সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ২০)

শহরতলির ইতিকথা

সজীবের ,আই এ পরীক্ষা চলছে; কারখানা থেকে দশ দিনের ছুটি নিয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের  নিয়ম অনুসারে, সব পরীক্ষাই দিনের বেলায় হয়। পরীক্ষার  সময় রাজীবদের ক্লাস বন্ধ  আছে।  আগামী বছর,এই  সময়ই  রাজীবদেরও পরীক্ষা চলবে;রাজীব-রমিত ভাবে,এই তো সেদিন  ওরা কলেজে ভর্তি হলো—জীবন-যানের যাত্রী যেন  ওরা,আর দিনগুলো দ্রুত অপসৃয়মান মাঠ,ঘাট,গাছপালার মতন পলকে উদাও হচ্ছে, না, থেমে থাকার  অবকাশ  নেই—-।
পরীক্ষা  শেষ; সজীব, আবার  কারখানার কাজে যোগ দিয়েছে ;দশ দিনের ছুটি,মানে,নো-ওয়ার্ক,নো -পে।
এবার, বেশি করে উৎপাদন  বৃদ্ধি করে,ঐ ক্ষতি পূরণে সে বদ্ধ পরিকর। ওদের কারখানায় উৎপাদন ভিত্তিক মজুরি  ;  সুতরাং, ঐ ক্ষতি পূরণ হতে বেশি দেরী হবে না। পড়াশোনাও তো আর নেই, কাজের শেষে, সন্ধ্যেবলায় সে খুব  মজায় থাকে,যৌবনের আঁকিবুঁকি তার শারীরিক ভাষায় ফুটে উঠছে।
 হাজর মশাই’র  সঙ্গে কাজ    করে, কারখানার  সহকর্মীর এক বিবাহযোগ্যা ভাগনি আছে;সে অনেক দিন ধরেই, সজীবের সঙ্গে ভাগনির বিয়ের প্রস্তাব  দিয়ে আসছে;সজীবের  পরীক্ষার  জন্য  হাজরাও ইতস্তত  করছিল।এবার  বাড়িতে,এ প্রস্তাবের কথা পাড়তেই,রাজীব  আপত্তি জানায়; ঘর নেই, টিনের চালের খোলা বারান্দা, পাঁচিলের  দেওয়ালের  উপর  বাঁশ-টালি দিয়ে রয়েছে রান্নাঘর,আর উঠোন পেরিয়ে রয়েছে খাটা পায়খানা,রয়েছে  রাস্তার  দিকে দেওয়াল সংলগ্ন স্নানঘর,মাথায় টিনের ছাউনি ।আগে,নিজেরা  একটু গুছিয়ে নেওয়া, ঘর করা,তারপরই তো উচিত  সংসারের   জনসংখ্যা বৃদ্ধি। না,হাজরা-দম্পতির সে বোধোদয় নেই ;নিজেদের এখনও  বুকের দুধ খাওয়া শিশু রয়েছে,এরই মধ্যে আবার  জনসংখ্যা বৃদ্ধির  ব্যবস্থা, কখনোই  সমর্থনযোগ্য  নয়;আর তাছাড়া সজীবের বয়স তো সবে কুড়ি পেরিয়েছে।সজীবের  দিক থেকে  কোনও জোরালো প্রতিবাদ  না থাকায়,মেয়ে-পক্ষের দল চলে এলো পাত্রের বাড়ি। টিনের চালের তলায়, খোলা বারান্দায় চৌকিতে বসে,  সব কথাবার্তা হচ্ছে। বারান্দার  নীচে একটা পেয়ারা গাছ,আর তার পরই টালিতে ছাওয়া রান্নাঘর।  ঐ ঘরের  দরজার
চৌকাঠের  উপর দাঁড়িয়ে  হৈমবতী বলছে,
  “দেখছেন  তো, ঘরের খুবই  অভাব,মেয়ে এসে থাকবে কোথায়!”
হাজরার সহকর্মী উত্তরে বলে,
” মেয়ে,ঐ পেয়ারা গাছের তলায় থাকবে।” ছেলের শারীরিক  গঠন দেখে,মেয়ে পক্ষের পছন্দ  হয়েছে;তারা মেয়ে দেখতে যাবার  আহ্বান  জানিয়ে গেল। ঠিক হল,পরের সপ্তাহে,একদিন  মেয়ে দেখতে যাওয়া হবে।
   রাজীবের  কোনো প্রতিবাদই গ্রাহ্য হয়নি; সজীবের মৌনতাই, হাজরামশাইকে  এ সম্বন্ধে উৎসাহী করেছে।হাজরামশাই, রাজীব  ও  রজতের পরের বোন গেল মেয়ে দেখতে,আর বাকিগুলো তো এখন নাক খোঁটার,নাক দিয়ে পোঁটা পড়ার পর্যায়ে রহেছে। হাজরামশাই-হৈমবতী একটু উৎসাহী,কারন,যৌতুক ভালোই দেবে; ঐ টাকায়,বারান্দার  পরিবর্তন  করা হবে,ঐখানে একটা ঘর হবে,সিঁড়ি হবে ও বারান্দার  উপর একটা ঘর হবে।
হাতে তো টাকা নেই। সজীব,  কারখানার  কো-ওপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়েছে ,হাজরামশাই ও প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিয়েছে;বারান্দার  পাকা দেওয়াল তুলে হয়েছে ঘর,সংলগ্ন  বাইরের রোয়াকের  উপর গোল পিলার তুলে ছাদের  উপর একটা ঘর ও ঘর সংলগ্ন  ছোট খোলা বারান্দা হয়েছে।রাজীবকে,সজীবের  ভাবি শ্বশুর মশাই ‘র কাছ থেকে যৌতুকের টাকা আনতে পাঠিয়েছে; রাজীব  গররাজী হলেও,সংসারের  কী বেহাল অবস্থা দেখে, লজ্জার  মাথা খেয়ে, টাকা নিয়ে এসে হাজরামশাই ‘র হাতে দিয়েছে।
ঘর হয়েছে,এবার  ঘরে বিদ্যুতের-আলো দরকার;  না,আর তো টাকা নেই। হাজরা-হৈমবতীর মধ্যে নিত্যদিন চলছে টানাপোড়েন; হাজরামশাই’র দেশের জমি- বাড়ির  অংশ বিক্রি করে টাকা আনতে হবে। হাজরামশাই ‘র দ্বিধা আছে,ভাইরা যদি কিছু না দেয়,কারন,দেশের সংসারের  প্রতি তো তিনি কোনও দায়-দায়িত্ব পালন করেননি; রাজীব, তার বাবার  মা’র মুখে সে কথা শুনেছে;তাই তো,বাবার  দেশের বাড়িতে পুজোর সময় গেলে,ওদের হতে হতো  এত হেনস্থা,ওদের করা হোত দূর- ছাই।
   পাড়ার  সব বাড়িতে বৈদ্যুতিক  আলো আছে,সুতরাং,আলো না হলে বিয়ে হবে না;বাড়িতে চিল-টীৎকারে,কাক-পক্ষীও আর বাড়ির কাছে বসে না।দুরুদুরু বুকে,রাজীব কে নিয়ে হাজরামশাই   দেশের বাড়ি গিয়ে, নিজের অংশের  দাবী পেশ করলো। ভাই’রা যথারীতি  স্থায়ী-সম্পত্তির ভাগ বন্টন করে, এর ভাগ,ওর ভাগ,ঠাকুরের দেবোত্তর  অংশ  রেখে,হাজরামশাই ‘র  ভাগের মূল্য মাত্র ছ’শো টাকা নির্ধারণ  করেছে;হাজরা তো সম্পত্তির  পরিমাণই জানে না;রাজীব,গ্রামের মাতব্বরদের ডাকার কথা বলেছিল, না,হাজরার ভাই’রা,নিজেদের  আর্থিক অবস্থার  কথা অন্যকে জানতে দিতে রাজি নয়; অতএব,ওর কথা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ। আবার দলিল লেখার  সময়ও তা, ছ’শোর পরিবর্তে ছ’হাজার টাকা লেখা হলো,কারন,মুহুরি/দলিল লেখক, যাতে আর্থিক  অবস্থার কথা জানতে না পারে। ছ’শো  টাকায় সব কিছু বিক্রি করে,দেশের সঙ্গে সব সম্পর্ক  চুকিয়ে শহরতলির  বাড়িতে এসেছে;ঐ টাকায় বাড়িতে বৈদ্যুতিক  আলোর সংস্থান হলো। বিয়ের আর কিছুদিন  বাকি আছে,হাতে টাকা পেয়েছে হাজরা-দম্পত্তি,সেটা না ফুরোনো পর্যন্ত ,থামবে না, একটা ঘোরের মধ্যে আছে; বিয়ে উপলক্ষ্যে , সব বোনকে আনবার জন্য রাজীবকে,তাদের   বাড়ি পাঠিয়েছে; রাজীবের কাছে তারা তো  প্রায় অচেনাই, তারা  ওর কাছে অপাঙক্তেয়, তবু গেছে, এবং একলাই ফিরেছে ।বংশের বড় হলেও হাজরামশাইকে  ওরা
কোনোদিনই  সম্মানের চোখে দেখেছে বলে রাজীবের মনে হয়নি। দেশের তরফ থেকে ,এক কেঁটেলিবাজ ভাই  এসেছে,না,খুড়ো হিসেবে নয়,উপস্থিত  আত্মীয়দের  কাছে দাদা-বৌদির যাতে সম্মানহানি হয়,সে প্রচেষ্টায় ব্যস্ত  থেকেছে সর্বক্ষণ।
 (চলবে)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *