কুগান ভাবছিল, বিদ্যাবতী যদি উপজাতি গোষ্ঠীর মেয়ে না হত, হয়ত মুরুগান ওকে বিয়ে করত। বিয়েটা করল না কেন কে জানে! হয়ত দুজনেরই আপত্তি বা সংকোচ, বা পূর্বাশ্রমের অভিজ্ঞতা বিয়ে থেকে দুজনকে দূরে রেখেছিল। আর এখন তো প্রায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এরা। এদের বিয়ে হল কী হল না, তাতে কারুর কিছুই আর যায় আসে না। আর এদের কথা তো অনেক পরে আসছে। সে নিজেও তো আর বিয়ে বা প্রেমের কথা ভাবতে পারল না। যৌবন তো তার এখনও যায়নি। কিন্তু উত্তাপ নিভে আছে। হয়ত অতিরিক্ত মদ্যপানে সে স্থিমিত। হয়ত দুঃখ বা অন্যকিছু। কুগান আর এসব ভাবে না। আসলে কোন কিছুই ভাবে না ও। ভাবার মতো মানসিক স্থিরতা তার আর নেই। এখনই তার হাত কাঁপছে। অস্থির লাগছে শরীরের ভেতর। দৌড়ে গিয়ে ঢকঢক করে নিট মেরে দিল বেশ কিছুটা কুগান। তারপর সোফায় গা এলিয়ে বসল। সামনে পানড়ি ঠান্ডা হচ্ছে, কারুমবুট্টু নেতিয়ে আসছে। ক্রমশ তার পৃথিবী শান্ত হয়ে আসছে। গা এলিয়ে এসেছে, স্নায়ু শিথিল প্রায়। এইরকম এক দিব্যঘোরের মধ্যে না থাকলে কুগানের কিছুই ভাল লাগে না। এখন কোন মানুষ, খাদ্য, পরিবেশ, কিছুই আর তাকে আকৃষ্ট করবে না, কেউ বিরক্তও করবে না। এখন সে যে এক বরাভয় মুদ্রা নিয়ে বসেছে অধিষ্ঠিত সিংহাসনে। ওঘর থেকে খুব জোরে হাসির শব্দে একবার চমকে উঠেও আবার স্থির হল কুগান। এই যেন তার তপস্যা এখন। সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের মধ্যে ডুব দেওয়া। আচ্ছা শুভলক্ষ্মীকে কি ওর আর মনে পড়ে? মুখটা এতদিনে কেমন ঝাপসা হয়ে গেছে। দৈবাৎ যদি কোথাও ওর সঙ্গে লক্ষ্মীর দেখা হয়ে যায়, মনে হয় আর চিনতে পারবে না ওকে। কদিনের পরিচয় আর কদিনই বা মুখোমুখি দেখাসাক্ষাৎ! সব, সব ভুলে গেছে কুগান। সত্যিই কি সব ভুলে গেছে? মাঝেমাঝে একটা মালা জড়ানো লম্বা বিনুনির ঝাপটা কুগানকে কেমন অসহায় করে দেয়। সেইদিন ওর আর মদ খেতেও ভাল লাগে না। খাবার খেতেও ভাল লাগে না। ঘুম আসে না সারাদিন, সারারাত। একজোড়া চঞ্চল চোখ ওকে তাড়া করে ফেরে। মুখ মনে পড়ে না তার। বিড়বিড় করে শুভলক্ষ্মীকে ডাকতে থাকে কুগান। প্লিজ, প্লিজ সামনে এস লক্ষ্মী, মুখ দেখাও। আমার মনে পড়ছে না কিছু…কী কথা বলতাম আমরা? কী নিয়ে আমাদের এত কথা ছিল, কেন তার বিন্দুবিসর্গ আজ কিছুই মনে পড়ে না, শুধু একটা বিনুনি আর একজোড়া কাজল পরা চোখ আমায় তাড়া করে, করতেই থাকে। আজ অনেকদিন বাদে স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে লক্ষ্মীকে নিয়ে ভাবতে বসেছে কুগান। অচেতন হওয়ার মতো মদ সে এখনও খায়নি। ধীরে ধীরে হয়ত অচেতনতা তাকে চেপে ধরবে কিছুক্ষণ বাদেই, সে টেরও পাবে না।
মুরুগান আর বিদ্যার নেশা তখন চেগে উঠেছে। বিদ্যার খোঁপা আলগা হয়ে যাচ্ছে বারবার। চোখে লালাভা, গালে রক্তের উচ্ছাসও বোঝা যেত ফর্সা রঙ হলে। এখন অবশ্য বিদ্যার মুখ টসটসে দেখাচ্ছে। মুরুগানকে দেখে অবশ্য তেমন কিছু বোধ হচ্ছে না। সে ভাবছে কিছু বা ভাবার চেষ্টা করছে মনে হয়। বিদ্যা বোধহয় গান করছিল ওদের ভাষায় গুনগুন করে। সুরটা বোঝা গেলেও কথা বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ সে নিজেই বলে উঠল, ‘জানিস বাবু, এই আমরা, কোরাবারা কোথা থেকে এসেছি এখানে?’ প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল মুরুগান। কী আশ্চর্য! এই উৎস নিয়ে ও নিজেই তো ভাবছিল একটু আগে। বিদ্যা কি মন পড়তে পারে নাকি? অবশ্য এই ধরণের চমকের সম্মুখীন মুরুগান এই প্রথমবার হল না। আগেও বহু, বহুবার এরকম চমকে গেছিল ও। বিদ্যা কি তুকতাক জানে? ডাইন নাকি ও? সবাই যেমন বলে, বিদ্যা নাকি গুন করেছে ওকে। নইলে কি মুরুগানের যা স্টেটাস, যা অর্থ, মেয়ের অভাব ছিল এ পৃথিবীতে? বিদ্যাকে ভোগ করে ছুড়ে ফেলে দেওয়াই স্বাভাবিক ছিল ওর পক্ষে। বিদ্যার কথায় চমক কাটল ওর। বিদ্যা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘অন্যমনস্ক হওয়ার অভ্যেস কি আর তোমার যাবে না?’ হাহাহাহা করে হেসে উঠল মুরুগান। ‘তুমি তো আমার সবটাই জান জানেমন! তোমার কাছে আমার একচুলও ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। তুমি আমার ভেতরটা দেখতে পাও, মাঝেমাঝে মনে হয় কাচের মতো যেন আমার শরীর আর মন’। ‘আচ্ছা, আচ্ছা, হয়েছে, হয়েছে! যা বলতে চাইছি শোন এবার মন দিয়ে’। মুরুগান গুছিয়ে বসল নিজেকে। বিদ্যা বলতে শুরু করল, ‘যেমন শুনেছিলাম আমার বরের কাছে, গাঁও বুড়োর কাছে, তেমনই বলছি। স্কন্দ পুরাণের কাবেরি পুরাণে বলছে, চন্দ্রবংশীয় ক্ষত্রিয় চন্দ্র বর্মা(যিনি ছিলেন মৎস্য দেশের সম্রাটের পুত্র)ছিলেন এই যোদ্ধার জাত কোরাবাদের পূর্ব পুরুষ। চন্দ্র বর্মা ছিলেন মহালক্ষ্মীর বিরাট ভক্ত। সারা ভারতে তীর্থ দর্শনে এবং মহালক্ষ্মীর মাহাত্ম্য প্রচারে সৈন্যসামন্ত সহ বেরিয়ে তিনি এসে পৌঁছলেন কোরাবা অঞ্চলে। তখন এখানে কোন রকম বসতি বিস্তার করেনি। জঙ্গল কেটে কাবেরি নদীর উৎস স্থল এই কোরাগুতেই তিনি কোরাবাদের প্রথম রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হলেন। তাঁর এগারোটি সন্তানের মধ্যে বড়, দেববর্মা এর পরে রাজা হন। ইনি আবার বিয়ে করেন বিদর্ভ রাজার মেয়েদের। এঁদের সন্তানসন্ততি মিলে এই কুরাগু রাজ্যে কোরাবাদের পাকাপাকি বসবাস শুরু হল’।
‘খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে শুনতে। এই নিয়ে ডিটেল জানতে হবে আমাকে। ভাল আইডিয়া দিলে’। ‘তা জেনে কি হবে শুনি? তুমিও কি রাজ্যপাট খুলবে নাকি কফিগাছ কেটে?’ আবার হেসে উঠল মুরুগান। ‘ইয়েস, ইয়েস মাই ডিয়ার। আমি হতাম কিং অব দ্য কোরাগু আর তুই হতিস আমার কুইন। পাটরানী’। আজ অনেক অনেকদিন বাদে মন খুব ঘন আর মজাদার হয়ে উঠেছে ওর। কেন জানি ওর নাচতে ইচ্ছে করছে। রেকর্ড চাপিয়ে দিল একটা। আর বসে বসে দুলতে শুরু করল। বিদ্যাও হাসছে খিলখিল করে। সন্ধে হয়ে এলো প্রায়। এই মেঘ, বৃষ্টির দিনে বিকেলেই যেন রাত নেমে আসছে। ঘরের আলো জ্বাললো উঠে ও। কুগানের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে, সে ব্যাটা কিছুই প্রায় খায়নি। অঘোরে ঘুমোচ্ছে সোফায়। মুখ দিয়ে লালা বেরিয়ে এসেছে গাল বেয়ে। আহা, বেচারা! এই কী নিয়তি এমন এক জলজ্যান্ত তরুণের! ভিজে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিল ওর। ঘাড়টা সোজা করে শুইয়ে দিল সোফায়। কখন ঘুম থেকে ওঠে কে জানে! মুরুগানের নেশা চড়ে গেছে আজ। ওরও বেশ নেশা হয়েছে। অনেকদিন বাদে খেল সে। বাড়ি যাবে না আজ। কেই বা আছে আর ওখানে? ভেবেছিল বুঝি মরদটা সুস্থ হয়ে উঠছে, উঠে বসেও ছিল, দু’একপা হাঁটছিল ঘরে। কিন্তু বিদ্যার কপালে সুখ লেখা নেই। তাই বুঝি দাওয়ায় বসে থাকা লোকটাকে গোখরোর ছোবল খেয়ে মরে যেতে হল। লোকটা পালাতেও পারল না, নড়তেও পারল। যেভাবে দাওয়ায় মাদুর পেতে বিদ্যা ওকে বসিয়ে দিয়ে গেছিল, সেভাবেই বসা অবস্থায় ঢলে পড়ল। সেদিন বিকেলে ঘরে ফিরে বিদ্যা দেখে সাপের বিষে নীল হয়ে গেছে মরদটা। তখন আর ঝাড়ফুঁক করেও কিছু করার ছিল না। লোকটার কপালে ছোবল দিয়েছিল গোখরোটা। নাকি বিদ্যার কপালেই আরও এক ছোবল দিয়েছিল? মলিন মুখের ভাবটা কাটিয়ে ফেলল বিদ্যা। লোকটা হয়ত মরে বেঁচে গেছে। এভাবে পঙ্গুর জীবন নিয়ে তাদের মতো ঘরে বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না। যাক্, এসব ভেবে আজ আর কোন ফায়দা নেই। আজ বরং এখানেই ঘুমিয়ে পড়বে।