ক্যাফে ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ৩২)

দশম অধ্যায়

দ্বিতীয় পর্ব

মানব বলে চলেছে,”তোমরা তো শুনেছ ও ছবিতে দেখেছ, HRA’র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে HSRA অর্থাৎ সমাজতন্ত্র নামটা যুক্ত হয়েছে;না,শুধু যুক্ত করা নয়,সমাজতন্ত্র- কে বাস্তবায়িত করার জন্য দেশের সমস্ত বিপ্লবী দলগুলোকে নিয়ে একটা কেন্দ্রীয় কমিটি তৈরি করা হয়।দিল্লির ফিরোজশা কোটলা মাঠের সভায় সংযুক্তিকরণের দিন প্রায় সব প্রদেশ থেকেই কেউ না কেউ হাজির ছিল;বাংলা থেকে কেউ উপস্থিত ছিল না,অবশ্য বাংলার অনেক নেতাই তখন জেলবন্দী ছিলেন;” বলে মানব দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

“প্রথম দিকে দেশে বিপ্লবী কর্মকান্ড, ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় চললেও, পরে তা আরও একধাপ এগিয়ে সমাজতান্ত্রিক আর্ন্তজাতিকতা-বাদে রূপ পায়; ‘বন্দেমাতরম’স্লোগান পরিবর্তিত হয়ে
‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক্’, স্লোগানই হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের রণধ্বনি।সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে,সাম্যের ভিত্তিতে সমাজের সকল স্তরের মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশ ঘটানোই হবে স্বাধীন দেশের সরকারের একমাত্র লক্ষ্য। তোমরা বড় হও,বুঝতে পারবে; লক্ষ্যে পৌঁছোতে গেলে দরকার
‘পাওয়ার ‘বা ক্ষমতা,আর সেটা আসবে স্বাধীনতার পথ বেয়ে।আমাদের ভগৎ সিংজি ও তাঁর সাথীরা সেই লক্ষ্যেই জীবন উৎসর্গ করেছেন।এর আগে,’গাদার আন্দোলন’ অসফল
হয়েছে,কারণ সেখানে জন- মানসের
কোন ভূমিকা ছিল না।এবার ভগৎ সিং
ও তাঁর সাথীরা সেই ভুল করেনি,দেশ হয়েছে উত্তাল।গান্ধীজি- আরউইন আলোচনায়,গান্ধীজি,একবারও ভগৎসিং ও তাঁর সাথীদের মৃত্যুদণ্ড
রেহাত করার কথা তোলেননি; তা শাপে বর হয়েছে; যদি গান্ধীজির কৃপায় ওঁদের
জীবন রক্ষা পেত,তবে তা হত ওঁদের প্রতি চরম অবমাননা প্রদর্শন; অবশ্য রাজনীতিতে, কে আর তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে
(প্রতিপক্ষকে)বাঁচিয়ে রেখে আখের গুছিয়েছে, অন্ততপক্ষে ,আমাদের এ পোড়া দেশে,এ উদাহরণ মেলা ভার।

বৃটিশের বশংবদেরা,দেশের যুব- সম্প্রদায়কে বিপ্লবের পথ থেকে সরে এসে আপোষর পথে,আলোচনার পথে এসে, সময় নিয়ে আন্দোলনকে স্থিমিত বা বিপথে চালিত করার চেষ্টা চালিয়েছে।পৃথিবীর কোথাও কোন দেশ কখনও ভিক্ষা করে স্বাধীনতা বা অত্যাচারীর বদান্যতায় স্বাধীনতা পায়নি।স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে বৃটিশ সরকার, নিজেদের গোঁজ প্রার্থীকে এনে প্রচারের আলোকে তাঁকে প্রাধান্যে প্রতিষ্ঠিত করেছে।1857সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ও 1914-15 সালের গাদার সদস্যদের সক্রিয় সহযোগিতায় সারা ভারতে সেনা বিদ্রোহের চেষ্টা ব্যর্থ হলেও বৃটিশ সরকার বুঝতে পেরেছিল, ভারতীয় সেনা দিয়ে আর ভারত শাসন সম্ভব হবে না।বিপ্লব চূড়ামনি রাসবিহারী বসু হলেন দেশান্তরী,অনেককেই ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হল;কিন্ত, বৃটিশের শাসন ব্যবস্থা হয়ে গেল নড়বড়ে;এরপরই বৃটিশ জড়িয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে; প্রয়োজন হল,ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সক্রিয় সাহায্য, পরিবর্তে মিলবে,যুদ্ধের পর সেল্প গর্ভমেন্ট। সাহায্য নিল পুরোপুরি,তারপরই প্রকাশ পেল নিজেদের স্বরূপ।

“অসহযোগ- আন্দোলন, ব্যর্থ হয়েছে;গান্ধীজি নিজেকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিয়েছেন বটে,তবু কংগ্রেসের মধ্যে আপোষকারী,কায়েমী-
স্বার্থের প্রতিভূ-গোষ্ঠী,বিপ্লবের পরিপন্থীদের সহায়তায়,কংগ্রেসের উপর নিয়ন্ত্রন রেখেছেন; আর ঐ গোষ্ঠী তো,উনার কাছে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করেছে।দেশে কোন বড় আন্দোলন না হলেও, নতুন, নতুন চিন্তাধারা নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব হয়েছে।সুভাষচন্দ্র বসু,পণ্ডিত জওহরলাল ,সাধু ভাশ্বানি প্রভৃতি নেতারা যুব সমাজের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছেন।সাধু ভাশ্বানি’র ‘Bharat YubaSangh’ এর ভিত্তি ছিল,’Back to the Vedas’।তাঁর মতে,Mazzani,Voltaireঅথবা লেলিন,টলস্থয়ের শিক্ষা থেকেআমাদের
নেবার কিছু নেই; আমাদের ‘বেদে’ সব আছে,অর্থাৎ আমাদের ঋষিদের অনুসরণই যথেষ্ট। তিনি ছিলেন কবি,শক্তির পূজারী; শাক্তধর্ম মতালম্বী,দেবীশক্তির প্রতি তাঁর অটুট বিশ্বাস ; স্বাতন্ত্র্যে,তিনি ভারত মাতার আহ্বান শুনতে পেতেন–
‘My aching head has heard voice saying—The day of freedom is not far off—-Holy,holy is Hindusthan—-Rishis and their beautify is around us,but we behold it not.’অর্থাৎ,শ্রেণী- সংগ্রামের বিরোধী,বলশেভিকদের কাছ থেকে শেখার বিরোধী; ‘our national movement must become a purifying mass movement।’তাঁর প্রভাব থাকলেও, যুবকদের ভাবাবেগ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেননি।”

“সুভাষচন্দ্র বসু,কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয়ে,নিজের মতাদর্শ জনসাধারণের সামনে তুল ধরেন।কংগ্রেসের মধ্যে পরিবর্তন পন্থীদের(Revolutionary group) অন্যতম ছিলেন;বৃটিশ সরকার, ওঁকে ভয় খেত,তাই বেঙ্গল অর্ডিনান্স জারি করে তাঁকে প্রায়ই আটক করে রাখতো। মহারাষ্ট্রের অধিবেশনে তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দেন।”

“পণ্ডিত জওহরলালজিও প্রথম দিকে পরিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন,পূর্ণ স্বাধীনতায় ছিলেন বিশ্বাসী,তবু তাঁদের মধ্যে চিন্তাধারার পার্থক্য ঐ অমৃতসর ও মাদ্রাজ অধিবেশনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।সুভাষচন্দ্র বলেন,ভারত থেকে আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা সারা বিশ্ব ছড়িয়ে পড়বে;ভারতের ‘জাতীয়তাবাদ’,পৃথিবীর অন্যান্য দেশের থেকে ভিন্ন,সংকীর্ণ নয়,অত্যাচারী তো নয়ই,এর ভিত্তি হচ্ছে,’সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’অর্থাৎ’Truth,Goodness and Beauty’.”ভারতের ভিত্তি আধ্যাত্মিকতা,তাকে বাদ দিয়ে,সব কিছু হবে ব্যর্থ।গণরাজ্য বা প্রজাতন্ত্র, ভারতে নতুন নয়,এমন কী সমাজতন্ত্রও ভারতে
বিদ্যমান ছিল;সুতরাং,সারা পৃথিবীর কাছে ভারতের বাণী ছড়িয়ে দিতে হবে।মনে রাখতে হবে,ভারত- পথিক স্বামীজী ছিলেন,তাঁর পথ প্রদর্শক।”

” আবার, পণ্ডিতজির মতে,পৃথিবীর সব দেশই মনে করে,তার নিজস্ব চিন্তাধারা
রয়েছে।ইংল্যান্ড মনে করে,পৃথিবীর বুকে আধুনিক চিন্তাধারার প্রবর্তক তারাই; সুতরাং,আমাদের কোন বিশেষ কিছু নেই বলেই ,তাঁর ধারণা।প্রত্যেক যুবকের মধ্যেই রয়েছে বৈপ্লবিক চিন্তাধারা,সে ধারা,কী সামাজিক,কী অর্থনৈতিক, কী ধর্মীয়,সব ক্ষেত্রেই তা প্রয়োগ করতে হবে।ধর্মীয় গ্রন্থ ,যথা বেদ,কোরান ইত্যাদির সংস্কার দরকার, সময়ের সঙ্গে ঐ সব গ্রন্থেরও
পরিবর্তন প্রয়োজন। উভয়েই বিপ্লবী, একজন,পুরানো হেরিটেজ পন্থী,আর একজন,তার সংস্কার পন্থী,একজন,আবেগপূর্ণ বিপ্লবী,অন্যজন পরিবর্তনে বিশ্বাসী বিপ্লবী,একজন কল্পনাবিলাসী,
অন্যজন বাস্তববাদী।সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বাস করতেন, প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের
মধ্যে ফারাক যথেষ্ট, উভয়েই শ্রমিক- কৃষক দরদী,উভয়েই, তাদের অবস্থার উন্নতি চান,উভয়েই সাম্যের ভিত্তিতে স্বরাজ চান। পররাষ্ট্র -নীতির ক্ষেত্রেও
সুভাষচন্দ্র, নিজের দেশের সুরক্ষা ও উন্নতির মধ্যে তা সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্ত পণ্ডিতজীর মত ছিল ভিন্ন, বৃহত্তর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও
তিনি মাথা গলানোর পক্ষপাতী ছিলেন।প্রথম জন,শৈশব থেকেই আধ্যাত্মিক- তায় বিশ্বাসী,সন্নাসীও হতে চেয়েছিলেন,সেবা-ব্রতই ছিল মুখ্য,পুরো প্রাচ্য সংস্কৃতির ধারক,অন্যজন,পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অভিমুখী,তো পার্থক্য থাকাই স্বাভাবিক, তবে ভগৎসিংজি ও তাঁর সাথীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাদের বিচার কালে,সুভাষজি বিচার সভায় উপস্থিত হয়ে ‘ইনক্লাব ‘ ধ্বনি তুলে তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানান।ইংরেজদের দেওয়া,’টেরোরিষ্ট’ তকমা দেওয়ারও প্রতিবাদ জানান।”

“যাই হোক,ভগৎসিংজি ও তাঁর সাথীদের মৃত্যুদণ্ডে,সবাই দুঃখ প্রকাশ করেছেন, শোক প্রকাশ করেছেন; গান্ধীজি,আরো বলেছেন, ‘The youth should not follow Bhagat Singh’s path,but Periyar eulogies him unconditionally.’না,ভির সাভারকারের কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি,যদিও ভগৎসিংজির কাছে সাভারকারজি ছিলেন খুবই শ্রদ্ধাভাজন।”

“তোমরা তো জেনেছ,জেল কর্তৃপক্ষ, ভগৎসিংজিকে একটা নোটবই দিয়েছিল। তার 273 পাতায় তিনি লিখেছেন, যদি বৃটিশের করা আইন চলে,বৃটিশের তৈরি নীতি অনুসৃত হয়,তবে ‘the supplanting of Europeans by Indian agency will not make for self- government in this country।’ তিনি লিখছেন, ‘if the Government were to come and tell me today,”take Swaraj”,I would
say thank you for the gift,but I will not have that which l cannot acquire by own hand—-।’
মোদ্দা,ভিক্ষা করে যা পাওয়া যায়,তা স্বাধীনতা নয়; স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়।”

“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও আবার ভারতীয়দের কাছে সাহায্য চায়; বশংবদেরা,বৃটিশদের সাহায্য করলেও,গৃহবন্দী সুভাষচন্দ্র বসু,যুদ্ধের সুযোগ গ্রহণ করার জন্য কাবুলে, গাদারপার্টির শহিদ হরিকিষাণের ভাই, ভগৎ রাম তলোয়ারের সাহায্যে ভারতের বাইরে যেতে সক্ষম হন,এবং আজাদ- হীন্দ বাহিনীর নেতৃত্বে বৃটিশ সরকারের ভীত নড়িয়ে দেন,কিন্ত, তিনি আর ফিরে এলেন না,তাই তো আমরা আজও বলি,হে বীর,তোমার আসন শূন্য আজি,পূর্ণ কর,পূর্ণ কর।আজাদ- হীন্দ বাহিনীর অগ্রসরকে বশংবদেরা দেশবাসীর কাছে চাপা দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে,quit- India’র আন্দোলনের নাটক করেছে।আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্তর্ঘাতক ঢুকিয়ে স্বাধীনতার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে; দেশের জনগণ তো প্রচারে বিমোহিত; তাই দেখ, সাদা চামড়ার পরিবর্তে আজ ব্রাউন সাহেবরা দেশের শাসন কর্তা; আজাদ হীন্দ বাহিনীর কয়েকশোকে ব্যারাকপুর মিলিটারি কাম্পে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়;দিল্লির লালকেল্লায় সেনাবাহিনীর উচ্চ অফিসারদের বিচারের প্রহসন হয়ছে;নৌ- বিদ্রোহ দেখা দিল,ইংরেজদের ভারতীয় সৈন্য বাহিনী সত্য উপলব্ধি করে এবার হাতিয়ার উল্টো দিকে ধরতে তৎপর। বৃটিশ সরকার তা বুঝতে পেরে, ভেদ-নীতির চাল চেলে, ঐ বশংবদদের হাতে দেশকে টুকরো করে স্বাধীনতার খেলা সাঙ্গ করেছে।লক্ষ, লক্ষ মানুষের অপমৃত্যুর সাথে সাথে সত্য মারা গেল; সহায়-সম্বলহীন, উদ্বাস্ত মানুষ গুলো বাঁচার তাগিদে, বিবেককে টুঁটি চেপে অর্ধমৃত অবস্থায় আনতে বাধ্য হয়েছে। কিন্ত, হায়! সেই বৃটিশের পুলিশি আইন বহাল,সেই বিনা- বিচারে ফাটকে আটক,সেই অত্যাচার ,তাই বিবেক আজ সংজ্ঞাহীন; দেখছো তো,আমি খুঁজে চলেছি পথে পথে সেই মহান নেতৃত্বকে,যিনি করতে সক্ষম হবেন হাজার শহিদের স্বপ্নপূরণ।

(শেষ)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।