শহরতলির ইতিকথা
সজীবের বিয়ে সম্পন্ন হল। ভালোয়, ভালোয় বৌভাত-ফুলশয্যা মিটেছে;আত্মীয় যারা এসেছিল, সব ফিরে গেছে। সজীব, স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি গেছে, ‘অষ্ট-মঙ্গলা’ সেরে নিজেদের বাড়িতে আসবে। এবার, সবাই বাস্তবের মুখোমুখি। বিয়েতে, রাজীবের বন্ধু অমিত এসেছিল, সেও ফিরে গেছে; আই এ ফাইন্যাল পরীক্ষার জন্য কলেজে টেষ্ট পরীক্ষা শুরু হবে আর কিছুদিনের মধ্যে; সজীব, নিজেকে পূর্ণোদ্যমে পড়ায় নিয়োজিত করেছে; না,পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই, ‘করেঙ্গে আউর মরেঙ্গে’, ছোটবেলার কথাগুলো সব মনে পড়ছে। বইপত্র তো অপ্রতুল, তাই কলেজের লাইব্রেরির বই-ই তার কাছে প্রধান ভরসা। ইকোনমিক্স’র অধ্যাপক কুশারী স্যার,সব সময়,দুটো খাতার কথা বলতেন; ক্লাশের নোট লিখে তা স্যারের কাছে ছিল জমা দেওয়া; আবার অন্য খাতায় নোট নেওয়া, এভাবেই ইকোনমিক্স-সাবজেক্টটা ওদের কাছে হয়ে গিয়েছে, জলবৎ। আর্টস-কমার্সের, সব ছাত্রদেরই কাছেই এটা প্রিয় বিষয়; অধ্যাপক কুশারীর-ই এ যে অবদান, তা না বললেই নয়; রাজীব ভাবে, কেউ, কাউকে কোনো জিনিস শেখাতে পারে না, কেবল, ঐ বিষয় শেখার জন্য অনুপ্রানিত করতে পারে, ঐ বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করাতে পারে; মনে পড়লে, হাসি পায়, একদিন স্যারের ফুল-প্যান্টের দিকে রাজীব, হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিল; তখন ‘গ্যাবারডিন’ কাপড়ের চল সবে শুরু হয়েছে; স্যার বোর্ডে, কার্ভ আঁকছিলেন, হঠাৎই ঘুরে টেবিলে ডাষ্টার দিয়ে ঠকঠক আওয়াজ করে, আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করেন, প্যান্ট নয়, বোর্ড; লজ্জায়, রাজীব আরক্তিম হয়ে ওঠে। নিজের দারিদ্রের জন্য, ও জিনিষ ওর কাছে ছিল স্বপ্নিল, কল্পনায় সীমিত।
ইয়ারলি-বার্ষিক পরীক্ষায় বা হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার কোনোভাবেই কেউ ইকোনমিক্সএ দু’বার ফার্ষ্ট হতে পারেনি। তীব্র কম্পিটিশন, ভূগোলে, রাজীব একবার ফার্স্ট হোলো,তো পরের বারে হোলো ইকোনমিক্সে; ভূগোলে, অন্য ছেলে। অবশ্য, প্রায় সব বিষয়ে কমার্সের ছাত্ররাই এগিয়ে থাকে;আর লজিক ঐচ্ছিক বিষয় হলেও সেটাতেও কমার্সের ছাত্রদের ধারে কাছে,আর্টসের ছাত্ররা আসতে পারে না। যাই হোক, প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে।
হাজরামশাই ‘র ‘হপ্তা’ থেকে লোনের টাকা কাটছে;সজীবও কোঅপারেটিভ থেকে লোন নিয়েছে;ওরও ‘হপ্তা’ থেকে লোনের টাকা কাটা শুরু,অর্থাৎ সংসারে ‘ঘোঘ’ বৃদ্ধি পেল,সুতরাং অভাব,প্রকট হয়ে ফুটে উঠলো;রাজীবের সংশয় প্রমাণিত হচ্ছে।
সজীব, আই-এ(কমার্স) পরীক্ষায় পাস করে,বি-কম কোর্সে ভর্তি হয়েছে। এবার,তারও খরচ বেড়েছে,আবার হাতে টাকা কম পাচ্ছে,লোনের টাকা কাটছে,অতএব সংসারে ,সে কম টাকা দিতে পারছে।
টিনে ছাওয়া বারান্দায় হয়েছে চুন-সুরকি দিয়ে দশ-ইঞ্চির গাঁথনিতে, একদিকে ঘেরা- বারান্দা-কাম ঘর ও অন্যদিকে ছাদে ওটার সিঁড়ি;পশ্চিম দিকে, বাইরে দিকে রয়েছে খোলা বারান্দা, তার উপর গোল-পিলার তুলে উপরের ছাদে ঘেরা-বারান্দার উপর ঘর, ও তার সঙ্গে পিলারের উপর সরু জুলন্ত বারান্দা হয়েছে।রান্না-ঘরের সামনে থাকা পিয়ারা গাছটা কাটা পড়েছে।দশ-ইঞ্চির দেওয়ালের ভিতরের দিকটায়, একটা কুলুঙ্গি হয়েছে,সেখানেই ঘরের লক্ষ্মীঠাকরুণের ঝাঁপি ও কাষ্ঠাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। বাইরের বারান্দার দিকটার ভিতরের দেওয়ালে ,মানে পশ্চিম দিকটার দেওয়ালে,একটা কাঁচের আলমারি হয়েছে,ওখানেই রয়েছে,নতুন বৌ’র পোস্টকার্ড সাইজের ছবি, বিয়ের আগে, সজীবের শ্বশুর বাড়ি থেকে মেয়ের ঐ ছবিই পাঠিয়েছিল।
নিচের ঘর দুটোর একটায়,রজতও এণ্ডি-গেণ্ডিরা থাকে, আর অন্যটায় রাজীব; অনেক রাত পর্যন্ত পড়ে; কলেজ থেকে এসে,ট্যুইশান করে,একটু পাড়ার মাঠে বসে অক্সিজেন নিয়ে, বাড়ি এসে রাতের খাওয়ার পর, চলে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি । রাত-জেগে পড়ার জন্য আলো জ্বলে, তাই এ ব্যবস্থা; এ ছাড়া,সংসার থেকে, তার পড়াশোনার জন্য কোনো সাহায্য মেলে না; নিজের জামা-কাপড়ও নিজেকেই কিনতে হচ্ছে, না, রাজীব আর কারও সাহায্য প্রার্থী নয়, তিনটে বাড়িতে ট্যুইশান পড়িয়ে সে নিজের সংস্থান করে চলেছে। কলেজের লাইব্রেরিয়ান স্যার, জুগিয়ে চলেছেন প্রয়োজনীয় বই; কলেজের স্যারেদের কাছে যে তার ঋণ অশোধ্য। সেও, ওনাদের মত ছাত্র-গড়ার কারিগর হতে চায়; লাইব্রেরিয়ান-স্যার, পোস্ট-গ্রাজুয়েট পরীক্ষায় থার্ড ক্লাস হয়ে যাওয়ায়, অধ্যাপনা করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তিনিও কমার্সের ছাত্র ছিলেন। রাজীবকে সব বিষয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
দোতলার ঘরে থাকে সজীব ও নতুন বৌ।রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ওদের তলায় নামতে হয়। বারান্দা-কাম ঘরের চৌকিতে শোয়, হাজরা ও হৈমবতী। নতুন-বৌ, সিঁড়ি দিয়ে নামতেই শ্বশুর-শাশুড়িকে একসাথে শুয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পায়; হৈমবতীও বৌমার বিস্মিত ভাবটাকে লক্ষ্য করেছে; সেটা সে ভালোভাবে নেয়নি, তা তার কথাবার্তায় বোঝা যায়;শুরু হয়েছে বলা,”বৌমা এলো, আর আমার শ্বশুরবাড়ির অংশ ঘুচলো।”
অনিবার্য হয়ে উঠলো সংসারে সেই চিরাচরিত সংঘাত, শাশুড়ি-বৌ’র ভিন্নমুখী অবস্থান ।