ক্যাফে অণুগল্পে সুব্রত সরকার
আয় খেলি
সাউথ থেকে নর্থে যাচ্ছে সদ্য ষাট পেরোনো মনোজ। সাউথ মানে দক্ষিণের এক প্রান্ত গড়িয়া থেকে উত্তরের সাবেকি বনেদি শোভাবাজার- শ্যামবাজারের কলকাতায়।
বন্ধু অতীন নতুন একটা নাটক লিখেছে, তাই শুনতেই যাওয়া। ভালো লাগলে আগামী নতুন নাটক এটাই করবে ওর দলের প্রযোজনায়।
অতীন অনেকদিন পর কলম ধরল। মাঝখানে নানান ঝড় ঝন্ঝায় বিপর্যস্ত ছিল। মন দিয়ে কোনও লেখা লিখতে পারে নি। ওর লেখা নাটক মনোজদের দলে আগেও একটা হয়েছে।
অতীনের কথা মত গড়িয়ার কবি নজরুল থেকে পাতাল রেলে করে শোভাবাজারে নেমে মুচিবাজারের অটোতে উঠে বসল। অটোয় যেতে যেতে উত্তর কলকাতার এই রাস্তা ঘাট, জনপদ, পাড়াগুলো দেখতে দেখতে যাচ্ছে, আর নিজের অজান্তেই ডুব সাঁতারে ফেলে আসা সময়ের স্মৃতি কাতরতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এই অঞ্চলের অন্য অনেক গল্প ইতিহাসের সাথে সাথে একটা রংবাজি মস্তানির গল্পও একসময় খুব ছিল। গৌরিবাড়ির হেমেন মন্ডল, হাত কাটা দিলীপ, কমল হাজরা, ফাঁপা স্বপন, ফাটা কেষ্ট এমন আরও কত নাম তখন লোকমুখে ঘুরত। ওদের নিয়ে কাগজে খবর হত। এই সব মস্তানদের কথা কাহিনী নিয়ে তখন পিনাকীদা ধারাবাহিক মুচমুচে স্টোরি লিখত। গোগ্রাসে কি উত্তেজনায় সেগুলো পড়া হোত। সেই রংবাজ- মস্তানদের অঞ্চল দিয়ে আজ যেতে যেতে আরও একটা ভাবনাও ভেসে এল মগজে। মননে।
মুচিবাজার স্টপেজে নেমে অতীন যেভাবে হেঁটে এগিয়ে যেতে বলেছিল, ঠিক সেভাবেই পায়ে হেঁটে সামান্য একটু যাওয়ার পরই পেয়ে গেল চিরন্তন অ্যাপার্টমেন্ট। লিফ্ট নেই। পায়ে হেঁটে তিনতলায় উঠতে হল। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে অতীন বলল, “অসুবিধা হয় নি তো। আয়। আয়। জুতো বাইরে রাখিস না। ঘরে রাখ।”
ছোট্ট দু’কামরার ফ্ল্যাট। অতীন ও বিদিশা থাকে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। দুজনে থাকতে কোনও অসুবিধা নেই।
জলের গ্লাস হাতে নিয়ে বিদিশা এসে বলল, “আপনাদের আগের নাটকটা আমার দেখা হয় নি। নেক্সট শো এর মধ্যে হলে বলবেন তো।”
“কথা চলছে। হল পাই নি। পেলেই জানাব তোমাকে। যেও।”
“চা না কফি?”
” দেখো আমাকে অপশন দিলে আমি সব সময় বলি, কফি।”
“বেশ। তাই করে আনছি। আপনারা গল্প করুন।”
বিদিশা চলে গেল। অতীন নাটকের খাতাটা নিয়ে বসল। সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে বলল, “আজ একটু গলা ভেজাবি নাকি? বাড়িতে আছে অল্প।”
“আমার ব্র্যান্ড তো জানিস। রাম টাম খাই না।”
“হুইস্কিই আছে। টিচার।”
“তাহলে তো আমি ভালো স্টুডেন্ট।”
বিদিশা বেশ গাঢ় দুকাপ কফি ও কুকিজ রেখে চলে গেল। বলল, “আপনারা শুরু করুন আমারটাও নিয়ে আসছি।”
কফিতে চুমুক দিয়ে বেশ মেজাজ এসে গেল মনোজের। মেজাজি ঢঙে বলল, “জানিস আজ আসার সময় না তোদের এই অঞ্চলের সেই বিখ্যাত বিখ্যাত রংবাজ মস্তানগুলোর কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। উফ্ এলাকার ত্রাস ছিল বল।”
“সত্যি। সে একটা সময় ছিল বটে। ওরা হিরোর মত রাজ করত।”
“হিরোর মত কিরে! হিরোই তো ভাবতাম আমরা।”
“ওরা ছিল পাড়ার হিরো। এলাকার ত্রাস।”
“তাতেই কত টি আর পি হাই ছিল বল। কত কাগজে, ম্যাগাজিনে কভার স্টোরি হয়েছে। পিনাকীদা তো ওদের গল্প লিখেই ফেমাস হয়ে গিয়েছিল।”
“রংবাজি – মস্তানীটা কিন্তু পাল্টায় নি। যুগে যুগে রয়ে গেল।”
“ঠিক বলেছিস।”
“শুধু নাম গুলো পাল্টেছে। পদ্ধতিগুলো পাল্টেছে। বরং খ্যাতি জুটেছে আরও অনেক। টি আর পি আরও আরও আরও হাই হয়েছে। ”
মনোজ কফি শেষ করে বলল,”তোর ভাবনার মস্তানগুলোর নাম বল তো শুনি…”
“কেন?”
“দেখি আমার সাথে মেলে কিনা!..”
“মিলবে!.”
“কেন বলছিস?”
“আরে তাহলে আর কিসের এতদিনের বন্ধুত্ব! মিলতেই হবে।”
“তাই!.”
“দেখবি?”
“যেমন…
“আয় আমরা শূন্য স্থান পূরণের মত করে একটু খেলি। আমি একটা নাম বলব, তুই একটা বলবি..”
“বেশ… ”
“তুই তাহলে প্রথম বল-”
“হামাস”।
“বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। “।
“পুতিন”।
“জেলেনস্কি”।
“কিম জং উন”
” শী জিন পিং”।
আর সবচেয়ে বড় মস্তান কে বলত…
বিদিশা এসে দাঁড়িয়েছে। অবাক হয়ে শুনছে দু’বন্ধুর এই শূন্যস্থান পূরণের খেলাটা।
এবার দু’বন্ধুই একসাথে বলল, “বাইডেন।”
হা হা হা… বিদিশার হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল ঘরে।
সমাপ্ত