রাজারাজেন্দ্র বুঝতে পারছিলেন রানীর মনোবাঞ্ছার কারণটি কী। রানীকে বোঝার মতো শিক্ষা, ধী তাঁর আছে। সেদিন যখন স্যার রবার্টের সঙ্গে চুক্তি নবীকরণের জন্য তিনি বীরারাজেন্দ্রপেটে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেদিনই রানীর শরীর কিঞ্চিৎ খারাপ হয়েছিল। তিনি যাওয়ার জন্য রাজি হচ্ছিলেন না। রানী তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠান রবার্ট অ্যাবারক্রম্বের কাছে। রানী বলেছিলেন, ওখানে না গেলে বিরূপ ধারণা জন্মাবে। তাঁর শরীর এমন কিছু খারাপ নেই যে, এই তুচ্ছ কারণে রাজাকে চুক্তির দিন বাতিল করতে হবে। এমনিতেই এখন, এই ১৭৯৩ সালে স্যার অ্যাবারক্রম্বে কম্যান্ডার ইন চিফ। তাঁর সঙ্গে চুক্তির দিন বাতিল করা, তাঁকে অবমাননার তুল্য। তাই দ্বিধা কাটিয়ে রাজারাজেন্দ্র রওনা হলেন বীরারাজেন্দ্রপেটের দিকে। আগের মতোই সাদরে অভ্যর্থনা জানাল বীরারাজেন্দ্রপেটবাসী। রাজা এখন তাদের কাছে ঈশ্বরতুল্য। তাঁকে দেখার জন্য, দূর থেকে ফুল ছুড়ে স্বাগত জানানোর জন্য পথের দুধারে, প্রতিটি বাড়ির ছাদে, অলিন্দে শুধু মানুষের ঢল। রাজা দুহাত তুলে তাদের অভিনন্দন জানালেন। বৃটিশ সেনাপ্রধানের তরফ থেকে অফিসাররা এগিয়ে এলেন এবার। রাজাকে নিয়ে চললেন স্যার অ্যাবারক্রম্বের কাছে। রাজেন্দ্রর সঙ্গে অবশেষে সাক্ষাৎ হল স্যারের। স্যারকে একটু যেন বয়স্ক লাগছে। জানলার পাশে এক আরামকেদারায় বসে আছেন তিনি। ঝুঁকে অভিবাদন করে রাজেন্দ্র কুশল বিনিময় করলেন প্রথমেই। ‘বর্তমানে আপনি সুস্থ আছেন তো? কেমন যেন শুকনো দেখাচ্ছে আপনাকে’। স্যার অ্যাবারক্রম্বে মৃদু হাসলেন। তারপর বললনে, ‘আমার সামনে আসুন। অত দূর থেকে আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না ঠিক মতো’। রাজন্দ্রর স্যারের সামনে বসার ব্যবস্থা করা হল। তারপর স্যারের মুখেই শুনলেন যে, তিনি বর্তমানে চোখের সমস্যায় ভুগছেন। দূরের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়েছে একটু। এই নিয়েই বর্তমান সমস্যা। নইলে আর কিছু অসুবিধে নেই তাঁর শরীরে। যথারীতি তাঁদের মধ্যে চুক্তি নবীকরণ হয়ে গেল এরপর। রাজারাজেন্দ্রর এর মধ্যেও রানীর জন্য দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন। হয়ত তাঁর চোখমুখে চিন্তার ছাপ পড়েছিল। সেই দেখেই স্যার অ্যাবারক্রম্বে নিজেই জিজ্ঞেস করলেন রাজাকে, ‘রাজা, আপনি কি কোন কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত?’ রাজেন্দ্র ধরা পড়ে যাওয়ার ভঙ্গীতে ইতস্তত করছিলেন খানিক। ভাবছিলেন একান্ত ব্যক্তিগত চিন্তা স্যারের কাছে বলা উচিত হবে কিনা। রাজেন্দ্রকে লক্ষ্য করে স্যার অভয় দিলেন। আশ্বাস জোগালেন যেন। ‘আপনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলুন রাজা। আমরা তো বন্ধু। এতদিন বাদে দেখা হল আমাদের। আপনাকে এমন চিন্তিত দেখতে আমার ভাল লাগছে না। বন্ধুর কাছে গোপন করতে নেই কিছু’। রাজা এবার সব খুলে বললনে। রানী মহাদেবাম্মার খবর শুনে স্যার প্রথমে খুব খুশি হলেন এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খবর পাঠালেন সঙ্গে সঙ্গে। রাজারাজেন্দ্রর সঙ্গে স্যারের আদেশে বৃটিশ ডাক্তার চললনে নালকনাড়ু প্রাসাদে।
মহাদেবাম্মা প্রথমে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। কোন বিদেশী সাদা সাহেবের সামনে তিনি যেতে রাজি হচ্ছিলেন না কিছুতেই। তার ওপর তাঁর শরীর পরীক্ষা করবে এক সাহেব—এটা ভাবতেই রানীর লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল। এদিকে রাজা রাজেন্দ্র পড়েছেন মহা বিপাকে। সাহেব ডাক্তার অপেক্ষা করছেন রানীকে পরীক্ষা করবেন বলে। এদিকে রানী কিছুতেই তাঁর সামনাসামনি হবেন না। রাজা পড়েছেন শাঁখের করাতের পাল্লায়। শেষমেশ উপায় না দেখে তিনি সেই ডাক্তারকেই খুলে বললেন সবটা। ডাক্তার আবার মহা রসিক ব্যক্তি। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে কোন চিন্তা করবেন না আপনারা। আমার চোখ বেঁধে দিন বরং। আমি তাঁকে দেখতে না পেলে তো আর রানীমা লজ্জা পাবেন না!’ অসহায় রাজা সেই ব্যবস্থাই নিলেন অগত্যা। রানীর মহলে রাজা রাজেন্দ্র স্বয়ং চোখ বাঁধা ডাক্তারকে নিয়ে গেলেন মহাদেবাম্মার কাছে। সে ঘরে তখন রাজার বৈদ্য উপস্থিত। রাজবৈদ্যর কাছে সাহেব প্রথমেই রানীর হালহকিকত জেনে নিলেন। এরপর রানীকে কিছু প্রশ্ন করলেন সাহেব। সাহবের কোমল সহানুভূতিপূর্ণ কণ্ঠ শুনে রানীমার জড়তা, ভীতি বা লজ্জা কেটে গেল ধীরে ধীরে। যদিও আগাগোড়া কথাবার্তা সবই হচ্ছিল দোভাষীর মাধ্যমে। যথারীতি তারও চোখ বাঁধা ছিল সেই সময়ে। এমনকি রাজার সঙ্গেও স্যার অ্যাবারক্রম্বের আলোচনা, সবই ঘটেছে এই দোভাষীর মাধ্যমেই। রানী সেই প্রথম এত কাছে থেকে একজন সাহেবকে দেখলেন। সাদা চামড়া আর ডাক্তারের ঈশ্বরের মতো রূপ দেখতে দেখতে ঘরের আলাপ আলোচনা থেকে সবটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। সেযাত্রা অবশ্য সেই সাহেব ডাক্তারের সামনে রানীর লজ্জা কেটে গেছিল। পরের দিন আর তাঁর চোখ বাঁধার প্রয়োজন পড়েনি।
রাজবৈদ্যকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে, কিছু ওষুধের ব্যবস্থা করে, যাওয়ার সময়ে সেই সাহেব ডাক্তার রাজাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। রানী এবং তাঁর সন্তান সুস্থই আছে। খুব শিগগিরিই তাঁরা পিতামাতা হতে চলেছেন। ভয়ের কিছু আপাতত নেই। রাজা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন তখন। আর সেদিন রাতেই রানী জানিয়েছিলেন তাঁর মনোবাঞ্ছা। ‘ভাব তো একবার চোখ বুজে! স্যার অ্যাবারক্রম্বের সঙ্গে যদি তুমি নিজেই কথাবার্তা চালাতে পারতে, কত ভাল হত! কত মান বাড়ত তোমার, আমার, এমনকি পুরো রাজ্যবাসীরও। এ কী কম কথা গো! সাহেবের সঙ্গে সমানে সমানে তাদের বুলিতে, তাদের আচারে ব্যবহার করা! তুমি সেই শিক্ষা পাওনি। আমার কথা বাদই দাও। মেয়েরা তো পর্দার আড়ালেই রয়ে গেল সারা জীবন। এবার ধর, আমাদের যদি পুত্র সন্তান হয়, তাকে আমরা বিদেশে পড়াশুনো শেখাব। স্বয়ং রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে প্রতিপালিত হবে সে। আমাদের কত মান ইজ্জত বাড়বে, তুমি বুঝতে পারছ?’ রানীর কথায় উদ্বেল হয়ে গেলেন রাজা। তারপর আবেগের বিহ্বলতা কাটিয়ে বললেন, ‘কিন্তু তাহলে তো তাকে আমাদের থেকে দূরে পাঠিয়ে দিতে হবে। এমনকি রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে পালিত হলে, তাকে বিধর্মীও হতে হবে। ভেবে দেখেছ এদিকটা?’ রানী পাল্টা জবাব দিলেন, ‘আর যদি ছেলে না হয়ে আমাদের মেয়ে হয়? তাহলে কী হবে? তুমি তাকে বিলেতে পালতে পাঠাতে পারবে?’ দুজনেই যেন অকূল পাথারে পড়লেন এবার। এদিকে রানী জেদ ধরে আছেন। ছেলে বা মেয়ে, যাই হোক, তাকে বিলেতে পাঠিয়ে লেখাপড়া শেখাতে হবে। সাহেবদের মতো ইংরেজি বলা শেখাতে হবে। কেমন সুন্দর আচার, ব্যবহার ওদের। ‘কিন্তু ধর্ম গেলে যে সব গেল!’ রাজেন্দ্রর এই কথায় রানীর চোখ জ্বলে উঠল অভিমানে। ‘ও! তার মানে তুমি আমার কথা রাখবে না? আমি কোনদিন কিছু চাইনি তোমার কাছে। মুখেই তোমার যত ভালোবাসার কথা। একটি মাত্র চাহিদা আমার, সেটুকুও তুমি রাখবে না। স্রেফ নিজের স্বার্থ দেখার জন্য, মেয়েকে বিলেতে পাঠালে দুর্নাম হবে, এই ভয়ের জন্য, ধর্ম গেলে পাপ হবে এই শঙ্কার জন্য…’ কথা শেষ না করে রানী অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন শিশুর মতো। রাজা রাজেন্দ্রর আর কোন উপায় ছিল না এরপর। কোন পুরুষ আর নারীর চোখের জলের সামনে নিজের যুক্তিবুদ্ধিকে কাজে লাগাতে পেরেছেন! তাছাড়া রানীর শরীর যদি খারাপ হয়, এই ভয়ে রাজার তখন দিশেহারা অবস্থা। ভাবনা চিন্তার ধারে কাছে না গিয়ে রানীকে তিনি তৎক্ষণাৎ কথা দিলেন। ‘তুমি শোন, কেঁদ না লক্ষ্মীটি! আমি তোমার কথা রাখব, এই তোমার গা ছুঁয়ে শপথ নিলাম। এবার খুশি তো? আর কান্নাকাটি করে আগত শিশুটির বিপদ ডেকে এন না’। রাজার কথায় কাজ হল। চোখ মুছে একগাল হাসি নিয়ে রাজার গলা জড়িয়ে ধরলেন রানী। সুখে, খুশিতে, আর কিছুটা আশঙ্কায় রাজার বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম শব্দে দামামা বাজতে লাগল।
দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে কুপিল্লার বুকের ভেতরেও। এই রাতে আর বাবামাকে কিছু বলেনি ও। কাল সকালে জলখাবারের সময়ে একটা হেস্তনেস্ত করবে ও। ভাবতেই আবার বুক কেঁপে উঠল কুপিল্লার। বাবার মুখের ওপর বিদ্রোহ করার কথা এতদিন সে স্বপ্নেও ভাবেনি। কিন্তু ওকে বলতেই হবে সব। তারও শরীরে কোরাবার বীর রক্ত রয়েছে। রাজেন্দ্রর নাম উচ্চারণ করল মনে মনে সে। দুহাতের মুঠি শক্ত করে মনে মনে উচ্চারণ করল—পারতে আমাকে হবেই। বিদ্যাকে আমি কথা দিয়েছি।