বাঙালির পুরনো কাসুন্দি – উষ্ণিক ভট্টাচার্য (জি.এন.আই.এইচ.এম.)

বাঙালির পুরনো কাসুন্দি
কাসুন্দি বাঙালির এক চিরকালীন ঐতিহ্য। রান্না ও স্বাদের জগতে বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কিন্তু বাঙালির কাছে কাসুন্দি প্রস্তুতি শুধুমাত্র একটা খাবার বানানো ছিল না, অদ্ভুত সরল দার্শনিকতা ও ঐশী ভাবনা জড়িয়ে ছিল আষ্টেপৃষ্টে। আগেকার দিনে ঠাকুমা দিদিমা-রা অনেক নিয়মনীতি মেনে শুদ্ধাচারে বৈশাখ মাসের অক্ষয় তৃতীয়ার দিন কাসুন্দি তৈরিতে হাত দিতেন। বহু পরিবারে এক্ষেত্রে বেশ গোঁড়ামি ছিল। শুদ্ধাচারী নারী যাবতীয় প্রস্তুতি সারতেন, আর পুরুষ শুদ্ধাচারে এটি নিজের হাতে প্রস্তুত করতেন। এমনকি সর্ষে ধোয়ারও নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল। বিবাহিত মহিলারা বিজোড় সংখ্যায় স্নান সেরে ভেজা কাপড় পরে পূর্ব দিকে মুখ করে নদী বা পুকুরে সর্ষে ধুতেন। তারপর তা ছেঁকে নেওয়া হতো পুরুষের কাচা ধুতি কাপড়ে। ধোয়ার সময় মহিলারা মঙ্গল গীত বা শুভ গান গাইতেন এবং সম্পদ, স্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করতেন। অন্যান্য ধর্মীয় নৈবেদ্যের মতো, এ যেন সর্ষেকে ক্ষেত থেকে ঘরে ফিরিয়ে আনা, সাথে সাথে জয়ধ্বনি করা হতো এবং দেবতাদের কাছে উৎসর্গ করার পর, ঘি ভর্তি প্রদীপ জ্বালানো হতো। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো উৎকৃষ্ট রাই সরিষা। সেই সঙ্গে দেবতার উদ্দেশ্যে দেওয়া হতো পাঁচ ফল, পান, সুপারি, দূর্বা ইত্যাদি। তৈরির পরে সেই কাসুন্দি সযত্নে সংরক্ষণ হতো মাটির মুখ ঢাকা পাত্রে। শুদ্ধ পোশাক না পরে সেখানে হাত দেওয়ায় ছিল নিষেধাজ্ঞা।
আমাদের আজকের দৃষ্টিতে দেখলে কাসুন্দি মূলত একটি সরিষার সস, যা সরিষার বীজ গাঁজন করে তৈরি করা হয়। এই সস বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। কাসুন্দি সাধারণত বাঙালি খাবার যেমন – মাছ ভাজা, কাটলেট এবং সবজি চপের সাথে পরিবেশন করা হয়। এটি একটি জনপ্রিয় বাঙালি খাদ্য এবং বিভিন্ন ভাবে উপভোগ করা যায়।
কাসুন্দির প্রকারভেদ:
ঝাল কাসুন্দি:
এটি সবচেয়ে সাধারণ প্রকারের কাসুন্দি, যা ঝাল স্বাদের জন্য পরিচিত।
ফুল কাসুন্দি:
এই ধরনের কাসুন্দি তৈরি করতে বেগুন, টমেটো, এবং অন্যান্য সবজি ব্যবহার করা হয়।
টমেটো কাসুন্দি:
টমেটো দিয়ে তৈরি কাসুন্দি, যা একরকম ভিন্ন স্বাদ দিয়ে থাকে।
আম কাসুন্দি:
সবুজ আম ব্যবহার করে তৈরি কাসুন্দি, যা বিশেষত গ্রীষ্মকালে পাওয়া যায়।
সাদা কাসুন্দি:
সর্ষের দানা, কাঁচা লঙ্কা, হলুদ, নুন এবং তেল ব্যবহার করে তৈরি করা হয়।
লাল কাসুন্দি:
শুকনো লাল লঙ্কা ব্যবহার করে তৈরি, যা ঝাল এবং আকর্ষণীয় স্বাদ দেয়।
মিষ্টি কাসুন্দি:
খেজুরের গুড় ব্যবহার করে তৈরি করা হয়।
আম কাসুন্দির উপকরণ :
১ কাপ কালো সর্ষে
১ কাপ সাদা সর্ষে
২ কাপ কাঁচা আম
৮-১০টি কাঁচা লঙ্কা
১ টেবিল চামচ আদা কুচি
আধ কাপ সর্ষের তেল
পরিমাণ মতো নুন
১ টেবিল চামচ মৌরি
আধ চা চামচ গুঁড়ো হলুদ
১ টেবিল চামচ ভিনিগার
এক চিমটে হিং
আম কাসুন্দি প্রস্তুতি প্রণালী :
১. প্রথমে আমের খোসা ছাড়িয়ে ছোট টুকরো করে রাখুন। কুসি থাকলে বাদ দিয়ে দিন।
২. এ বার মিক্সিতে আগেই ধুয়ে শুকিয়ে রাখা দু’ধরনের সর্ষে এবং মৌরি দিয়ে ভাল করে গুঁড়ো করে নিতে হবে। এই সময়ে কিন্তু জল দেওয়া যাবে না। তা হলেই কাসুন্দি তিতকুটে হয়ে যাবে।
৩. সর্ষে গুঁড়ো হলে গেলে তার মধ্যে কাঁচা আমের টুকরো, আদা এবং কাঁচা লঙ্কা একসঙ্গে দিয়ে পেস্ট করে নিন। নুন এবং সামান্য জল দেওয়া যেতে পারে।
৪. সমস্ত উপকরণ ভাল করে পেস্ট করে নেওয়ার পর মিক্সির ঢাকনা খুলে তার মধ্যে গুঁড়ো হলুদ এবং ভিনিগার দিয়ে দিন। আরও এক বার ভাল করে মিশিয়ে নিন।
৫. এ বার কড়াইতে সর্ষের তেল গরম করতে দিন। হালকা গরম হতে শুরু করলে তেলের মধ্যে সামান্য হিং দিয়ে দিন।
৬. সামান্য নাড়াচাড়া করে নিয়ে পেস্ট করে রাখা আম-সর্ষের মিশ্রণ ওই তেলের মধ্যে দিয়ে দিন। একেবারে ঢিমে আঁচে মিনিট দুয়েক নাড়াচাড়া করুন।
৭. খুব বেশি সময় এই মিশ্রণ আগুনের আঁচে রাখার প্রয়োজন নেই। তা হলে কাসুন্দির স্বাদ-গন্ধ-বর্ণ বদলে যেতে পারে।
৮. নাড়তে নাড়তে খেয়াল করবেন ওই মিশ্রণের আশপাশে আলাদা করে কোনও তেল নেই। সর্ষে বাটার মিশ্রণের সঙ্গে পুরোপুরি তেল মিশে গেলেই বুঝতে পারবেন, কাসুন্দি তৈরি। এ বার পরিষ্কার, কাচের বায়ুরোধী পাত্রের মধ্যে কাসুন্দি ভরে কয়েকটা দিন রোদে দিলেই তা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।
কাসুন্দির উপকারিতা :
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়:
কাসুন্দিতে থাকা পটাশিয়াম হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক রাখতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
হাড় ও দাঁত মজবুত করে:
সরিষার দানায় থাকা ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁতের গঠন মজবুত করে এবং বিভিন্ন রোগের সম্ভাবনা কমায়।
হজমশক্তি বাড়ায়:
সরিষার ম্যাগনেসিয়াম হজম প্রক্রিয়াকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
ফুসফুসের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে:
আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী, সরিষার গুণে ফুসফুসের জটিলতা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:
কাসুন্দিতে থাকা ভিটামিন এবং খনিজগুলি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
ত্বকের জন্য উপকারী:
কাসুন্দিতে থাকা ভিটামিন ই ত্বককে সুস্থ ও উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে:
পটাশিয়াম সমৃদ্ধ কাসুন্দি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা করোনারি হৃদরোগের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে:
কাসুন্দিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।