গল্পে মমতা ভৌমিক

মুখোশে

বাসস্টপটা আগের মতই আছে। সিটটার একটা পাশ ভাঙ্গা। তলায় একটা তেলচিটে কম্বল গুটিয়ে ঢোকানো। মধ্যবিত্তের একটু ঘেন্নাপিত্তি স্বাভাবিক, কিন্তু ওর খুব একটা আসে না। পাশেই ট্রাম কোম্পানীর বিপজ্জনক লেবেল লাগানো দেওয়ালের সামনে অগুন্তি মানুষের চাটাই ও প্লাস্টিকের ছাউনির অস্থায়ী অথচ স্থায়ী আবাস। ছ’বছরের কোলে চেপে ছ’মাস ঘুরে বেড়াচ্ছে, কয়েকটা সমবয়সী আদুল গায়ে খেলছে, মারপিট কান্না, আগের মতই। দিনে একবার এইসব বাচ্চাদের ধরে তাদের মায়েরা কর্পোরেশনের লিক করা জলে ভালো করে ক্ষার সাবানে ডলে। একটু উঠতি বয়সের ঠোঁটে বিড়ি, হিরো চুলের কাটিং, জিন্সের পকেটে কাঁচা পয়সা। অদূরে দাঁড়ানো মেয়েটির ময়লা পোষাকের আড়ালে ফুটে ওঠা যৌবন, দুচোখে স্বপ্নের ইশারা।

ফ্যান ভাত ফুটছে, আর একটা কড়ায় মুরগির ছাঁট, হলুদ লঙ্কার আড়ালে নখযুক্ত মুরগির পা। আশেপাশের নামী অনামী হোটেলগুলি থেকে সস্তায় পাওয়া যায়। এ সব পরিচিত দৃশ্য জয়ার। এখান থেকেই বাড়ি ফেরার বাস ধরেছে বহু বছর।

আজ গাড়িটা জ্যামে এখানেই আঁটকেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া ওষুধের কারখানার পাঁচিলটা একই রকম আছে। শুধু বিল্ডিংটা ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। শহরের এ জায়গাটি তো আর কারখানার জন্য উপযুক্ত নয়, এখানে অত্যাধুনিক মল তৈরী হবে।

একধারে গাড়ির বিভিন্ন পার্টসের দোকানের সারি। থেমে থাকা গাড়ির লাইট ইত্যাদি টুক করে খুলে দোকানে বেচে দেবার কাজে অনেক শিশুই হাত পাকিয়ে ফেলে বড় হতে হতে। মল হলে এইসব বাসিন্দারা কোথায় যাবে, এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গাড়িটা একটু একটু এগোয়।

হঠাৎই একটা চেনামুখ এগিয়ে আসে জানলায়। “কেমন আছেন দিদি, এদিকে আর আসেন না একেবারেই?”

“ছেলে মেয়ের খবর কি আব্দুল?”

“ছেলে রেলে চাকরি পেয়ে গেছে, মেয়েটার বিয়ে সামনে। আপনি যদি আপনার ছেলে মেয়ের জামা, বই খাতা বছর বছর না দিতেন , আমি কি পারতাম!”

“ও কিছু নয়। সামান্যই । ভালো থেকো আব্দুল। ফোন কোরো মাঝে মাঝে। নম্বর একই আছে।”

ট্যাবলেট ডিপার্টমেন্টের পুরোনো ওয়ার্কার আব্দুলের চাকরিটা ওর জন্যই গেছিল। গুণমান ঠিক না রাখায় পুরো ব্যাচ ফেলে দিতে হয়েছিল। নিজের ঘাড় বাঁচাতে সেদিন জয়া…

গাড়ি এখন ক্রিশ্চান সেমেটরির পাশে। পুরোনো ফলকটা চোখে পড়ে – দাঁড়াও পথিক-বর, জন্ম যদি বঙ্গে তব…

জয়া এখন গাড়িটা টুক করে বাঁদিকে ঘোরার অপেক্ষায়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।