সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ১৩)

শহরতলির ইতিকথা

   পাড়ার  যে বিশাল পরিত্যক্ত  অট্টালিকাতে ভূতরূপী গোপাল মুখুজ্জের  বাস ছিল,পরে মুসলমান  রাজমিস্ত্রীদের আবাস হয়েছিল,এখন সেটাতে পুব-বাংলার এক বর্ধিষ্ঞু পরিবার  এসে ঠাঁই  নিয়েছে। বাড়ি এখন সব সময় গমগম করে,কোলাহলে মুখর।ওদের বাড়ি ছিল ময়মনসিং জেলায়; ওরা নাকি,ওখানকার  কোনো অঞ্চলের জমিদার  ছিল,এখন উদ্বাস্ত  হয়ে,এ বাংলায় এসেছে,বিরাট পরিবার, তা সতেরো-আঠারো জন তো হবেই;যদি গোপাল  মুখুজ্জে  কাছেপিঠে থেকেও থাকে, তবে বাংলা ভাষার  উচ্চারণের  বৈগুণ্যে পালাবার পথ পাবে না।ঐ পরিবারের  কর্তা-গিন্নির চেহারায় সমৃদ্ধির ছাপ স্পষ্ট।  যাই  হোক,যা অতীত,তা অতীত,বর্তমানের  জীবন-যুদ্ধে সবাই  তৎপর। ঐ পরিবারের  বড় ছেলে  হাজরাদের  কারখানায় ষ্টাফের  চাকরি করে,মেজ-জন গঙ্গার  ওপারে জোসেফ কারখানায় অফিসার  পদে আছে,সেজ-জন এল-এম-এফ ডাক্তার। একজন তো  ফুটবলার; ফুটবলে লাথি মেরে আসানসোল- দুর্গাপুর  অঞ্চলের সাইকেল কারখানায় বেশ ভালো পদেই আসীন হয়েছে। শীতকালে ,ক্রিকেট  খেলার  মরশুমে,ওদের,  আর ওদেরই কয়েকটি পরিচিত পরিবার  নিয়েই  এ অঞ্চলের  মাঠে   ক্রিকেট  ম্যাচ  -খেলার  ধুম পড়ে যায়;ওদের আসার আগে এ অঞ্চলে ফুটবলই খেলা হত ঐ মাঠে, ক্রিকেট খেলার  চল এ অঞ্চলে ছিল বলে তো মনে পড়ে না,যদিও চুঁচুড়ার  ডিএম-অফিসের মাঠে  কখনো সখনো ক্রিকেট খেলা চোখে পড়তো।
      ওদের মধ্যে ছোটো তিন ভাই, সজীব,রাজীবের  সঙ্গে  স্থানীয় স্কুলে পড়ছে ।সজীবের সহপাঠী, পরীক্ষায় ফেল করে,মিলিটারিতে চলে গেল;পরের দু’ভাই  রাজীবের   সঙ্গে  স্কুল  ফাইন্যাল  পরীক্ষায় বসবে।এ বাড়িতে  থেকেই  ডাঃ দাদার বিয়ে হল,রাজীব-সজীব নেমতন্ন খেয়েছে;বৌদি,কোলকাতার  মেয়ে;রাজীবকে  খুবই   স্নেহ করেন,অবশ্য ডাক্তার দাদারও স্নেহভাজন সে।
     এ বাড়িতে আসার  পর ,ওদের  বাংলা ভাষার  উচ্চারণের প্রাবল্যে গোপাল  মুখুজ্জে পগার  পার হয়েছ কিনা,  তা না নিশ্চিত হলেও, দুর্গোৎসবের মন্ত্র উচ্চারণ ও উলুধ্বনির শব্দ-তরঙ্গ যে ব্রহ্মদৈত্য  তাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল, তা নিশ্চয় করেই বলা যেতে পারে। যে বছর দুর্গা পুজো শুরু করলো,ঐ বছরই শেষের দিকে, ওদের  মাতৃবিয়োগ হল।পরের  বছর থেকে মাতৃ- আরাধনাও বন্ধ  হল; এর কিছুদিনের  মধ্যেই  কর্তামশাইও গিন্নির ডাকে সাড়া দিলেন।
       জমিদারী তো নেই;সংসারের  ব্যয়, বৃদ্ধির  পথে; সুতরাং  একান্নবর্তী পরিবার  থাকা মানে তো  ইঞ্জনের পিছনে গাধা-বোটের সংখ্যা বৃদ্ধি,এ জ্ঞান-বৃক্ষের ফলের তাড়নায়, অতএব যে যার পরিবার  নিয়ে নিজের নিজের চাকুরিস্থলে চলে গেল।
ঐ বাড়িতে  এখন আছে  ডাঃ দাদা, তার স্ত্রী ও তিন ভাই;একজন তো চলে গেছে মিলিটারিতে,সেও তো অবিবাহিত ।
ডাঃ দাদা,অঞ্চলের  একটু দূরের  কারখানার  সিএমও; আবার  অঞ্চলের  বাজারে আছে,  ডাক্তারি করার  চেম্বার।
সকালে চেম্বারে বসে; নিজেই বাজার  করে,চেম্বারে রেখে দেয়,অন্য ছোটভাই দের মধ্যে কেউ একজন এসে বাড়িতে নিয়ে যায়। জমিদার  তনয়,তাই, অপরকে, একটু হেয় করার প্রবণতা বোধহয় জিনগত,তাই  বাজারে আলু-পটল ইত্যাদি কেনার সময়,দোকানীদের
‘তুই-তোকারি’  সম্বোধন   করে; দৃষ্টিকটু
হলেও কেউ প্রতিবাদ  করেছে বলে শোনা যায়নি।
    হঠাৎই  একদিন  দেখা গেল,চোঙা হাতে নিভাননীর  মাসতুতো দাদা,রাস্তার  তেমাথা-মোড়ে বলছেন,”সিংহের আশ্রয়ে শৃগাল বাস করে, জয় সর্বানন্দের জয়, তোমরা পাত্তা লাগাও।”
এ কথার  অর্থটা ঠিক রাজীবের  কাছে পরিষ্কার  হল  না।কে সিংহ,কেইবা শৃগাল,বড় ধাঁধায় ফেলেছেন;এ নিয়ে রাজীব ও তার বন্ধুদের মধ্যে  আলাপ-আলোচনা চলতে লাগলো।পরে জানা গেল, ওঁনাদের  পাড়ার  রক্ষাকালীতলার মাঠের মিটিংএ,বচসা হওয়ার  ফলশ্রুতিতেই  চোঙা হাতে,বিরূপাক্ষের  বাবা,ঘোষ মশাই’র এ উক্তি।
    তখন দেশে,কংগ্রেসি-করা লোকেদের  দাপট ছিল;তারাই  মিউনিসিপ্যালিটি থেকে আরম্ভ  করে, স্কুল,ক্লাব,সব কিছুই পরিচালনার  ক্ষেত্রে  মাতব্বরি করতো, সব সরকারি,সরকারি সাহায্য-প্রাপ্ত  প্রতিষ্ঠানে তারা ছিল নৈবেদ্যের মাথার
জোড়া সন্দেশ।প্রাথমিক  শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে তাদের  বক্তব্যই শেষ কথা,তারাই সবের চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান;আর ওদের নিয়ন্ত্রক ছিল অঞ্চলের পদাধিকারী,  কংগ্রেস দলের হর্তা-কর্তা বিধাতা।ঐ রকম এক নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তির  আস্ফালনে তিত-বিরক্ত হয়ে বিরূপাক্ষের  বাবা,’সক্রেটিসের’  ভূমিকায় নেমেছেন, জনসাধারণের  বিবেককে জাগিয়ে তুলতে প্রয়াসী।অবশ্য,মেজ-ছেলের মৃত্যুর পর,তাঁর মাথায় কোনো গণ্ডগোল  হয়ে থাকলেও, থাকতে পারে।
    অন্য একদিন, রাস্তার মোড়ে চোঙা নিয়ে বলছেন,”আলুওয়ালা ‘নন্দীর’  আয় অনেকের চেয়ে কম নয়,সম্বোধনে,’তুই ‘
থেকে তুমিতে এস, নিজেকে  শোধরাও,কাজের ক্ষেত্রে কেউ বড় ছোট নয়”।
    কংগ্রেসি-করা রাজনীতির
 কারবারিরা তো ‘বারোয়ারি  ভাই-ফোঁটা’
এড়াবে না,জন-সংযোগ কি না বলতে পারবো না,তবে প্রতি ‘ফোঁটার’   দিন  ওদের উপস্থিতি ও আগ্রহ চোখে পড়ার মত;এ হট্টগোলে তারা সাগ্রহে অংশ গ্রহন  করে।বিভিন্ন  স্কুলের পরিচালন-কমিটির নির্বাচনে,রমার মাষ্টার মশাই ‘র নাম ,শিক্ষানুরাগীদের তালিকাভুক্ত। রমা,স্কুল-ফাইন্যাল  উত্তীর্ণ নয়,তাই  চক্ষু-লজ্জার  খাতিরে হয়তো  তার নামটা তুলতে  পারেনি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *