ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব – ২২)

আলাপ

বিখ্যাত ঠুংরী গায়ক গায়িকা তো অনেক ছিলেন, কিন্তু গৌহর জানের মতো আর কজন হন, যার জীবন গল্পে পরিপূর্ণ? তাই ঠুংরীর কথা বলতে গেলে গৌহর জানের কথা বলতেই হয়। গৌহর জান ছিলেন একমাত্র গায়িকা যিনি সেই আমলে প্রায় ছশো গ্রামোফোন রেকর্ড করেছিলেন! তিনিই ছিলেন একমাত্র গায়িকা যিনি চারটি সাদা ঘোড়ায় টানা ফিটন গাড়ি চড়ে গঙ্গার ঘাটে হাওয়া খেতে যেতেন! তাঁর সম্পর্কে গুগল একটি ডুডল তৈরি করে যেখানে তিনি একটি গ্রামোফোনের চোঙ-এর সামনে একটি ছোট সাদা বেড়াল কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন! শোনা যায় সেই আমলে গৌহর জান তাঁর এই বেড়ালের বিয়ে দিয়েছিলেন দুইশত তংকা খরচ করে এবং সেই বেড়ালের সন্তানের জন্মদিন পালন হয় বাইশ হাজার তংকা খরচ করে! এই ব্যয় সেই যুগে অকল্পনীয়! তিনি এতো বিখ্যাত হন যে গৌহর জানের ছবি অস্ট্রিয়া থেকে বেরোনো দেশলাই বাক্সের মলাটে পাওয়া যেতো!
এবার প্রথম থেকেই তাঁর জীবন ও গান সম্বন্ধে দু চার কথা বলা যাক। কাহিনীর শুরু উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে। সেখানে বরফ কোম্পানীতে কাজ করতেন এক সেনা অফিসার হার্ডি হেমিংস। সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী তিনি এদেশে এক উপপত্নী গ্রহণ করেন। সেই মেয়েটি এদেশীয় ছিলেন, নাম রুক্মিনী। বিবাহের পর তিনি খ্রীষ্টান হন এবং তাঁর নাম হয় এলিজা হেমিংস। এদের বড় মেয়ে ছিলেন অ্যাডেলাইন ভিক্টোরিয়া হেমিংস। তাঁর সঙ্গে ১৮৭২ সালে আজমগড়ে একটি আর্মেনিয়ান যুবক রবার্ট উইলিয়াম ইয়োয়ার্ডের বিবাহ হয়। এর পরের বছর ১৮৭৩ সালে তাদের একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়। ব্যপ্টিসমের পর তাঁর নাম রাখা হয় ইলিনা অ্যাঞ্জেলিনা ইয়োয়ার্ড। অ্যাডেলাইন ছোটবেলা থেকেই স্থানীয় পরিবেশের গুণে শের শায়েরীর ভক্ত ছিলেন। তিনি উর্দু ও পার্শি ভাষায় শের রচনা করতেন এবং গাইতেন। কিন্তু তাঁর ও রবার্টের বিবাহ বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। ১৮৭৯ সালে তাদের বিচ্ছেদের পর, অ্যাডেলাইন সহায় সম্বলহীণ হয়ে পড়েন এবং একমাত্র কন্যা অ্যাঞ্জেলিনাকে নিয়ে জীবনধারণ করার জন্য তবায়েফের জীবন বেছে নেন। কিছুদিনের মধ্যেই খুরশিদ নামে এক মুসলমান ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে তাঁর হাত ধরে অ্যাডেলাইন বেনারসে চলে আসেন। সেখানে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন । তিনি বেনারসে তবায়েফের জীবন যাপন শুরু করেন। তাঁর নতুন নাম হয় মালকা জান।
১৮৫৬ সালে ইংরেজরা সিপাহী বিদ্রোহে সহায়তার জন্য লক্ষ্ণৌয়ের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে কলকাতায় নির্বাসনে পাঠান। নবাব রাজ্য ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। কিন্তু তাঁর অসাধারণ শিল্প ও সঙ্গীত প্রীতির কারণে কলকাতাতেই তিনি যেন মেটিয়াবুরুজে নিজের ছোট লক্ষ্ণৌ গড়ে নেন এবং বিভিন্ন ওস্তাদ ও তবায়েফদের নিজের সভায় গানবাজনার জন্য আহবান করতেন। বিভিন্ন শিল্পীরা নবাবের দরবারে নৃত্যগীত পরিবেশন করতেন ও কদর লাভ করতেন। এই কথা চারিদিকে রটে যায় এবং বেনারসে মালকাজানের কানেও যায়। এভাবেই একদিন ভাগ্যাণ্বেষনের জন্য মালকা জান নবাবের দরবারে এসে পৌঁছন। নবাবের অনুরোধে তাঁরই রচনা দুটি বিখ্যাত গজল “যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী” ও “বাবুল মোরা নৈহর ছুটো হি যায়” শোনান তিনি। নবাব মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিজের সভায় স্থান দেন। সেদিন মালকার গানের সঙ্গে নৃত্য সঙ্গত করেছিলো তাঁর দশ বছরের ফুটফুটে মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনা, মা ইসলাম ধর্ম নেওয়ার পর যার নাম হয় গৌহর। তাঁর হাত পায়ের ভঙ্গীমা দেখে মুগ্ধ হন সভায় উপস্থিত বিন্দাদিন মহারাজ (বিখ্যাত কত্থক গুরু বিরজু মহারাজের পিতা)। তিনি মেয়েটিকে কত্থক শেখানোর জন্য চেয়ে নেন। মেয়েটির নতুন নাম হয় গৌহর জান।
সেই সময় তবায়েফদের কয়েকটি শ্রেণীবিভাগ ছিলো। সর্বোচ্চ শ্রেণীতে পড়তেন বাঈরা, যারা মার্গসঙ্গীতে ওস্তাদ ছিলেন এবং মূলত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। তার পরের শ্রেণীতে পড়তেন জান যারা নাচের সঙ্গে গান পরিবেশন করতেন। এ ছাড়া অন্য সম্প্রদায়কে আরো নীচু শ্রেনীতে ফেলা হতো কারণ তাঁরা মূলতঃ দেহ ব্যাবসায়ে নিযুক্ত থাকতেন। মালকাজান চাইতেন তাঁর কন্যা যেন নৃত্য গীতে পারদর্শী হন ও সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারেন। তাই তাকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। বিন্দাদিন মহারাজের কাছে লক্ষ্ণৌ ঘরানার কত্থক ও ঠুংরী শেখার পাশাপাশি গৌহর জান বাংলা গানের তালিম নেন বামাচরণ ভট্টাচার্যের কাছে। বাংলা পদাবলী ও কীর্তন শেখেন রমেশ চন্দ্র দাস বাবাজীর কাছে। শ্রীজান বাঈয়ের কাছে ধ্রুপদ ও ধামার এবং মিসেস ডি সিলভার কাছে ইংরাজী ভাষা ও গানের তালিম নেন। মায়ের কাছে উর্দু ও পার্শি ভাষার শায়েরী শিক্ষা তো ছিলই।
সেই সময় কলকাতা শহর ছিলেন ইংরেজদের রাজধানী। ক্রমে শহর বড় হচ্ছিলো। ইংরেজদের মোশায়েব দেশীয় ব্যবসায়ী ও জমিদার শ্রেণী, যাদের হাতে প্রচুর কাঁচা পয়সা এবং যারা সঙ্গীত ও নৃত্যের পৃষ্ঠপোষকও বটে, তাদের সভায় সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্পী কলাবন্তরা জড়ো হচ্ছিলেন। মালকাজানের কাছে দ্বারভাঙ্গার রাজার সভায় গান গাওয়ার আমন্ত্রণ এলো। মালকা নিজে না গিয়ে তাঁর মেয়ে গৌহরকে প্রথমবার সেখানে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য পাঠালেন। সেই গান শুনে হৈ হৈ পড়ে গেলো এবং তিনি দ্বারভাঙ্গার সভাগায়ক রূপে স্থান লাভ করলেন। ক্রমে চিতপুরের গৌহরজান কলকাতার সঙ্গীতপিপাসুদের মনে বিশেষ জায়গা করে নিলেন। তাঁর রূপ, গান ও নাচের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো কলকাতা ছাড়িয়ে গোটা ভারতবর্ষে। তাঁর নাম হলো গৌহরজান কলকাত্তাওয়ালী। বলা হতে লাগলো সৌহর বিনা স্ত্রীলোক আর গৌহর বিনা কলকাতার কোন মূল্য নেই।
ঊনবিংশ শতকের গোড়ায়, গ্রামোফোন রেকর্ডিং প্রথম আবিষ্কার হয়। ১৯০২ সালে ফ্রেডরিক গাইসবার্গ বলে এক আমেরিকান ভদ্রলোক গ্রামোফোন অ্যান্ড টাইপরাইটার লিমিটেডের পক্ষে কলকাতায় আসেন গ্রামোফোনে কিছু রেকর্ড করার জন্য। তখন গ্রামোফোনে খুব কম সময়ের জন্য, মাত্র তিন মিনিটের জন্য রেকর্ডিং সম্ভব হতো। বড় বড় ওস্তাদরা বললেন যে ভারতীয় মার্গসঙ্গীত মাত্র তিন মিনিটে পরিবেশন অসম্ভব। তাতে গানের রূপ রস ক্ষুণ্ণ হবে। তাঁরা রেকর্ডিং করতে চাইলেন না। তখন গৌহরজান সেই চ্যালেঞ্জ নিলেন এবং মাত্র তিন মিনিটে চিত্তাকর্ষক অথচ বিশুদ্ধ হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে তাক লাগিয়ে দিলেন সবাইকে। তারপর থেকে শুরু করে প্রায় ছশো গান রেকর্ড করেছিলেন গৌহর। সঙ্গীত পরিবেশনের আগে তিনি মন্দ্র কন্ঠে ঘোষণা করতেন “মাই নেম ইস গৌহরজান!” এই ঘোষণা তাঁর রেকর্ডগুলিকে বিশিষ্ট করে রেখেছিলো। প্রতিবার রেকর্ডিং-এ তিনি নতুন নতুন গাউন ও নানা নতুন গহনা পরে আসতেন।
গ্রামোফোন রেকর্ডের কল্যানে তাঁর গান দূরদূরান্তরে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রদেশ থেকে গানের জন্য তাঁর ডাক আসতে থাকে। তিনি সেই সময় এক একটি সভায় সঙ্গীত পরিবেশন করতে দুহাজার টাকা করে নিতেন যা সে যুগে প্রচুর টাকা। নানা প্রদেশ থেকে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেশীয় রাজারা বারো বগির ট্রেন পাঠাতেন কলকাতায়।
প্রতিদিন চার ঘোড়ার ফিটনে গঙ্গার ঘাটে হাওয়া খেতে যেতেন তিনি। একদিন বড়লাটের সামনে পড়ে যান। বড়োলাট তাকে বিশিষ্ট কেউ ভেবে টুপি খুলে অভিবাদন করেন। পরে যখন জানতে পারেন তিনি তবায়েফ তখন প্রচন্ড রেগে তাকে হাজার টাকা ফাইন করেন, কারণ সেই আমলে খুব বিশিষ্ট রাজা জমিদার বা বড়লাট ছাড়া কারো চার ঘোড়ার ফিটন চড়ার অনুমতি ছিলো না। গৌহর জান কিন্তু নির্দিধায় সেই হাজার টাকা ফাইন দিয়েই রোজ ফিটনে ঘুরে বেড়াতেন।
একবার এক সভায় মালকাজান আগ্রাওয়ালী (যিনি অন্য এক মালকাজান) তাঁর সঙ্গে গৌহর সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য যান। মালকাজান আগ্রা ঘরানার অপূর্ব সব বন্দিজ এবং ধ্রুপদ ধামার পরিবেশন করছিলেন। অদ্ভুত তাঁর সুরমূর্ছনা। কিন্তু সেই উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত দর্শক বুঝতে পারছিলেন না। গৌহর কিন্তু বুঝতেন কোন দর্শক কী চান। তিনি প্রথম গাইতে উঠেই একটি হালকা উর্দু গজল পরিবেশন করেন ও শ্রোতারা “কেয়াবাত কেয়াবাত” করে ওঠেন।
১৯২০ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সময় স্বয়ং গান্ধিজি গৌহরের শরণ নিয়েছিলেন তাকে গান গেয়ে আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য। গৌহর শর্ত দিয়েছিলেন যে সে সভায় গান্ধিজিকে আসতে হবে, তবায়েফ বলে ঘৃণা করলে চলবে না। গান্ধিজি রাজি হন।
অকাতরে খরচ এবং বারংবার ভুল ব্যাক্তির প্রেমে পড়ে গৌহর জান প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। ক্রমে তাঁর সব সম্পত্তি ঠকিয়ে নেন বিভিন্ন ব্যক্তিরা তাঁরই প্রেমিক সেজে। যখন তিনি প্রায় কপর্দক শূন্য, সেই সময় তিনি মাইসোরের ওয়াদিয়ার রাজার সভায় সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রিত হন। সেখানে সঙ্গীত পরিবেশনের পর প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন ও মাইসোরেই থেকে যেতে হয় তাকে। মাত্র সাতান্ন বছর বয়সে এই কোকিলকন্ঠী শিল্পীর মৃত্যু হয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।