সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ২৩)

শহরতলির ইতিকথা

সজীবের বিয়ে  সম্পন্ন হল। ভালোয়, ভালোয় বৌভাত-ফুলশয্যা মিটেছে;আত্মীয় যারা এসেছিল, সব ফিরে গেছে। সজীব, স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি গেছে, ‘অষ্ট-মঙ্গলা’ সেরে নিজেদের বাড়িতে আসবে। এবার, সবাই  বাস্তবের মুখোমুখি। বিয়েতে, রাজীবের  বন্ধু অমিত এসেছিল, সেও ফিরে গেছে; আই এ  ফাইন্যাল পরীক্ষার জন্য কলেজে টেষ্ট পরীক্ষা শুরু হবে আর কিছুদিনের মধ্যে; সজীব, নিজেকে পূর্ণোদ্যমে পড়ায় নিয়োজিত করেছে; না,পরিশ্রমের কোনো বিকল্প  নেই, ‘করেঙ্গে আউর মরেঙ্গে’, ছোটবেলার কথাগুলো সব মনে পড়ছে। বইপত্র তো অপ্রতুল, তাই  কলেজের লাইব্রেরির বই-ই তার কাছে প্রধান ভরসা। ইকোনমিক্স’র  অধ্যাপক কুশারী স্যার,সব সময়,দুটো খাতার কথা বলতেন; ক্লাশের  নোট লিখে তা স্যারের  কাছে  ছিল জমা দেওয়া; আবার  অন্য খাতায় নোট নেওয়া, এভাবেই  ইকোনমিক্স-সাবজেক্টটা ওদের কাছে হয়ে গিয়েছে, জলবৎ।  আর্টস-কমার্সের, সব ছাত্রদেরই কাছেই এটা প্রিয় বিষয়; অধ্যাপক কুশারীর-ই এ যে অবদান, তা না বললেই নয়; রাজীব ভাবে, কেউ, কাউকে কোনো জিনিস শেখাতে পারে না, কেবল, ঐ বিষয় শেখার জন্য অনুপ্রানিত  করতে পারে, ঐ বিষয়ের প্রতি  ভালোবাসা তৈরি করাতে পারে; মনে পড়লে, হাসি পায়, একদিন স্যারের ফুল-প্যান্টের দিকে রাজীব, হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিল; তখন ‘গ্যাবারডিন’ কাপড়ের চল সবে শুরু  হয়েছে; স্যার বোর্ডে, কার্ভ আঁকছিলেন, হঠাৎই ঘুরে টেবিলে ডাষ্টার দিয়ে ঠকঠক আওয়াজ করে, আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করেন, প্যান্ট নয়, বোর্ড; লজ্জায়, রাজীব আরক্তিম হয়ে ওঠে। নিজের  দারিদ্রের জন্য, ও জিনিষ ওর কাছে ছিল স্বপ্নিল, কল্পনায় সীমিত।
       ইয়ারলি-বার্ষিক পরীক্ষায় বা হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার কোনোভাবেই কেউ ইকোনমিক্সএ দু’বার ফার্ষ্ট হতে  পারেনি। তীব্র  কম্পিটিশন, ভূগোলে, রাজীব একবার  ফার্স্ট  হোলো,তো পরের বারে হোলো ইকোনমিক্সে; ভূগোলে, অন্য ছেলে। অবশ্য, প্রায় সব বিষয়ে কমার্সের  ছাত্ররাই  এগিয়ে থাকে;আর লজিক ঐচ্ছিক  বিষয় হলেও সেটাতেও কমার্সের  ছাত্রদের  ধারে কাছে,আর্টসের  ছাত্ররা আসতে পারে না। যাই  হোক, প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে।
      হাজরামশাই ‘র ‘হপ্তা’ থেকে লোনের টাকা কাটছে;সজীবও কোঅপারেটিভ থেকে লোন নিয়েছে;ওরও ‘হপ্তা’ থেকে লোনের টাকা কাটা শুরু,অর্থাৎ সংসারে ‘ঘোঘ’ বৃদ্ধি পেল,সুতরাং অভাব,প্রকট হয়ে ফুটে  উঠলো;রাজীবের সংশয়  প্রমাণিত হচ্ছে।
     সজীব, আই-এ(কমার্স) পরীক্ষায় পাস করে,বি-কম কোর্সে ভর্তি হয়েছে। এবার,তারও খরচ বেড়েছে,আবার  হাতে টাকা কম পাচ্ছে,লোনের  টাকা কাটছে,অতএব সংসারে ,সে কম টাকা দিতে পারছে।
       টিনে ছাওয়া বারান্দায় হয়েছে চুন-সুরকি দিয়ে দশ-ইঞ্চির গাঁথনিতে,  একদিকে ঘেরা- বারান্দা-কাম ঘর ও অন্যদিকে ছাদে ওটার সিঁড়ি;পশ্চিম দিকে, বাইরে দিকে রয়েছে খোলা বারান্দা, তার উপর গোল-পিলার  তুলে  উপরের ছাদে ঘেরা-বারান্দার  উপর ঘর, ও তার  সঙ্গে পিলারের উপর   সরু  জুলন্ত বারান্দা হয়েছে।রান্না-ঘরের  সামনে থাকা পিয়ারা গাছটা কাটা পড়েছে।দশ-ইঞ্চির দেওয়ালের ভিতরের দিকটায়, একটা কুলুঙ্গি হয়েছে,সেখানেই  ঘরের লক্ষ্মীঠাকরুণের ঝাঁপি ও কাষ্ঠাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। বাইরের বারান্দার  দিকটার ভিতরের দেওয়ালে ,মানে পশ্চিম দিকটার দেওয়ালে,একটা কাঁচের আলমারি হয়েছে,ওখানেই  রয়েছে,নতুন বৌ’র পোস্টকার্ড সাইজের ছবি, বিয়ের আগে, সজীবের শ্বশুর বাড়ি থেকে মেয়ের ঐ ছবিই পাঠিয়েছিল।
  নিচের ঘর দুটোর একটায়,রজতও এণ্ডি-গেণ্ডিরা থাকে, আর অন্যটায় রাজীব;  অনেক রাত পর্যন্ত  পড়ে; কলেজ থেকে এসে,ট্যুইশান করে,একটু  পাড়ার  মাঠে বসে অক্সিজেন নিয়ে, বাড়ি এসে রাতের খাওয়ার  পর, চলে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি । রাত-জেগে পড়ার  জন্য আলো জ্বলে, তাই  এ ব্যবস্থা; এ  ছাড়া,সংসার থেকে, তার পড়াশোনার  জন্য কোনো সাহায্য  মেলে না; নিজের জামা-কাপড়ও নিজেকেই  কিনতে হচ্ছে, না, রাজীব  আর কারও সাহায্য প্রার্থী নয়, তিনটে বাড়িতে ট্যুইশান পড়িয়ে সে নিজের সংস্থান  করে চলেছে। কলেজের লাইব্রেরিয়ান স্যার, জুগিয়ে চলেছেন প্রয়োজনীয় বই; কলেজের স্যারেদের কাছে যে তার ঋণ অশোধ্য। সেও, ওনাদের মত ছাত্র-গড়ার কারিগর হতে চায়; লাইব্রেরিয়ান-স্যার, পোস্ট-গ্রাজুয়েট পরীক্ষায় থার্ড ক্লাস  হয়ে যাওয়ায়, অধ্যাপনা করা থেকে বঞ্চিত  হয়েছেন, তিনিও কমার্সের  ছাত্র ছিলেন। রাজীবকে সব বিষয়ে সাহায্যের  হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
      দোতলার  ঘরে  থাকে সজীব ও নতুন বৌ।রাতে প্রকৃতির  ডাকে সাড়া দিতে ওদের  তলায় নামতে হয়। বারান্দা-কাম ঘরের চৌকিতে শোয়, হাজরা ও হৈমবতী। নতুন-বৌ, সিঁড়ি দিয়ে নামতেই  শ্বশুর-শাশুড়িকে একসাথে শুয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পায়; হৈমবতীও  বৌমার বিস্মিত ভাবটাকে লক্ষ্য  করেছে; সেটা সে ভালোভাবে নেয়নি, তা তার কথাবার্তায় বোঝা যায়;শুরু হয়েছে বলা,”বৌমা এলো, আর আমার  শ্বশুরবাড়ির অংশ ঘুচলো।”
    অনিবার্য  হয়ে উঠলো সংসারে সেই চিরাচরিত সংঘাত, শাশুড়ি-বৌ’র ভিন্নমুখী অবস্থান ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *