T3 || ১লা বৈশাখ || বিশেষ সংখ্যায় উজ্জ্বল কুমার মল্লিক

সঞ্জীবনী সুধা
পাড়ার ঠেক গমগম করছে। পরপর তিন দিন ছুটি;দু’দিন ছুটির
জায়গায় সরকারি সৌজন্যে, পরের দিনটাও এবার ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং, সাপ্তাহিক সংসারের কাজের পর থাকছে অখণ্ড অবসর, আর, সেটা যে বাঙালি আড্ডায় ব্যয় করবে, তা বলাই বাহুল্য। আজ শুরু হয়েছে, আয়ুর্বেদিক ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা; সত্যি, সত্যিই এগুলো কতটা
উপকারে আসে, না, শুধুই বিজ্ঞাপণ, উঠেছে তর্ক; ভৃগু মুনির পুত্র চ্যবনের, চ্যবনপ্রাস কতটা বলবর্দ্ধক, মৃত- সঞ্জীবনী, কতটা
রোগ প্রতিষেধক ইত্যাদি, ইত্যাদি; তা নিয়ে বক্তাদের মুখে অভিজ্ঞতা
লব্ধ বুলি, ফুলকির মত ছুটচ্ছে। কারও মতে, ‘মাকড়সা জাল বোনে,
আহা কী সুন্দরে! মাঝে বসে করে আবাহন, ছুটে চলা কীট পতঙ্গে ;ওহে! একটু জিরিয়ে নাও আমার এ পান্থশালায়, দেখ এসে, কর পরখ, এনেছি মধুভাণ্ডে অমৃত, তোমাদের সকাশে’। আরে, যা যায় তা কি আর ফিরে আসে! হৃত- যৌবন কি পুনরুদ্ধার হয়! মরা গরু কি ঘাস খায়? না, মরা মানুষ আবার জেগে ওঠে? সবটাই ঐ মাকড়সার আহ্বান, শোষনের জন্য কী আপ্যায়ন!
আর এক প্রস্থ চা’র কাপ নিয়ে পাশের পচুর দোকানের ছেলেরা হাজির। শচীনদা, চা’র কাপে এক চুমুক দিয়েই মুখ খুললেন। সবাই জানে, উনি এখন পুরাণ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। এবার যে অতীতকে ঘেঁটে, বর্তমানের কড়াইয়ে, ভবিষ্যতের ফোড়ন চড়িয়ে এমন এক চর্বিত-চর্বন, মুখরোচক পরিবেশিত হবে, তার গন্ধ ও স্বাদে সবাই আকৃষ্ট হয়ে পতঙ্গের মত ঊর্ণ- নাভ জাত সূক্ষ সূত্রে আবদ্ধ হতে, হবে উন্মুখ ।
শচীনদা’র বুলি, দার্জিলিং’র টয়- ট্রেনের মত ঝিক, ঝিক, মাঝে মাঝে কু -উ-র মত প্যজ দিয়ে হেলতে দুলতে মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে
এগিয়ে চলেছে, সবাই তা গোগ্রাসে গিলছে; পরিবেশে বুলি ছাড়া পিন- ড্রপ সাইলেন্স।
শচীন দা বলছেন, ” দেখ, কশ্যপের দুই পত্নী, দিতি ও অদিতি;কশ্যপের ঔরসে দিতির গর্ভজাত হচ্ছে দৈত্যকুল, আর অদিতির সন্তান দল হচ্ছে দেবতা। পিতা এক, তো জিনও হবে এক। বৈমাত্রেয় ভাই, তো লাঠালাঠিও স্বাভাবিক। আবার তৃতীয় শত্রুর বেলায় বা নিজেদের স্বার্থে, তখন এক হবে। এই দেখ, ক্ষীরসমুদ্র মন্থনে, অমৃতের লোভে ওরা এক হোল, কিন্তু জিনে রয়েছে বঞ্চনা করার প্রবৃত্তি, তো কাজ মিটলেই শুরু হয়ে গেল, একে অপরকে ঠকানো; দেবতারা অমৃত খেয়ে হল অমর, যুদ্ধে মরবে না;দু’জন অসুর লুকিয়ে অমৃত কিছুটা গলায় ঢালতে পারলেও ওদের গলাটাই কেটে দিল দেবতারা অর্থাৎ সবটাই তারা ভোগ করবে। তাহলে, দৈত্য- দানব কী আকাট মুখ্যু নাকি! একবার ঠকেছে, অমৃত পায়নি, কিন্তু সঞ্জীবনী মন্ত্র জানে এমন আচার্য পেয়ে তাঁকে দৈত্য- দানবেরা গুরুত্বে করলো বরণ, আর, ওঁর সঞ্জীবনী বিদ্যার মন্ত্র বলে, মৃত্যুকে ভড়কি দিয়ে জীবিত হতে শুরু করলো। ওদের গুরু শুক্রাচার্য, আর দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি, মানে উপদেষ্টা; মুখপাত্র ও বলতে পারিস। তোরা তো জানিস, তিন দেবতাই সবকিছুর ঠিকে নিয়ে বসে আছে,ওনারাই আবার সবার পৃষ্টপোষক— তাঁরা হলেন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। ওদের পুজোয় তুষ্ট কর, তো বর পাবে; সে বরের প্রতিষেধক পেতে, তোমাকে আবার অন্য দেবতার শরণাপন্ন হতে হবে; মানে ঐ তিনের অন্যজনকে খুশি করতে হবে। তিনি যদি না পারেন তো বরদাতাকে দিয়ে প্রতিষেধক
আদায় করে দেবেন অর্থাৎ নিজেদের মৌরসি পাট্টা যেন অক্ষুন্ন থাকে।
দধীচি মুনি বামুন, আর ক্ষুপ রাজা ক্ষত্রিয়, দু’জনে পরম বন্ধু; জাতের দিক দিয়ে কে শ্রেষ্ঠ, লাগলো তর্ক। রাজা তো ইন্দ্রকে দৈত্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করেছেন; তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্র দিয়েছেন বজ্রান্তর। রাজা মুনির বন্ধু বটে, তবে শ্রেষ্ঠত্বের কাছে,জাতের বেলায় বন্ধুত্ব অসার। তর্কা- তর্কি,রেগে মুনি চালালেন হাত। রাজাও রেগে করলেন মুনিকে বজ্রাঘাত। মুনি মৃত্যু শয্যায় শুক্রাচার্যের ধ্যান করলেন;দৈত্যগুরু, সঞ্জীবনী মন্ত্রের জোরে দধীচিকে বাঁচিয়ে দিলেন। এবার দধীচি মুনি, শুক্রাচার্যের পরামর্শে মহাদেবের ধ্যান করে বজ্রের অবধ্যতা ও কেউ তাঁর ক্ষতি করতে পারবে না,এমন বর পেলেন। সোজা রাজসভায় গিয়ে রাজা ক্ষুপের মাথায় লাথ, আরেব্বাস;রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে হানলেন বজ্র, না, এবার বজ্র নিস্তেজ। রাজা তো হরিকে শরণ করলেন। শ্রীহরি বললেন,”মহেশ্বররের বলে দধীচি বলীয়ান , দেখি কী করা যায়।”শ্রী হরি ছদ্মবেশে মুনির কাছে যেতেই ধরা পড়ে গেলেন। মুনিকে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন রাজসভায় গিয়ে বলেন, “আমি ভয় পেয়েছি”, তা হলে, সব মিটে যায়। মুনি তো বামুন, ‘তেএঁটে,’ আবার মহেশ্বরের বর পেয়েছে, এ সুযোগ ছাড়ে। রাজসভায় গিয়ে উল্টে বললো, ” আমি এ জগতের কাউকে ভয় খাইনা । ” ব্যস, শ্রী- হরি ছাড়লেন চক্র ; আরে ঐ চক্র তো মহাদেবই
শ্রীহরিকে দিয়েছেন। শিব- শিষ্যের বিরুদ্ধে, তা তো থাকলো নিশ্চুপ। অনেক টাল- বাহানা, শেষে ব্রহ্মার
মধ্যস্থতায় হল সমাপ্তি। ক্ষুপ রাজা,বামুনের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিলেন। অবশ্য, বামুনে লিখেছে পুরাণ,
নিজেদের আধিপত্য তো দেখাবেই, এতে আর আশ্চর্য কোথায়! অন্য জায়গায় বিষ্ণুকে দেবতাদের মধ্যে প্রাধান্য দিয়েছে।”
“এবার তোরা, বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা কর। আইন সভা, বিচার- ব্যবস্থা আর রয়েছে
এক্সিকিউটিভ– এই তিন সংস্থাই হচ্ছে, ঐ ত্রি- মূর্তি।মাঝে, মাঝে নির্বাচন যুদ্ধ হয়ে থাকে,মন্থন আর কী! সরকার পক্ষ ও বিরুদ্ধ পক্ষ করে মন্থন, নাগরিকেরা হয় রজ্জু,আর নির্বাচন-কমিশন হয় মন্দার পর্বত; ক্ষীরসমুদ্রের তলায় দেশের সংবিধান হয় ঐ পর্বতের আধার- ধারক; ওদের টানাটনিতে, নাগরিকদের ওঠে নাভিশ্বাস, হয় রক্তপাত; গরল তো ওঠেই, তখন মহেশ্বররূপী, বিচার ব্যবস্থাকেই, সেই গরল পানের নিদান দিতে হয় ,সুস্থ ভাবমূর্তি ফেরাতে হয়। ঐ তিন মূর্তির মধ্যে রয়েছে সমন্বয়, আর অভাব ঘটলেই হয় ঐ ক্ষুপ ও দধীচির মত তলার লোকের মধ্যে ঘটে সংঘাত, তখন বিশ্বপ্রকৃতি মা’র ঘটে উদ্ভব, তিনিই ওদের সমন্বয়
ঘটান,হয় উলট- পালট, ঘটে নির্বাচন জোট; হলে হবে কী, সব তো ঐ দিতি, না হলে অদিতির পুত্র; ওদের জিনতো একই। এক্সিকিউটিভ বজ্র হানলে, বিচার- ব্যবস্থা বেল দিয়ে সঞ্জীবনী সুধা দিতে পারে; এমন কি, কোন আইন গত ব্যবস্থা নেওয়ার বিরুদ্ধে, স্থগিত নির্দেশ দিতে পারে।
আইন- সভার লোকেরা, তলায় দলের লোককে সঞ্জীবনী সুধা পান করার দেদার অনুমতি দিতে পারে; ওরাই তো সম্পদ, ওরাই করেছে মন্থন, ওরাই ঐ সঞ্জীবনী সুধার হকদার।অন্যেরা সুধা পান করতে এলেই ঘাচাং ফট হয়ে যাবে। এক্সিকিউটিভ, তাকিয়ে দেখে নেয়, কোন দেবতার বরে সুধা পানকারী বলবান, তখন, বুঝে সুঝে আ্যকসন। যখন দেবতা ও ভক্তদের মধ্যে বর দান, তুষ্টি প্রদান
চলে, তখন সাধারণ আপামরের কী হাল,
চোখ মেললেই গান্ধী মূর্তির পাদদেশে অবস্থানে থাকা, হা- হুতাশের ছবি মনকে নাড়িয়ে দেয়। সমাজ- ফড়েরা, সব দিতি- অদিতির পুত্র, সঞ্জীবনী সুধা পান, ওরাই কেবল করবে,এটাই ওদের লক্ষ্য;যদি ঐ সুধা পান করার বিরুদ্ধে রায় দাও, দু’দলই এক হয়ে যায়; কেন্দ্রীয়-শাসন বললেই সব হয়ে পড়ে একজোট; সাধারণ হয় বড়ে, পড়ে পড়ে মার খায়, বুক- চাপড়ায়;তিন মূর্তির দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে, সুধা- ভাণ্ডের দিকে ফ্যাল, ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে; ঐ সুধা পানকারীরা গা-গতরে কেমন ফুলছে, তাদের উল্লাস ধ্বনিতে জাগায় প্রাণে শিহরণ।প্রকৃতি মাতার কাছে আর্তের আর্তনাদ; করুণ প্রার্থনা, সময় হয়েছে এবার,”হে মাতা! বসুমতি,প্রসবি বীরভদ্রে আরবার, সহেনা এ মিথ্যাচার, হোক দক্ষ-যজ্ঞ ভণ্ড,
আবির্ভূতে, ভদ্রকালী রূপে। “