|| মানচিত্র আর কাঁটাতার, হৃদয় মাঝে একাকার || বিশেষ সংখ্যায় ঋতব্রত গুহ

দেশভাগ

১।
“ সব গুছিয়ে নিয়েছিস তো ! অনেকটা পথ যেতে হবে কিন্তু ! ” কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন নগেন্দ্রনাথ । শরীর টা অবশ লাগছে নগেন্দ্রনাথের । মনে হচ্ছে আজ এর থেকে বোধ হয় মৃত্যু অনেক ভালো । এই বয়সে এসে এমনভাবে নিজেদের ভিটেমাটি ছাড়তে হবে এটা কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি । চারপাশের যা পরিস্থিতি তিনি নিজেও উপলব্ধি করছেন আর হয়ত এখানে ফেরা হবে না । কাল থেকে সবটাই বদলে যাবে । বারবার প্রচার করা হচ্ছে কালকের মধ্যে সবাইকে পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে হবে । কোনটা পাকিস্তান আর কোনটা ভারতবর্ষ তিনি এখনও ভালো করে বুঝতে পারেননি । গতকাল রাতে তার বড় ছেলে বিনয় একটা নক্সা নিয়ে তাকে বুঝিয়েছিল বটে । বিনয় এককালে রাজনীতি করত । এখন আর করে না । বোধহয় ও কিছুটা বীতশ্রদ্ধ । র্যাডক্লিফ সাহেব , মাউন্টব্যাটেন অনেকের কথা বলছিল বিনয় । এত সব ভারী ভারী কথা বুঝতে পারেননি নগেন্দ্রনাথ । শুধু ছেলের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন “ বাংলার আবার পশ্চিম পূর্ব কি রে । পুরোটাই তো বাংলা ।”
বিনয়ের মাথায় এখন অনেক চিন্তা । মা গত হয়েছেন বছর তিনেক হল । ভালোই হয়েছে । এই বয়সে উদ্বাস্তু হওয়ার মানসিক আঘাত থেকে অন্তত তিনি রক্ষা পেয়েছেন । মানুষ এখন ধ্বংস লীলায় মত্ত । এত ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে কোন ধর্মের খোঁজ করছে মানুষ কে জানে ! রাস্তায় বের হলেই পোড়া লাশের গন্ধ । শকুনের মত রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধর্ষণ কামী নরপিশাচ রা । দুই বোনকে এদের হাত থেকে বাঁচিয়ে শেষমেশ ওপারে পৌছনোটা এখন সবচেয়ে বড় বিষয় । একসাথে অনেক পরিবার আজ রাতে রওনা দেবে ওপার বাংলার উদ্দেশ্যে । পুলিশ বলেছে বটে কোন ভয় নেই । কিন্তু কাউকেই আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না বিনয়ের । এই পাড়ায় জন্ম হয়েছে বিনয়ের । এখানেই বড় হয়েছে । এই পাড়ার কোন মানুষটা কোন ধর্মের সেটা নিয়ে মানুষের আগে তেমন চিন্তা ভাবনা ছিল না । বছর তিনেক আগে থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করল । এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের ওপর ক্রুদ্ধ হতে হতে ক্রমশ হারিয়ে ফেলল মনুষ্যত্ব । যে বন্ধুর সাথে ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে বিনয় , জীবনের সব হাসি দুঃখ ভাগ করে নিয়েছে সেই ইকবাল বিনয়কে খুন করতে গিয়েছিল । নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি বিনয় । কোন রকমে নিজেকে বাঁচিয়েছিল সে । চারপাশ থেকে নিজের ধর্মের মানুষদেরও এমন নিষ্ঠুর আচরণের কথা শুনত বিনয় । বিনয় এখন বুঝতে শিখেছে হিন্দু মুসলিম বলে আসলে কিছু হয় না । ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষ এই দুইয়ের বাইরে আর কোন বিভাজন হয় না । রহমান চাচা , আকবর চাচার মত দাপুটে মানুষ গুলো ছিল বলে এ মহল্লার হিন্দুরা এখনও বেঁচে রয়েছে । এমন মানুষ যদি প্রতি মহল্লায় থাকত তবে হয়ত পরিস্থিতি এতটা খারাপ হত না ।
“ সব তো গুছিয়ে নিয়েছি বাবু । জানি না কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য ! “
নগেন্দ্রনাথ বিনয়ের মাথায় হাত রাখল ।
“ মা এর ছবি নিতে কিন্তু ভুলিস না বিনয় । স্মৃতি বলতে তো কিছুই থাকবে না । চাইলেও তো আর ফেরত আসা যাবে না । “
বিনয় মাথা নাড়ল । মা এর কথা মনে পড়লেই মনটা ভারী হয়ে ওঠে বিনয়ের । এই বাড়ির প্রতিটি কোণে কত গল্প জুড়ে রয়েছে ! মা আজ নেই । কিন্তু স্কুল থেকে পড়িয়ে যখন বাড়ি ফিরত বিনয় তখন বাড়িতে ঢুকেই মা এর গা এ লেগে থাকা গন্ধটা পেত বিনয় । মা কে অনুভব করতে পারত । একটা দেশভাগ কতকিছু কেড়ে নিল ! আরও কতকিছুই বা কেড়ে নেবে । প্রায় বারোটা বাজতে চলল । আফিয়া নিশ্চয় চলে এসেছে । আজকের পর আর আফিয়ার সাথে দেখা হবে না বিনয়ের । এই শেষবার । আফিয়া নিশ্চয় খুব কান্নাকাটি করছে । বিনয়ও কেঁদেছে । কিন্তু সবার অগোচরে । ওখানে গিয়ে গোটা পরিবারের হাল ধরতে হবে বিনয়কে । অতএব এমন পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়লে চলবে না । কিন্তু মন এত যুক্তি কবেই বা বুঝেছে ! আফিয়ার সাথে বিনয়ের সে কতদিনের সম্পর্ক ! আফিয়া রহমত চাচার মেয়ে । ছোটবেলার বন্ধুত্ব । দুজনে ভেবেছিল সামনের বছর বিয়ে করবে । সবটাই তো ওলট পালট হয়ে গেল ।
২।
বিনয় দুর থেকে দেখল আফিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে । আফিয়ার চোখের দিকে তাকানোর শক্তি নেই বিনয়ের । আজ বোধহয় দেখাটা না হলেই ভালো হত ।
“ আফিয়া ! “
আফিয়া পেছনে তাকাল । দুজনের মাঝখানে যেন একজীবনের দূরত্ব । দুটো স্বাধীন দেশের দূরত্ব । কিছু মুহূর্তের নিস্তব্ধতা । কান্নায় ভেঙে পড়ল আফিয়া । বিনয়ের চোখের জলও চিবুক ছুঁয়েছে । আফিয়া বিনয়কে জড়িয়ে ধরল ।
“ তুমি যেও না । বাবা বলেছে এখানে থাকলে কিছু হবে না । “
“ এ কথা বললে হয় পাগলি ! তোমার বাবা যদি আর আমাদেরকে রক্ষা করতে চায় দেখবে ওরা তোমার বাবাকেই মেরে ফেলেছে ।” আফিয়া বুদ্ধিমতী মেয়ে । আফিয়া বাস্তব চিত্রটা জানে । কিন্তু মন কি আর মানতে চায় !
“ তবে এটাই কি শেষবার দেখা বিনয় ! “
বিনয় কোন উত্তর দিল না ।
“ আমাকে বিয়ে করে তোমার সাথে নিয়ে চল বিনয় ! আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না ! “
বিনয় হাসল ।
“ আমি কি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব আফিয়া ! পারব না । তোমাকে ছাড়া বাঁচা তো একপ্রকার জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকা । ওখানে গিয়ে কি করব , কি খাব কিছুই জানি না আফিয়া । তোমাকে এমন অনিশ্চিত জীবনের দিকে কি করে নিয়ে যাই বল তো । আর পথে তো দাঙ্গাবাজদের ভয় রয়েইছে । জানি না ধর্ষণ , খুন , লুট ইত্যাদির মান্যতা কোন ধর্ম দেয় ! যতদূর জানি আমার আর তোমার ধর্ম তো পবিত্র । সেখানে তো মানুষকে ভালোবাসার কথাই বলা হয়েছে । ” দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিনয় ।
“ আমাকে ভুলে যাবে তাই না ! “
“ না । যদি বেঁচে থাকি ভুলব না আর যদি মরে যাই …..”
আফিয়া বিনয় কে কথাটা শেষ করতে দিল না ।
“ কিছু হবে না তোমার । দেখবে তুমি খুব ভালো থাকবে । আমি আল্লার কাছে তোমার জন্য দুয়া করি । দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে । “
গলার কাছে একদলা কান্না জমা হয়ে রয়েছে বিনয়ের । আফিয়াকে ও নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে । বিনয়ের পক্ষে এই ভালোবাসা কে অতিক্রম করে একটা স্বাভাবিক জীবন কাটানো সম্ভব নয় ।
“ ভগবান তোমার মঙ্গল করুক আফিয়া । তুমি ভালো থেক । আর বিয়ে করো কিন্তু । জেদ ধরে থেকো না । “
“ আর কখনো কি দেখা হবে না আমাদের ! ” আফিয়া কাতর স্বরে প্রশ্ন করল ।
বিনয় হাসল।
“ হয়ত হবে । অনেক দিন বাদে । যখন মানুষ ধর্ম নিয়ে আর খেলবে না । যেদিন মানুষ সত্যিকারের স্বাধীনতার মানে বুঝতে শিখবে । আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসব আফিয়া । জানি না কবে ! কিন্তু আসব । ”
.
এই মুহূর্তে শুধু এই কথাটাকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে আফিয়ার ।
“ আর কথা বললে কষ্ট বাড়বে আফিয়া । তুমি বাড়ি যাও । “
“ এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলছ যে আজ ! “
“ এই যে বললাম কষ্ট টা বাড়বে । তুমি চলে যাও আফিয়া । আর এক মুহূর্ত থেকো না এখানে । “
শেষবারের জন্য আফিয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বিনয়কে ।
আফিয়া চলে যাচ্ছে দূরে । বিনয় তাকিয়ে রয়েছে আফিয়ার দিকে । মনের মৃত্যু হচ্ছে ক্রমশ । রাজনীতির হিসেব গুলো মেলাতে পারছে না বিনয় । পূর্ব আর পশ্চিম বাংলার মধ্যে শুধু ভাগ হয় নি। ধর্ম আর রাজনীতি আড়াআড়ি ভাবে একটা দাগ টেনে দিয়েছে আফিয়া আর বিনয়ের মধ্যেও ।
৩।
মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত । শেষবারের জন্য পেছনে তাকালেন নগেন্দ্রনাথ । ইহজীবনের সবস্মৃতি ফেলে রেখে এবার এগিয়ে যাবার সময় এসেছে । আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে প্রতিবেশীরা উকি দিয়ে দেখছে । রহমান চাচা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবটা তদারকি করছেন । আজকে বিনয়দের মাথার ওপর ছাদ নেই । কবে আবার ছাদ হবে সেটাও জানে না কেউ । শিক্ষক হিসেবে বিনয়ের পরিচিত ছিল এলাকায় । আজ থেকে সেই পরিচিতিটাও নেই । । আজকে থেকে একটাই পরিচিতি ওদের। উদ্বাস্তু ! “ দেশভাগ আর কিছুই অবশিষ্ট রাখল না । ” স্বগতোক্তি করল বিনয় । যাত্রা শুরু হল । অনেক দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আফিয়া । এমন স্বাধীনতা সে সত্যি কখনও চায় নি ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।