T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় মেহুল

নিপুণতা

মেহুল আজ বড্ড ক্লান্ত ওর শরীর যেন দিচ্ছে না, এতটাই ক্লান্ত না খেয়েই কখন যে শুয়ে গেছে তার খেয়াল নেই। শঙ্খধ্বনি কানে আসায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো সে, উঠে দেখে সন্ধ্যা নেমেছে ওর জানালার বাইরে। মেহুল আজ বড্ড অবাক হলো সাথে চিন্তিত ‘সন্ধ্যা হতে যায় আর মা আমায় আজ ডাকলো না!’
সে এবার স্ব-স্বরে চিৎকার করতে শুরু করলো মাআআআ বলে… পাশের ঘর থেকে ওর মা এসে সামনে দাঁড়ালো হাতে ধূপকাঠি নিয়ে, মেহুলের সেদিকে নজর গেল। চিন্তা তো দূর হলো কিন্তু এখনও সে অবাকবিস্মিত। কৌতূহলের বশে জিজ্ঞাসা করেই বসলো……

মেহুল – আচ্ছা মা সন্ধ্যে হয়ে গেল আর আজ তুমি ডাকলে না যে? তুমি তো কখনও আমায় ভরা সন্ধ্যেতে ঘুমোতে দাওনি!!

মা – কেনোই বা ডাকবো বলতে পারিস?
বাড়ির মেয়ে লক্ষী হয়, তাই ভরা সন্ধ্যেতে তোকে ঘুমাতে দিতাম না। তবে তুই আমার সংসারের ‘লক্ষী’ তা বটে, কিন্তু লক্ষীর- ও যে বিশ্রামের বড্ড প্রয়োজন তাইনা…! আর তুই এই তিনদিনে যে ‘দশভুজা’ হয়ে উঠেছিস মেহু, বুঝলি।
যাই এবার সন্ধ্যেটা সেরে আসি, বাকি কথা পরে কথা হবে।

মেহুল এক ভাবে ওর মায়ের দিকে চেয়ে মনোযোগ দিয়ে কথা গুলো শুনছিলো, বোধহয় কথাগুলোর অর্থ গভীর ভাবে অনুভবও করছিলো।
অসুস্থতার কারণে বাকি দিনের তুলনায় আজ ওর মায়ের মুখমন্ডলে ক্লান্তির ছাপ কিন্তু মায়ের ঠোঁটের আগায় হাসির ঝিলিকে সব বেমানান গুলো যেন অপরূপ ভাবে মানানসই হয়ে উঠেছে।
অন্ধকারময় ঘরেও মেহুলের চোখের কোনের জলটা চিক্ চিক্ করে উঠে চারিদিক আলোময় হয়ে উঠলো সাথে ঠোঁটে মৃদু হাসি ঠিক যেমন -নিঝুম ঘন অরণ্যে জ্যোৎস্না রাতে জোনাকির দর্শন।

আসলে তিনদিন ধরে ওর মায়ের ধুম জ্বর, এই তিনদিন ছেলেমানুষি করা পিচ্চি মেয়েটি একা হাতে ঘর-বাইরে সব সামলেছে। অফিসে যাওয়ার পূর্বে, এমনকি বাড়ি ফিরে এসে ওকে সব করতে হয়েছে।
আর পাঁচটা মেয়ের মতো মেহুল -ও ওর মা-কে বড্ড ভালোবাসে। মা ছাড়া যেন ওর গোটা দুনিয়াই অন্ধকার। কিন্তু আজ এই ছেলেমানুষি করা মেয়েটি যে কবে এত্ত বড়ো হয়ে উঠলো তা সত্যি আমারও হয়তো ভাবনার বাইরে। আপেক্ষিক দিক থেকে দেখতে গেলে মেহুলের হয়তো বিয়ের বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু কর্মনিপুণ বরাবরই সে ছিলো না। যেখানে কেউ ৩০ মিনিটে কোন কাজ শেষ করে সেখানে আমাদের মেহু ৫০ মিনিটে সেই কাজটি ‘শেষ’ নয় বরং ‘পূরণ’ করে। এর জন্য সে হীনমন্যতায় ভুগতো কারণ বাকিদের মতো চটজলদি কাজকর্ম করা সে জানতো না, দায়িত্ব নিতে বড্ড ভয় পেতো। তবে আজ সে ‘নিপুণতা’ -র সঠিক অর্থ বুঝতে পারলো – আজ বুঝলো সে ‘নিপুণতা মানে – যে কাজ পূর্ণতা পায়’…
মেহুল তার আনন্দ ধরে রাখতে না পেরে, তার দুই চোখ দিয়ে অনর্গল বৃষ্টি-ধারা বয়েই চলেছে… আসলে আজ যে ওর বড্ড সুখ, আর তার অধিক শান্তি।

এইসব ভাবতে ভাবতে ঝোড়ো দমকা হাওয়ার জেরে সপাট করে জানালাতে একটা সশব্দ হওয়াতে ওর তাল ফিরে এলো। লাইট অন করে দেখলো ওর কোলে একখান পারিজাত উড়ে এসে পড়েছে। আসলে জানালার বাইরে একটি পারিজাত গাছ রয়েছে ওদের; এই পারিজাত বা শিউলি কেবল আশ্বিনে নয়, সারা বছর ফোটে ওদের নন্দন আঙিনায়। ফুলটা হাতে নিয়ে সে ঘ্রাণ নিতে থাকলো, আর ঠিক সেই মূহুর্তেই পাশের ঘর থেকে টিভি হতে শব্দ এলো কানে। ‘আর ১২ দিন বাকি মা আসছে’……… তাইতো ‘মা’ আসছে মোর নন্দনকাননে পুনরায়। আর তখনই মনে পড়লো ওর মা যে বলেছে সেও যে ‘দশভূজা’। আর এই ভেবেই বোকার মতো খিলখিল করে হেসে উঠলো আমাদের মেহুল, সাথে প্রকৃতিও বাঁধনছাড়া অট্টহাসিতে বেশ মত্ত হয়ে উঠলো…

“আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল l
শুভ্র মেঘপুঞ্জ ভাসে আকাশের গায় –
আজি মোর প্রাঙ্গণে পারীজাতের সুবাস বয়।।
মাগো তুমি আসবে বলে –
প্রাণে এক হিল্লোল ।
খুশিতে বিভোর বসুন্ধরা –
আবেগে বিহ্বল।।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।