করেছে
নিভাননীর মামাতো দাদা, তো পুত্রকে অঞ্চল ছাড়া করেছে; কিন্ত করলে কী হবে,যে ক্ষতি হবার তা তো হয়েই গেছে, তা আর পূরণ হবে না, রমার এ বছরটাও গেল; শুধুই কী পরীক্ষার বছর! যে ক্ষত শারীরিক, মানসিক ভাবে ঘটে গেল তা কী আর কখনো পূর্ণ হবে!
দেশ-বিভাগের জন্য, এ অঞ্চলে উদ্বাস্তুর ঢল নেমেছে। পাড়ার কুন্ডু মশাই ‘র বিশাল নারকেল-বাগানটা, সরকার অধিগ্রহণ করে কলোনী
করেছে, এখানে ঠাঁই পেয়েছে প্রায় দু’হাজার পরিবার। সব নারকেল গাছ, আম গাছ কেটে, গুড়িগুলো লরী করে নাম না জানা কাঠের ব্যবসায়ীর গোডাউনে স্থান পেয়েছে; সরকারি আমিন এসে, প্রত্যেক উদ্বাস্তুর বসতবাড়ির জন্য জমি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে; গড়ে উঠেছে বাঁশও টিন দিয়ে বসত-ঘর, দরমার উপর মাটি লেপা দিয়ে হয়েছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর একত্রে বাস, ভাষাএক, উচ্চারণ বিভিন্ন, জীবন- চর্চার মধ্যেও রয়েছে ভেদ,তবু পাশাপাশি থাকা, নাম কলোনী —সব নদী যেমন বিভিন্ন জলধারা নিয়ে সাগরে নিজের অস্তিত্ব হারায়–কলোনী তাই–শুধুই উদ্বাস্তুদের বাসভূমি, সব-হারাদের আশ্রয়স্থল—বেঁচে থাকার, টিকে থাকার, লড়াকু মানুষের আবাসস্থল, না,এখানে সখ- আহ্লাদের স্থান নেই, শুধুই জীবন- সংগ্রাম। সরকারী কলোনী লাগোয়া অঞ্চলের মালিকেরা অধিগ্রহণের ভয়ে, নিজেদের জমি বিক্রি করে বসতি বসিয়েছে; এভাবে, গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কলোনী। অঞ্চলের জন- বিন্যাসের পরিবর্তণ চোখে পড়ার মত; উদ্বাস্তু-জনদের মধ্যে একটা চাপা ঈর্ষা কাজ করছে; তা হিংসায় রূপান্তরিত হয়ে স্থানীয়-জনদের প্রতি মাঝে মাঝে আক্রোশে ফেটে পড়ছে।শান্তির বাতাবরন এ অঞ্চল থেকে প্রায়ই বিঘ্নিত হয়ে চলেছে।
কলোনীর বাড়িতে বাড়িতে রয়েছে কুল গাছ,টোপা,টোপা কুল;স্কুলের ছেলেদের কাছে তা আকর্ষনীয়;না ,হাত দেবার উপায় নেই। স্থানীয় মানুষজনের বাগানে, আমগাছের কুশি ধরতেই, তার ওপর চলে কলোনির ছেলেদের অত্যাচার। একদিন, বেলা দশটা নাগাদ পাড়ার ছেলেরা,পাড়ার তে-মাথার মোড়ের ঘাসের উপর বসে গুলতানি করছে; ছুটির দিন,সবাই গল্প ও হাসিঠাট্টায় মশগুল। পাড়ার সজ্জন, মুখুজ্জে কাকার কাঁচামেটে আম গাছটায় চড়াও হয়েছে কিছু কলোনির ছেলে; আওয়াজে,বাড়ির মধ্যে থেকেই মুখুজ্জে কাকা চীৎকার করছেন, “কে রে, কে আম গাছে উঠেছে; কুশি আম, এখনো কিছুই হয়নি” তা শুনে ছেলেগুলো, ধপাধপ লাফ মেরে পালালো। রাস্তা দিয়ে কয়েক জন কলোনির লোক যেতে যেতে বলছে, “গাছের এঁটো ফল,পোলা- পানেরা তো খাইবোই;এহেনে,চীৎকার করনের কি আছে!” হায় রে!কলোনির কুল গাছে হাত দিলে, ‘এক্কেবারে হাত কাইটা ফেলুম’। কী অদ্ভুত যুক্তি!কী ভয়ংকর ঈর্ষা! মুসলমানদের অত্যাচারে, সবাই সর্বহারা; এখানকার অধিবাসীরাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, আর তাদের প্রতিই এই ব্যবহার! এ তো—-।
নিকটবর্তী অঞ্চলের চাষী-চাষীবৌরা, তাদের জমির ফসল, বাজারে বিক্রি করতে এলে, দলবদ্ধভাবে তাদের বাধাদান, নিজেরা সিন্ডিকেট করে,তাদের ফসল কম দামে কিনে নেওয়া চলে। বাধ্য হয়ে চাষিরা, অন্য বাজার অভিমুখী হয়েছে; নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্বে গজিয়ে ওঠে বিভিন্ন সিন্ডিকেট, শুরু হয় পারস্পরিক বিবাদ; এহেন অবস্থায় অঞ্চলের শান্তি-সূর্যের দেখা মেলা ভার।
রমারা,কোলকাতা থেকে ফিরে এসেছে; ওকে দেখতে, ওর মামাতো বোন, অর্থাৎ বিরূপাক্ষের বোন, শৈল এসেছে; ওরা বয়সের দিক থেকে প্রায় সমসাময়িক, সুতরাং, মিশে যেতে দেরী হয়নি, একে অপরের সুখ-দুঃখের ভাগী হতেও সময় লাগেনি। শৈলদের বাড়িতে ভাড়া এসেছেন, স্থানীয় স্কুলের একজন শিক্ষক। খুবই সম্ভ্রান্ত পরিবার; ওপার বাংলা থেকে, এপার বাংলায়, এসে আশ্রয় নিয়েছেন; ঢাকার বার-কাউন্সিলের প্রতিথযশা উকিল ছিলেন, এ পারে এসে স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি করছেন। তাঁর সুদর্শন ছেলেও স্থানীয় কারখানায় ভালো পোস্টেই চাকরি করছে। তার প্রতি শৈল যে আকৃষ্ট হয়েছে, তা রমা-শৈল’র কৌতুক জনিত কথাবার্তায় মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার মত কানে ভেসে আসে। মাস্টার মশাইরা জাতে কী বলতে না পারলেও, পদবী যখন সেনগুপ্ত,তখন কায়স্থ যে নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং, কুলীণ কায়স্থের সংগে সম্পর্ক স্থাপনে যে বাধা আসবে,তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না; আবার দু’ বঙ্গের মধ্যে রেষারেষির ভাবটাও কম নয়। এ দেশেতে ভেদা-ভেদটা বড়ই প্রখর, তাই তো দেশটা আর ‘এক জাতি, এক প্রাণ ‘ হলো না।
শৈলরা দু’বোনও তিন ভাই। বিরূপাক্ষ বড়, এখন সে তো দেশ ছাড়া; মেজ দাদা, শিক্ষিত, মার্জিত, সরকারী আমলার চাকরী করে। অন্যজন, শৈল’র চেয়ে দু’বছরের ছোট, আর বোনটা সবার ছোট; সে এখন, স্থানীয় গার্লস স্কুলের সেভেন ক্লাসের ছাত্রী, অর্থাৎ তখনও পর্যন্ত ‘গোপন কথাটি, রবে না গোপনে’ বলার পর্যায়ে আসেনি।
মেজদার সংগে রমা- নিভাননী দেবীর সম্পর্ক কেমন জানা না গেলেও, এটা সবার জানা, কোনদিনই ঐ মেজকে রমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখা যায়নি। নিজের কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতো;ভাইবোনেদের প্রতি, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল ছিল। হঠাৎই টি -বি রোগে আক্রান্ত হয়েছে, আর টি-বি-রোগকে, রাজরোগ বলে মনে করা হতো; ঐ মারন রোগের ভালো অষুধ তখনও বাজারে আসেনি। অল্পদিনের মধ্যেই তাজা যুবক, মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লো, আর শৈলদের পরিবারে নেমে এল চরম অনিশ্চয়তা; শৈল’র বাবা, অর্থাৎ নিভাননীদেবীর মামাতো দাদার মাথার গণ্ডগোল দেখা দিল।
চলবে