ছোটদের জন্য বড়দের লেখায় সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে ঊশ্রী মুখোপাধ্যায় (নব্বইয়ের গল্প – ১৪)

প্রথম সবকিছু

গত পাঁচবছর ধরে একটি মেয়েদের কলেজে পড়াচ্ছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রীদের সঙ্গে বয়সের তফাৎ বাড়তে থাকলেও ভাগ্য ভালো যে ওদের অনেকেই ব‍্যাপারটা বিশেষ পাত্তা দেয় না। তাই দিদিমণি-ছাত্রীর জায়গায় ওদের সঙ্গে সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতোই। আর সেই বন্ধুত্বের সুবাদেই ওদের আমার কাছে প্রশ্নের শেষ নেই। “ম‍্যাম, আপনার ছোটবেলা কেবল ছিল? টিন‌এজ কেমন ছিল? আপনার ক্রাশ ছিল কারো ওপর? ভালো লাগতো কাউকে? কেমন ছিল আপনাদের সময়?” সব প্রশ্নের উত্তর সবসময় দিতে পারিনি, মনে হয়েছিল হয়ত ব‍্যক্তিগত কথা উঠে আসবে। কিন্তু আজ, নব্বইয়ের দশকের ছোটবেলা আর তারসঙ্গে অবধারিতভাবে ২০০০ এর দশকের মেয়েবেলার গল্প লিখতে বসেছি, ওদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে বেশ ইচ্ছে করছে।
“তোরা জানিস, আমাদের সময়টা ছিল ভীষণ অদ্ভুত। যতটা ঘটত, তার থেকে অনেকটা বেশি আমরা কল্পনা করে নিতাম। মণিমুক্তো না পেলেও রঙিন ঝিনুক কুড়িয়েও বেশ খুশি খুশিই লাগত। বেশি পাওয়ার উপায় ছিল না, তবে অল্প পেয়েও খুব একটা দুঃখ ছিল না। ছোটবেলা থেকে কিশোরীবেলায় আসার প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচেওছি, হয়ত সময় আলাদা, কিন্তু তোদের মত। ক্রাশ এসেছে, আরেকটু বেশি ভালোলাগাও। সাদামাটা জীবনটাই মনে হয়েছে হিন্দি সিনেমার মত, নিজেকে ভুলে নায়িকা সাজতেও ইচ্ছে করেছে ব‌ইকি! অবশ্য নায়ক বদলেছে, বার বার। ভাগ‍্যিস, অনেকের ওপর ক্রাশ হলেও কেউ দুশ্চরিত্র বলে এখনো খাপ পঞ্চায়েত বসায়না।
…জীবনের প্রথম শাড়িটা বের হত মায়ের আলমারি থেকে, সঙ্গে অবধারিত ভাবে ‘ন‍্যাপথলিন ব্র‍্যান্ড পারফিউম’। অষ্টমীর বা সরস্বতীপুজোর অঞ্জলির জন্য‌ই এ সুযোগ পাওয়া যেত তখন। নাইনে উঠে নিজেরো একটা লালপাড় সাদাশাড়ি(স্কুল ইউনিফর্ম) হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই বছর প্রথমবার বিশেষ সরস্বতীপুজোর জন্য বিশেষ নীল শাড়ি এসেছিল মায়ের আলমারি থেকেই। সেদিন শুধু শাড়ি নয়, যথেচ্ছ মেকআপ করার‌ও সুযোগ পেয়েছিলাম। আর চুপিচুপি বলে রাখি, সেই প্রথম শাড়ি, সাজ কোনটাই বৃথা যায় নি।
… তোরা ভাই অনেক বেশি বাস্তববাদী। আমরা বাপু মহা ফিল্মি ছিলাম। ধপাধপ প্রেমে পড়ে যেতাম সিনেমার হিরোদের। ওসব বোধহয় আজকাল তোদের বললে তোরা হেসে উড়িয়ে দিবি। কিন্তু আমরা এরকমই ছিলাম। ‘পহেলা নশা পহেলা খুমার’ বলে চা বাগানে সোয়েটার ওড়ানোর ,’টিপটিপ বরসা পানি’ র সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজার, নব্বইয়ের নায়িকাদের মত শিফন শাড়ি পরার ইচ্ছে বিলক্ষণ ছিল। আর কি জানিস, শুধু প্রথম প্রেমে পড়ে নয়, প্রথম ক্রাশ খেয়েও অনেকেই পস্তায়, বিশেষ করে যদি ক্রাশের নাম অক্ষয়কুমার হয়। তার ওপর ফিল্মস্টারদের (তখন সিনেমা আর্টিস্ট বলত) পছন্দ করলে তখন বেশ বকা খেতে হত, ক্রিকেটার রা সেদিক থেকে সুবিধাজনক ছিল। তাই খবরের কাগজ থেকে ছবি কেটে আর বিগফান বাবলগামের কার্ড জমিয়ে পরে রাহুল দ্রাবিড়ের স্ক্র‍্যাপবুক বানালেও বাবা মা বিশেষ আপত্তি করেন নি।
… ছোট থেকে হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়া বেশ লাগত। নিজেকেও বড় বেশি গুরুত্ব দিতে ইচ্ছে করত। প্রথম শাড়ি পরা, সাইকেল চালিয়ে কোচিং ক্লাস যাওয়া, বয়কাট ছেড়ে লম্বা চুল রাখার স্বাধীনতা পাওয়া, ইউনিফর্ম ছেড়ে অন‍্য পোষাক পরতে পারলে একগাদা সেজে ফেলা, সব চলত। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করত লালপাড় সাদাশাড়ি পরে,কোন এক নীল ফুলপ‍্যান্ট সাদা শার্টের পাশে গঙ্গার ধারে বসতে, কিন্তু বাদ সাধত স্কুলের লিখিত নোটিশ,” ছাত্রীদের জানানো যাইতেছে যে তারা যেন বিদ্যালয়ের পোষাক পরে কোনো অশোভন আচরণ না করে”। অগত্যা। ‘ভালো মেয়ে’ হ‌ওয়ার ঝামেলা নেহাত কম‌ও ছিল না!
…কোচিং ক্লাসের ব‍্যাপারটাও ছিল বেশ মজাদার। বিশাল এক ব‍্যাচের এক পাশে ছেলেরা বসতো, একপাশে মেয়েরা। ঠিক মাঝখানে “বাফার জোনে’ বসতেন স‍্যার। তা সত্ত্বেও চোখাচোখি, ইশারা নেহাত কম হত না। আমাদের একজন দিদিমণি বলতেন,’কোচিং ক্লাস গুলো হচ্ছে বৃন্দাবন’। ভুল ছিল না খুব একটা। আসলে মফস্বলে সাইকেল নিয়ে পড়তে যেতে পারলে, এক ধাপে অনেকটা বড় হয়ে যাওয়া যেত। সত্যি সত্যি বড় হ‌ওয়ার চেয়েও মজার ছিল এই ‘বড় হয়ে গেছি’ ভাবনাটুকু। তোদের অভিজ্ঞতা ও বোধহয় অনেকটাই এক, তবে তোরা বোধহয় এখন একসঙ্গে বসিস, তাই না?
…. আমাদের অতি সাধারণ জীবনে অনেকটা নতুনত্ব আনতো পুজোর, বিয়েবাড়ির বা অন‍্যান‍্য উৎসবের দিনগুলো। ঠিক যেমন আমাদের সারাবছর আটপৌরে থাকা মায়েরা সাজতেন ঐ সব দিনে। সে সাজের তেমন কিছু বাহুল্য না থাকলেও নতুন জামা, শাড়ি, দু একটা তোলা গয়নায় অনেকটা পালটে যেতাম সবাই। লাল গোলাপ দেওয়া হত বিয়েবাড়িতে বরযাত্রীদের, আর কি করে কে জানে, তার একটা আটকে যেত যে গোলাপ দিচ্ছে, তার চুলে।এরকম অনেক অজানা সমীকরণ এর ফল‌ই ছিল একটা বিয়েবাড়ির পর অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের অনেকগুলো সম্বন্ধ আসা। বেশিরভাগ‌ই হত না, তাও উৎসাহের কমতি কারো ছিল না। পুজোয় প্রথমবার হিল পরে আছাড় খাওয়ার অভিজ্ঞতাও মনে আসে, সে লজ্জা দ্বিগুণ বেড়ে যেত, যখন ভিড়ের মধ্যে সাহায্য করতে আসত বিশেষ কোন হাত।
…. সেসময় ফেসবুক খায় না মাথায় দেয় জানতামই না। তার জায়গায় বন্ধুদের জানতে রাখতাম ঝকঝকে ছবিওলা সাজানো ‘স্ল‍্যামবুক’। বন্ধুদের স‌ই করাতে করাতে টুক করে ফিল‌আপ করতে দেওয়া হত পছন্দের মানুষকেও। গুগল এলেও খুব একটা হাতের নাগালে ছিল না, গোগ্রাসে গিলতাম উনিশ কুড়ি। স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর লেখা প্রথম সেখানেই পড়া। মফস্বল, কোচিং আর প্রেমের সমীকরণে প্রায় ক্লিন বোল্ড করে দিয়েছিলেন ভদ্রলোক, সে পরে যতই সমালোচনা করি না কেন।
….. সময়ের সঙ্গে ভালোলাগা এসেছে, কিছুটা অপাত্রের প্রতিই। সে ব‍্যক্তির কুৎসিত চেহারা চোখেও পড়েছে, ঠিক যেমন কল্পনার ছেলেবেলা, রংচঙে মেয়েবেলার ওপরেও একটা দাঁতনখ‌ওয়ালা বাস্তব অপেক্ষা করে। তাও আজও বিশ্বাস করি যে, আমাদের দশকের প্রেম মিকি মাউস আর মিনির মত, শেষে হ‍্যাপি এন্ডিং হতেই হবে, সব কিছুর পরে। অবশ্য এরকম বোধহয় তোরাও ভাবিস, বিশ্বাস করিস, আমরা সবাই এখানে এক। আমাদের উপরি পাওনা অবশ্য একটু নব্বইয়ের ম‍্যাজিক। ব‍্যাপারটা কি জানিস, এখনো মনে হয় কবীর সুমন আমাদের জন‍্য‌ই গাইছেন,”নতজানু হয়ে ছিলাম তখন, এখনো যেমন আছি”, দার্জিলিংয়ের ম‍্যালের একপাশে গীটার বাজাচ্ছেন অঞ্জন দত্ত, আর এক অজানা নেপালি ছেলে আর তার প্রেমিকার জন্য জমা হচ্ছে একটু একটু মন খারাপ। দূরে গঙ্গার ঘাটে ভেসে যাচ্ছে আদরের নৌকা, শোনা যাচ্ছে ভাটিয়ালি সুর, সব মিলিয়ে আমাদের মত সাধারণ জীবনে একটু একটু স্বপ্ন দেখার সুযোগ, একটু ভালোবাসার সুযোগ কোথাও না কোথাও থেকেই যায়। তোদের‌ও থাকবে।
…..’ বিশ্বাস কর,আর ঠিক এই সময়েই ম‍্যাজিক হয়। আজও কোন ব‍্যস্ত শহরের ব‍্যস্ত রাস্তায় সন্ধে নামে, হঠাৎই সুযোগ হয়ে যায় এমন কারো সঙ্গে ফুটপাথ দিয়ে দু’পা হাঁটবার যার সঙ্গে দু’মিনিট ও হয়ে যায় অনন্তকাল। আর ঠিক তক্ষুণি কোথা থেকে চলে আসে এক বাঁশিওয়ালা। বাঁশিতে ফুঁ পড়ে,”না হো তু উদাস তেরে পাস পাস ম‍্যায় রহুঙ্গা জিন্দেগি ভর, সারে সংসার কা প‍্যার ম‍্যায়নে তুঝিমে পায়া”।
আমাদের সময়টা এরকমই। নব্বই কে এখনো সঙ্গে নিয়েই ঘুরি রে। আর মনে হয় একদিন তোরাও ভাববি তোদের সময় নিয়ে। তখন তোরাও লিখিস কিন্তু। মনে থাকবে?”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।