সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ১৮)

সাদা মিহি বালি

তৃতীয় অধ্যায় – তৃতীয় পর্ব 

ঘোষালদের দু’তরফের প্রাসাদের মাঝে মাঠ ও আদি ব্যবসার গোলা, সব, সব স্বাধীন- সরকার অধিগ্রহণ করেছে। নিজেদের অংশে পাওয়া বাকি জমির কিছুটা, রাঘববাবু স্বেচ্ছায় ডিএম’র কাছে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের জন্য দান করেছেন। সে সব জায়গায় এখন কলোনি গড়ে উঠেছে; কলোনি বলা হল এইজন্য,
যে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে আশ্রয় পেয়েছে,তাদের আচার- আচরন বিভিন্ন, ভাষা এক, তবু উচ্চারনের পার্থক্যে তারা স্বতন্ত্র হলেও বিভিন্ন নদী যেমন সাগরে মিলিত হয়ে নিজের অস্তিত্ব হারায়, আশ্রয় নেওয়া সব মানুষের পরিচিতি এখানে হয় একই– উদ্বাস্তু; জীবন- যুদ্ধে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত একদল ছিন্নমূল।

পুব- বাংলা থেকে যামিনী দাস মশাইও এই অধিগৃহীত জায়গায় ঘর তুলেছেন। পুব- বাংলায় ছিলেন বর্দ্ধিষ্ঞু পরিবার, আর এখানে পরিচিতি উদ্বাস্তু—তিন ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে যামিনী দাসের সংসার। সবার বড়, মেয়ে, খুবই বুদ্ধিমতী;শিক্ষার সুযোগ না পেলেও প্রকৃতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ ছিল তার সহজাত প্রবৃত্তি। পশুপতিবাবুর সঙ্গে তার কীভাবে পরিচয় ঘটে তা অজানাই রয়ে গেছে। পশুপতিবাবু, তখন সুঠাম চেহারার অধিকারী, দাদা বটকৃষ্ণের ছায়া-সঙ্গী। পাথরে কুঁদা
চেহারা; লোকে বিস্ফারিত নয়নে তার দিকে চেয়ে থাকতো। এহেন পশুপতি, যামিনী দাসের বড় মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছেন।
যামিনী দাস, মেয়েকে এগিয়ে দিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে তৎপর ছিলেন কি না, তা অবশ্য অজ্ঞাতই রয়ে গেছে।

পশুপতিবাবু মনে প্রাণে, যামিনী দাসের বড় মেয়েকে গ্রহণ করেছিলেন; সন্তান- সম্ভবা হয়ে পড়ায়, পিতা হরিকৃষ্ণনারায়ণ ঘোষাল ও মাতা নিভাননী দেবীর কাছে সব ব্যক্ত করে, বিবাহের কথা বললে, তাঁরা ক্রোধান্ধ হয়ে পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র করতে তৎপর হন। সংসারে বাদানুবাদের দু’একদিন পরে, যামিনীবাবুর বাড়িতে গিয়ে পশুপতিবাবু দেখেন, বাড়ি শূন্য, খাঁ, খাঁ করছে;
পাড়ার লোকের মুখে শোনেন, রাতের অন্ধকারে, দাস পরিবার, কাউকে কিছু না জানিয়ে, কোথায় চলে গেছেন, কেউই তা পশুপতিবাবুকে জানাতে সক্ষম হননি। পশুপতিবাবুও, আর কখনও বিয়ের পিঁড়ির দিকে পা বাড়াননি।ঠাকুরদা, মৃত্যুকালে পশুপতিবাবুর হাতদুটো ধরে তাঁর কৃত- কর্মের জন্য অনুশোচনা ব্যক্ত করেছেন; দাস পরিবারকে সমূলে
উচ্ছেদ করতে তিনিই লেঠেল পাঠিয়ে ছিলেন ; লেঠেলরা, ওদের ঘর- বাড়ি ভেঙ্গে দিলেও কোনো লোককে বাড়িতে দেখতে পায়নি। রাঘববাবু, নিজের কানে, কাকা ও ঠাকুরদার এসব গোপন কথোপকথন শুনেছেন। রক্ষনশীল পরিবারের
জাত্যভিমানের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মত সাহস বা ক্ষমতা সে সময় কাকা,পশুপতিবাবুর হয়তো ছিল না; দাদা বটকৃষ্ণও সে সময় খুব একটা ভাই’র সমর্থনে ছিলেন না, তা বলাই বাহুল্য। উঁচু জাতের বড়লোকের ছেলেরা, নীচু- জাতের গরীব- গুর্বোর মেয়েদের নিয়ে ‘ইন্টু- বিন্টু’ খেলতেই পারে, বুড়ো- আঙ্গুলে টিপে ফুচকার জল খেতেই পারে—এটাই তো স্বাভাবিক ঘটনা, তা বলে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা, না, সমাজ কিছুতেই তা মানবে না; ব্রহ্মন্যধর্মে, চটিজুতো পায়ে
শোভা বৃদ্ধি করলেও, মাথায় তা বড়ই অশোভন। অতএব, সমূলে বিনষ্ট করাই শ্রেয় ও সহজ উপায়।

তারপর ঘুরেছে কালচক্র; ইতিহাসও থেকেছে নিশ্চুপ, দাস পরিবার জনারণ্যে মিশে গেছে। এ সব গুপ্ত কাহিনীও,বর্তমান প্রজন্মের কাছে
অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। বটকৃষ্ণ ঘোষাল ও তাঁর স্ত্রী, ছোট শিশুপুত্র অমরেন্দ্র ও কন্যা শিবানীকে রেখে অল্পদিনের ব্যবধানে পরলোকে চলে গেছেন। পশুপতি বাবুই, সব ভাইপো- ভাইঝিকে আগলে রেখে ছিলেন, তো তিনিও
না ফেরার দেশে একদিন চলে গেলেন। একমাত্র রাঘবেন্দ্রবাবুই
কেবল জানতে পেরেছিলেন পশুপতিবাবুর মর্মপীড়া, অন্তর্দাহের কারন, তাও তো হয়েছে ইতিহাস। অমরেন্দ্র ও শিবানী সাবালক হয়েছে। শিবানী
এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে। রাঘবেন্দ্রবাবুর ছেলে, রোহন, আগামী বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। ছেলেটি, পড়াশোনায় তুখোড়, প্রতি ক্লাশের পরীক্ষায় সে প্রথম হয়ে আসছে। রঞ্জনবাবুর কাছে, মাঝে মধ্যেই ইংরেজি ট্রানশ্লেশন- খাতা দেখাতে নিয়ে আসে। রঞ্জনবাবুর সাথে পরামর্শ করে, উচ্চ মাধ্যমিকের পর ছেলে রোহনকে
কোলকাতার সেন্ট- জেভিয়ার্স কলেজে পড়াবার
মনস্থ করেছেন। পুত্র রোহন, অমরেন্দ্রের প্রায় সমবয়সী হলেও
চরিত্রগত দিক থেকে প্রায় বিপরীত মেরু । একজনের পড়াশোনাই ধ্যান, জ্ঞ্যান; আর অন্যজনের, পড়াশোনার সঙ্গে যেন
চিরকালের আড়ি। রোহনের আবার, ব্যবসা সম্পর্কে অনীহা।
পুত্র, যদি নিজের মনোমত পথে নিজেকে বিকাশ করতে পারে, যে কোন পিতার কাছে তার চেয়ে মানসিক শান্তি আর কী হতে পারে! পুত্র, বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে, সব পিতারই এই প্রত্যাশা।
রোহনের প্রতি রাঘবেন্দ্রবাবু উচ্চ আশা পোষন করেন।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।