হৈচৈ ছোটদের গল্পে তপন তরফদার

ক্ষতচিহ্ন

     জয়ন্তর মুখে এক বিশ্রী ক্ষতচিহ্ন জ্বলজ্বল  করে। সারা জীবন ধরে জ্বলছে ওর জীবন। ঔই ক্ষতচিহ্নর ইতিহাস  সাধারণেরা জানেনা। আদ্রা,রেল কলোনিতে  জন্ম জয়ন্তর। আদ্রা বয়েজ স্কুলে পড়াশুনা। জয়ন্তের সহপাঠী অনেকেই। কিন্তু সবারই একজন প্রাণের বন্ধু থাকে। জয়ন্তের প্রাণের বন্ধুর নাম বরুণ বিশ্বাস। বরুণরা খ্রিষ্টান। বরুণের আসল নাম ব্রায়ান এই বাঙালি পরিবেশে ঘরের লোকেরা ও ব্রায়ান বলে ডাকে না, বলে বরুণ। খ্রীষ্টান বলতেই আমাদের চোখের সামনে মাদার টেরিজার মুখ বা যীশু খ্রীষ্টের, মেরির ছবি, ভেসে উঠে। ওরা কিন্তু  সাধারণ হিন্দুদের পোশাক পরে। বরুণরা আমাদের মতই ডাঁটা চচ্চড়ি খায়। তবে ওই রববার রববার সেইন্ট অ্যাগনেস গির্জায় যায়। ২৫ শে ডিসেম্বর সবাইকে ডেকে কেক খাওয়ায়, আবার ২৫ শে বৈশাখ, ওদের রেলের টাইপ টু কোয়ার্টারের সামনে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো রবীন্দ্রনাথের ছবিতে রজনীগন্ধার মালা দিয়ে  রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজায়। পাড়ায় বরুণদের পরিবারের সবাইকেই ভাল মানুষ বলেই মনে করে। বরুণকেও করে, সেই তুলনায় জয়ন্তত র পাড়ায় ডানপিটে নামে পরিচিত, পাখির বাসা থেকে ডিম চুরি করে এনে ওমলেট করবে সেই প্ল্যানটা কিভাবে যে সবাই জেনে যায়, কে জানে। সেই থেকে কপালে একটা দুষ্টু ছেলের ছাপ পড়ে যায়।
ওই ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠবে। গরমকাল মর্নিং স্কুল। যতই মর্নিং স্কুল হোক, ছুটিতো দিতেই হবে। সেই বেলা এগারোটার পরে স্কুল থেকে ফিরছে। ঝিমমারা চরাচর। গাছের পাতা একটুও নড়ছে না। মধ্যাহ্ন অথচ চারদিকে নিশুতির নিস্তব্ধতা। নির্জন নিরালায় ফিফথ এভিনিউয়ের পাঁচ বাই তিন নং বাংলোর বুক সমান পাঁচিল ভেদ করে অম্রপালী আম গাছটার থেকে কাঁচা আমগুলো হাতের ইশারায় ডাকছে। বরুণ বলে এই সময়ে কাঁচা মিঠে আম খেলে রোদ গায়ে লাগে না। জয়ন্ত বলে না বাবা ওই পাঁচিলের উপর লোহার দন্ড দিয়ে পোক্ত রডে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তারকাঁটা দেওয়া আছে। ওরা আমাকেই দন্ড দিয়ে দেবে। বরুণ বলে-দুৎ অত ভয় পেলে চলে। ভীতুরাই ভয়ে ভয়ে মরে। ভয় পেলে ভবিষ্যত জীবনটাও অন্ধকার। জয়ন্তর মনে এক ধাক্কা লাগে, সত্যি কথা, ভয় পেলে জয় করা যায় না। স্কুলের ব্যাগ পাঁচিলের পাশে রেখে জয়ন্ত পাঁচিলে ওঠে। বরুণও পাঁচিলে ওঠে বলে আমি তার কাঁটাটা ফাঁক করে ধরছি তুই গলে যা, বেশি না কয়েকটা আম হলেই চলবে। জয়ন্ত মাথা গলাল। বরুণ শক্ত করে কাঁটা তার দুটো ফাঁক করে দিল। বিড়ালের মত লাফ দিয়ে নেমে পটাপট হনুমানের ক্ষিপ্রতায় আম পাড়তে লাগল। নিস্তব্ধ পরিবেশকে খান খান করে দিল ঘেউ ঘেউ আওয়াজ। কোথা থেকে ইয়া তাগড়া বুলডগ ছুটে আসল। জয়ন্ত লাফিয়ে পাঁচিলে চলে এসেছে। কিন্তু বুলডগটা লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বাঁ গালে এক থাবা বসাল। বরুন পাঁচিল থেকে কাঁটা তার ফাঁক করে জয়ন্তর হাত ধরে টানে। তাড়াহুড়োতে বরুণের হাত ফসকে য। ছুরির মত তীক্ষ্ণ কাঁটা তারের শলাকা জয়ন্তর বাঁ গালে চেপে বসে। যত ছাড়াতে যায় তত চেপে বসে। বরুণ দুহাত দিয়ে হ্যাঁচকা মেরে ছাড়াতে সফল হয়। সামান্য চামড়া সহ কাঁচা মাংস কাঁটা তারের কাঁটায় আটকে ঝুলতে থাকে। জয়ন্তর মুখ রক্ত ভেসে যাচ্ছে। হাতে ধরা একটা আম, কি করে উপরের কাঁটা তারের মাঝখানে আটকে গেছে। আমটা ঝুলছে, চন্দন রঙের চামড়াটাও ঝুলছে। চারদিক থেকে কাকরা কা কা করে ছুটে আসছে। বরুণ জয়ন্তর হাত ধরে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে প্রানপণে দৌড়ে পালায় ফিফথ এভিনিউর রাস্তা ধরে।
রক্ত এখন মুখ থেকে সারা শরীরে। রুমাল ভিজে লাল শালু হয়ে গেছে। স্কুলের সাদা সার্টেও রক্তের ছোপ। জয়ন্ত বলে-অনেকটা কেটে গেছে। হাসপাতালে যেতে হবে। বরুণও বলে চ রেলের হাসপাতালে যাই। বলবি রাস্তায় হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে বোল্ডারের উপর পড়ে গেছিস।
হাসপাতালের আউটডোরে কম্পাউন্ডার বিধান কাকু ডিউটিতে। বিধান কাকুকে ওরা চেনে, ভাল বেহালা বাজান। বিধান বাবুও জয়ন্ত, বরুণকে চেনে। বরুণ বলে স্কুল থেকে ফেরার সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে। বিধান কাকু বলে এতো অনেকটা কেটে গেছে। এখানেতো সেলাইও করা যাবে না। বিধান কাকু একটা ইঞ্জেকশান দিতে চায়। জয়ন্ত নিতে চায় না। জোর করে ওকে দিয়ে দেয়।যত্ন করে ওষুধ লাগিয়ে পাট্টি বেঁধে দিয়ে বলে, জল যেন না লাগে। বাড়িতে মা-বাবা একটু বকাবকি করে। কাজের মাসি শোভা বলে অমন টুকটুকে গালটাই বরবাদ হয়ে গেল। গালেই লাগালি-সাবধানে থাকবি। দুদিন বাদে ব্যান্ডেজ খুলে দেখা গেল মাংসে ফাঁঙ্গাস ধরেছে। বিধান কাকু বলে এখনি ডাক্তারের কাছে চ আমার দ্বারা হবে না। ভাগ্যিস টিটেনাস ইঞ্জেকশানটা জোর করে দিয়েছিলাম। ডাক্তার বলে জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন করাতে হবে।
জয়ন্তর ক্ষতের অপারেশন হল, ঘা সেরে গেল। কিন্তু এক বিচ্ছিরি দাগ, যা  চামড়াটাকে কুঁচকে দিয়েছে। আধ খাওয়া আপেলের মত দাগ মুখে থেকে গেল। জয়ন্তর পরিচয় হল দাগি জয়ন্ত।
জয়ন্ত এখন প্রতিষ্ঠিত প্রফেসর। প্রাণ মন দিয়ে পড়ায়। কলেজের ছেলেমেয়েরা কিন্তু সবসময় জয়ন্তর খুঁত ধরতে সচেষ্ট। মানুষের মনে ওই প্রবাদটা ভাল ভাবেই কাজ করে-যাকে দেখতে নারি, তার চরণ বেঁকা। কথায় কথায় নিজেদের ভিতর টিটকিরি দেয় বলে-দাগি প্রফেসার। বরুণ এখন কোন এক নামকরা চার্চের পাদ্রী। ছোটবেলার দুষ্টু বরুণ এখন শান্তশিষ্ট অনুকরণীয় মানুষ। সবাই শ্রদ্ধা করে ভালোবাসে। ওদিকে জয়ন্তর সারাজীবন ধরে আপশোস করে যায়। অবচেতন মনে এখনও ভেবে পায়না কেন সেদিন বরুণের কথায় রাজি হয়ে আম চুরি করতে গিয়েছিল।
তপন  তরফদার।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *