শহরতলির ইতিকথা
পাড়ার যে বিশাল পরিত্যক্ত অট্টালিকাতে ভূতরূপী গোপাল মুখুজ্জের বাস ছিল,পরে মুসলমান রাজমিস্ত্রীদের আবাস হয়েছিল,এখন সেটাতে পুব-বাংলার এক বর্ধিষ্ঞু পরিবার এসে ঠাঁই নিয়েছে। বাড়ি এখন সব সময় গমগম করে,কোলাহলে মুখর।ওদের বাড়ি ছিল ময়মনসিং জেলায়; ওরা নাকি,ওখানকার কোনো অঞ্চলের জমিদার ছিল,এখন উদ্বাস্ত হয়ে,এ বাংলায় এসেছে,বিরাট পরিবার, তা সতেরো-আঠারো জন তো হবেই;যদি গোপাল মুখুজ্জে কাছেপিঠে থেকেও থাকে, তবে বাংলা ভাষার উচ্চারণের বৈগুণ্যে পালাবার পথ পাবে না।ঐ পরিবারের কর্তা-গিন্নির চেহারায় সমৃদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। যাই হোক,যা অতীত,তা অতীত,বর্তমানের জীবন-যুদ্ধে সবাই তৎপর। ঐ পরিবারের বড় ছেলে হাজরাদের কারখানায় ষ্টাফের চাকরি করে,মেজ-জন গঙ্গার ওপারে জোসেফ কারখানায় অফিসার পদে আছে,সেজ-জন এল-এম-এফ ডাক্তার। একজন তো ফুটবলার; ফুটবলে লাথি মেরে আসানসোল- দুর্গাপুর অঞ্চলের সাইকেল কারখানায় বেশ ভালো পদেই আসীন হয়েছে। শীতকালে ,ক্রিকেট খেলার মরশুমে,ওদের, আর ওদেরই কয়েকটি পরিচিত পরিবার নিয়েই এ অঞ্চলের মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ -খেলার ধুম পড়ে যায়;ওদের আসার আগে এ অঞ্চলে ফুটবলই খেলা হত ঐ মাঠে, ক্রিকেট খেলার চল এ অঞ্চলে ছিল বলে তো মনে পড়ে না,যদিও চুঁচুড়ার ডিএম-অফিসের মাঠে কখনো সখনো ক্রিকেট খেলা চোখে পড়তো।
ওদের মধ্যে ছোটো তিন ভাই, সজীব,রাজীবের সঙ্গে স্থানীয় স্কুলে পড়ছে ।সজীবের সহপাঠী, পরীক্ষায় ফেল করে,মিলিটারিতে চলে গেল;পরের দু’ভাই রাজীবের সঙ্গে স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষায় বসবে।এ বাড়িতে থেকেই ডাঃ দাদার বিয়ে হল,রাজীব-সজীব নেমতন্ন খেয়েছে;বৌদি,কোলকাতার মেয়ে;রাজীবকে খুবই স্নেহ করেন,অবশ্য ডাক্তার দাদারও স্নেহভাজন সে।
এ বাড়িতে আসার পর ,ওদের বাংলা ভাষার উচ্চারণের প্রাবল্যে গোপাল মুখুজ্জে পগার পার হয়েছ কিনা, তা না নিশ্চিত হলেও, দুর্গোৎসবের মন্ত্র উচ্চারণ ও উলুধ্বনির শব্দ-তরঙ্গ যে ব্রহ্মদৈত্য তাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল, তা নিশ্চয় করেই বলা যেতে পারে। যে বছর দুর্গা পুজো শুরু করলো,ঐ বছরই শেষের দিকে, ওদের মাতৃবিয়োগ হল।পরের বছর থেকে মাতৃ- আরাধনাও বন্ধ হল; এর কিছুদিনের মধ্যেই কর্তামশাইও গিন্নির ডাকে সাড়া দিলেন।
জমিদারী তো নেই;সংসারের ব্যয়, বৃদ্ধির পথে; সুতরাং একান্নবর্তী পরিবার থাকা মানে তো ইঞ্জনের পিছনে গাধা-বোটের সংখ্যা বৃদ্ধি,এ জ্ঞান-বৃক্ষের ফলের তাড়নায়, অতএব যে যার পরিবার নিয়ে নিজের নিজের চাকুরিস্থলে চলে গেল।
ঐ বাড়িতে এখন আছে ডাঃ দাদা, তার স্ত্রী ও তিন ভাই;একজন তো চলে গেছে মিলিটারিতে,সেও তো অবিবাহিত ।
ডাঃ দাদা,অঞ্চলের একটু দূরের কারখানার সিএমও; আবার অঞ্চলের বাজারে আছে, ডাক্তারি করার চেম্বার।
সকালে চেম্বারে বসে; নিজেই বাজার করে,চেম্বারে রেখে দেয়,অন্য ছোটভাই দের মধ্যে কেউ একজন এসে বাড়িতে নিয়ে যায়। জমিদার তনয়,তাই, অপরকে, একটু হেয় করার প্রবণতা বোধহয় জিনগত,তাই বাজারে আলু-পটল ইত্যাদি কেনার সময়,দোকানীদের
‘তুই-তোকারি’ সম্বোধন করে; দৃষ্টিকটু
হলেও কেউ প্রতিবাদ করেছে বলে শোনা যায়নি।
হঠাৎই একদিন দেখা গেল,চোঙা হাতে নিভাননীর মাসতুতো দাদা,রাস্তার তেমাথা-মোড়ে বলছেন,”সিংহের আশ্রয়ে শৃগাল বাস করে, জয় সর্বানন্দের জয়, তোমরা পাত্তা লাগাও।”
এ কথার অর্থটা ঠিক রাজীবের কাছে পরিষ্কার হল না।কে সিংহ,কেইবা শৃগাল,বড় ধাঁধায় ফেলেছেন;এ নিয়ে রাজীব ও তার বন্ধুদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলতে লাগলো।পরে জানা গেল, ওঁনাদের পাড়ার রক্ষাকালীতলার মাঠের মিটিংএ,বচসা হওয়ার ফলশ্রুতিতেই চোঙা হাতে,বিরূপাক্ষের বাবা,ঘোষ মশাই’র এ উক্তি।
তখন দেশে,কংগ্রেসি-করা লোকেদের দাপট ছিল;তারাই মিউনিসিপ্যালিটি থেকে আরম্ভ করে, স্কুল,ক্লাব,সব কিছুই পরিচালনার ক্ষেত্রে মাতব্বরি করতো, সব সরকারি,সরকারি সাহায্য-প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে তারা ছিল নৈবেদ্যের মাথার
জোড়া সন্দেশ।প্রাথমিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে তাদের বক্তব্যই শেষ কথা,তারাই সবের চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান;আর ওদের নিয়ন্ত্রক ছিল অঞ্চলের পদাধিকারী, কংগ্রেস দলের হর্তা-কর্তা বিধাতা।ঐ রকম এক নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তির আস্ফালনে তিত-বিরক্ত হয়ে বিরূপাক্ষের বাবা,’সক্রেটিসের’ ভূমিকায় নেমেছেন, জনসাধারণের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে প্রয়াসী।অবশ্য,মেজ-ছেলের মৃত্যুর পর,তাঁর মাথায় কোনো গণ্ডগোল হয়ে থাকলেও, থাকতে পারে।
অন্য একদিন, রাস্তার মোড়ে চোঙা নিয়ে বলছেন,”আলুওয়ালা ‘নন্দীর’ আয় অনেকের চেয়ে কম নয়,সম্বোধনে,’তুই ‘
থেকে তুমিতে এস, নিজেকে শোধরাও,কাজের ক্ষেত্রে কেউ বড় ছোট নয়”।
কংগ্রেসি-করা রাজনীতির
কারবারিরা তো ‘বারোয়ারি ভাই-ফোঁটা’
এড়াবে না,জন-সংযোগ কি না বলতে পারবো না,তবে প্রতি ‘ফোঁটার’ দিন ওদের উপস্থিতি ও আগ্রহ চোখে পড়ার মত;এ হট্টগোলে তারা সাগ্রহে অংশ গ্রহন করে।বিভিন্ন স্কুলের পরিচালন-কমিটির নির্বাচনে,রমার মাষ্টার মশাই ‘র নাম ,শিক্ষানুরাগীদের তালিকাভুক্ত। রমা,স্কুল-ফাইন্যাল উত্তীর্ণ নয়,তাই চক্ষু-লজ্জার খাতিরে হয়তো তার নামটা তুলতে পারেনি।