর ভোগ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল চিলেকোঠায়। চোখ মেলতেই দেখে, সন্ধ্যে হয়ে এলো। ডিজাইনার পাঞ্জাবী টা গায়ে চাপালো। আজ নিশ্চয় খুব সাজবে শ্রেয়া। কাল ওর জন্য একটা নুড শেডের লিপস্টিক কিনেছে সাম্য। চড়া রঙ ওর না পসন্দ। শ্রেয়ার স্নিগ্ধতার সাথে, ওর ওষ্ঠ লাবণ্যের সঙ্গে যেন মানানসই। খুব বেশি সাহসী কাজ হয়ে যাবে কি? লিপস্টিক টা আজ দিতে বললে অশোভন হবে? ধুর, অত ভেবে লাভ নেই। পকেটে নিয়ে নিল ওটা। ক্যামেরাটা ঝুলিয়ে নিল গলায়। তারপর, প্রায় উড়ে সিঁড়িতে পা রাখে। লাইট টাও জ্বালাতে ভুলে যায়। আর তখনই…..
প্রায়ান্ধকার ল্যান্ডিং এ শ্রেয়ার শরীরটাকে জাপটে ধরেছে অনিরুদ্ধ। জাফরিকাটা শেষ গোধূলির আলোয় শ্রেয়ার ঠোটে চেপে বসেছে অনিরুদ্ধর ঠোট। কি দেখছে সাম্য! ওর পায়ের জোর কমে আসছে কেন! ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে যাচ্ছে অনির মিঠাই, কাজিন!! শুধু চুম্বন পড়ে আছে এককোণে…
ডিসেম্বরের প্রথম। হালকা শীত। গগনেন্দ্র গ্যালারিতে একটা ছবির সামনে সবচেয়ে বেশি ভীড়। অস্ফুটবাক, অসাধারণ অভিব্যক্তি সব। “সাম্য, ইউ আর রিয়্যালি আউটস্ট্যান্ডিং ইন লাইট এন্ড শেড”…অরিজিৎদার গর্বিত মুখটাও আজ সাম্যর বিস্বাদ মনে হচ্ছে। ” ক্যাপশন টাও কিন্তু দারুণ দিয়েছো, দ্য ফেট অফ লিপস্টিক।” শুধু অনিরুদ্ধ ছবিটা দেখে সেই যে হোস্টেলে গেছে, কল করে নি। ফোনটাও সুইচড অফ। শুধু সাম্য সরে আসে কোণের ওই ভাসানের ছবিটার দিকে। ডুবে যাচ্ছেন মা, কি ছলোছলো রুপ, তাকানো যায় না! আর ছবি তুলতে গিয়ে পাড় ধসে পড়ছে পায়ের নীচে। “সাম্যদা সাবধান, পড়ে যাবে। ” আর্তচিৎকারে ছুটে আসে শ্রেয়া। প্রাণপণে সাম্যর শার্ট খামচে ধরে ও। ” কি করছো কি! কিচ্ছু খেয়াল থাকে না। ”
গীটার টা কোথায়?  “না পাওয়া দুজন জানে চুম্বন অর্থহীন “…..আর লিপস্টিক গড়িয়ে পড়ছে জলে, মেখে নিচ্ছে নদী।
ওদিকে তখন অ্যানাউন্সমেন্ট,” দ্য অ্যাওয়ার্ড গোজ টু…..”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।