সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ১৬)

শহরতলির ইতিকথা

পাড়াতে  রাজীবের স্কুলের এক সহপাঠী, ঐ কলেজে ভর্তি হয়েছে,তবে রাতের  বিভাগে। দিনের বেলা,নম্বর দেখে,বেছে,বেছে একশোজনকে নিয়ে ইনটারমিডিয়েট  (কমার্স) খোলা হয়েছ। সহপাঠী,গজকৃষ্ঞের মামার  বাড়ি, নৈহাটি জুটমিলের কাছে, কাঁঠালতলায়;সে মামার  বাড়ি থেকেই  পড়বে।
রাজীব,সেই কাকভোড়ে ওঠে,দূরের খামার-পাড়া অঞ্চলের  এক বাড়িতে ট্যুইশান পড়িয়ে,বাড়ি এসে চান-খাওয়া সেড়ে হন্তদন্ত হয়ে, অঞ্চলের  স্টেশনে যায়। অঞ্চলের  স্টেশন  দিয়ে সকাল বেলা, হাওড়া যাবার   তিনটে ট্রেন ও ফেরারও ঐ তিনটে ট্রেন,সেই কু–উ-ঝিক ঝিক, অর্থাৎ ষ্টীম-ইঞ্জিন,সিঙ্গল লাইন।সকাল ৯’টার ট্রেনের  সঙ্গে ব্যাণ্ডেল  স্টেশন  থেকে নৈহাটি যাবার  ট্রেনের কানেকশন আছে,তাই এটাই  ওর ট্রেন।ঐ ট্রেনে যায় ব্যাণ্ডেল স্টেশনে, চার নং প্লাটফর্ম-এ ট্রেন থামে ;একটু হেঁটে সামনের দিকে নৈহাটি যাবার   ট্রেনের  প্লাটফর্ম; হাওড়া-কাটোয়ার ট্রেনের প্লাটফর্ম, চার নং থেকে সোজা হেঁটে একটু দূরেই ব্যাণ্ডেল-নৈহাটির  ই-এমউ কোচ অপেক্ষায় থাকে;ঐখান থেকেও দুটো ট্রেন আসা-যাওয়া করে, অবশ্য মাত্র তো নির্দিষ্ট  তিনটে স্টেশন হলেও অলিখিত চারটে স্টেশন  ;নৈহাটি স্টেশনে ঢোকার  মুখে বা ফেরার সময় বেরোবার মুখে খেজুরতলায় বেশ কিছুক্ষণ  দাঁড়াবেই;তাই নাম দেওয়া হয়েছে খেজুরতলা হল্ট।গঙ্গার  উপরে রয়েছে জুবিলী ব্রীজ,নৈহাটির  দিকে গরিফাও ব্যাণ্ডেলের দিকে হুগলীঘাট স্টেশন। সময় অনেকটাই দেওয়া আছে, প্রধানতঃ মালগাড়ি চলে এ   লাইন  দিয়ে,কয়েকটা মেল ট্রেনও এ পথ দিয়ে শিয়ালদহ  থেকে ভায়া ব্যাণ্ডেল  হয়ে মেইন-লাইনে যাওয়া-আসা করে।
 ঐ সময়কালে,হাওড়া থেকে ব্যাণ্ডেল  ইলেক্টট্রিফিকেশন(অর্থাৎ ইএমউ কোচ চালু) হয়েছে,তার সঙ্গে ব্যাণ্ডেল-নৈহাটির  লাইনেও চালু হয়েছে দু’টো ইএমউ কোচ।
প্রথম  দিন কলেজে হাফ প্যান্ট  পরে গেলেও তার পরের দিন থেকে পাজামাও হাওয়াই শার্ট হয়েছে রাজীবের পরনের পোষাক,আর পায়ে উঠেছে নৈহাটির  আড়াই টাকার  চটি,এতেই  খুশি,সবটাই  তার নিজস্ব  উপার্জনের  অর্থ থেকে হয়েছে।প্রথম বর্ষের ছাত্র, কো-এডুকেশন কলেজ, একটু সমঝে  তো চলতেই  হয়।আর্টস বিভাগের  দুটো সেকসন।আর্টসের ছাত্র   ও কমার্সের ছাত্রদের  মধ্যে বেশ কয়েকটা বিষয় কমন এবং ঐচ্ছিক হওয়ায় ওদের মধ্যে ক্লাস রুম মাঝে মধ্যেই  পরিবর্তন করতে হয়। ফোর সাবজেক্ট,  রাজীব নিয়েছে লজিক,নং উঠার সম্ভাবনা বেশি;অনেকে ইতিহাস  নিয়েছে।প্রিন্সিপাল  মহাশয়,লজিকের ক্লাস নেন;বয়স্ক মানুষ,ঢাকাইয়া উচ্চারণটা রয়েই গেছে।স্যার,সর্বোপল্লী রাধাকৃষ্ঞাণ মশাই ‘র প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনার কালে  প্রথম ব্যাচের ছাত্র ;আবার,ভারতের  নামকরা  দার্শনিকদের মধ্যে একজন,গাম্ভীর্যের মধ্যেও রয়ে গেছে এক শিশুসুলভ, আনন্দময়,দুষ্টুমি ভরা প্রাণ;ক্লাস  চলার সময় কখন যে সময়ের ঘণ্টা থামবার ঘণ্টা শোনায়,বুঝতে পারা যায় না। স্টেশনের ওপারে নৈহাটি মিউনিসিপ্যালিটির পাশ.দিয়ে যাওয়াষ মিত্তির  গলিতে থাকতেন;পাশেই  শ্যামল মিত্র মশাইরা থাকে,শ্যামলবাবুর ভাই  সলিল মিত্র,এ কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। শ্যামলবাবু,তখন গানের জগতে সাড়া ফেলে দিলেও,কলেজের সোস্যাল কিন্ত  তাঁকে ডাকা হবে না।পরে রাজীব শুনে বুঝে ছিল,কতটা সত্য,’গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’।
ফার্স্ট-ইয়ারের  ক্লাস  শুরু হয়েছে।আর্টসের  দু’টো সেকসনও কমার্সের একটা সেকসন–সব মিলিয়ে আই-এ ক্লাসের  মোট পাঁচ শো নতুন ছাত্র । ক্লাস-রুমের ঘরগুলোও বড় বড় হলঘরের মত। দরজা দিয়ে ঢুকে  বিরাট কাঠের পাটাতন,তার উপর কাঠের টেবিল ও চেয়ার। ক্লাসের  অধ্যাপক মশাইদের সঙ্গে আসতে  আসতে পরিচয় হচ্ছে;সবচেয়ে মজার,এক একটা ক্লাসের  পর হয় রুমের পরিবর্তন, কারন বিষয় অনুসারে ছাত্র সংখ্যা বিভিন্ন।  আর্টস-কমার্সের ছাত্রদের বাংলা ও ইংরাজি ছাড়াও বেশ কয়েকটা বিষয় এক,তাই  ঐ সব ঐচ্ছিক বিষয়ের ক্লাস  এক সংঙ্গে হয়,ছাত্র সংখ্যাও বিভিন্ন  হয়। কলেজে,প্রতি বিষয়ের ক্লাসের ও প্রতি অধ্যাপকদের    রোলকলের জন্য নির্দিষ্ট  খাতা,রাজীবের কাছে এ এক নতুন জগৎ।অধ্যাপক মশাইদের অনেকেই  পাটাতনের উপর এধার-ওধার, পায়চারি করতে করতে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন,এ এক অন্যধারা–বিশেষ করে ,বাংলা-সাহিত্যের  কবিতার  ক্লাস ও ইংরাজী সাহিত্যে,ওয়ারেন হেষ্টীং’র বিচারকালে বার্কের স্পীচের অনবদ্য উপস্থাপনকালে,ছাত্ররা  অন্যজগতে বিচরণ করে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *