হৈচৈ ছোটদের গল্পে তপন তরফদার

পয়া পায়রা
প্রভাত আর আমি দুজনেই আধমাইল দূরের মহেন্দ্র বিদ্যাপিঠে পড়তে যাই। যাতায়াতের পথে দুজনে ধরে চলতে চলতে অনেক কথা হয় – কোন বাগান কি পেড়ে খাওয়া যায় এই সব। কিন্তু সুখ কারো কপালে চিরস্থায়ী হয় না! আমাদের ও হল না। সমিতির মাতব্বরা জেনে গেছে আমাদের দৌড়ত্বের কথা। যেখানে যা কিছু পাকড় চুরি হয় সবাই আমাদের নামে চালিয়ে দেয়। অগ্যতা আমাদের আরো চোখে চোখে রাখা হল। আমারা যেন কোনো বাগান অভিযানে জড়িয়ে না পড়ি।
দুজনেই মন মরা হয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরি। ডাঁসা পেয়ারা গুলো বাগানের ধারেই ঝুলছে। শুধু একটু লাফ দিয়ে পাড়লেই কেল্লা ফতে। কিন্তু না, আমারা আমাদের বদনাম ঘোচাবই। নাক মুলছি, কান মুলছি, ও পথে আমারা নেই। পাখিদের ও খিদে পায়, পাখিরা খেয়ে পড়ে বাঁচুক আমাদের গান শোনাক। রাস্তায় দুটো কুকুরের বাচ্চা কখন যে আমাদের পিছু নিয়েছে জানতে পারিনি। গুটি গুটি পায়ে আসছে। আমি তু- তু- করে ডাকতে লেজটা নাড়িয়ে একেবারে আমার হাতের নাগালে চলে আসে। প্রভাত বলে, দেখ কী সুন্দর কালো ড়রা কাটা, এক্কেবারে বাঘের বাচ্চা। আমি বলি, দেখ যমজ ওরা, দুজনেরই সব কিছু একই রকমের। দুজনে দুটোকে কোলে তুলে নিলাম। কোলে উঠে কুঁই কুঁই করছে। আমারা ওদেরকে নিয়ে আসলাম। দুই বাড়িতেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ পছন্দ করে, কেউ কেউ পছন্দ করে না। আমাদের বাড়িতে বাবা মা পছন্দ করে না। কোথায় কখন কামড়ে দেবে, তখন কি হবে। দাদু শুধু বলে, থাকনা অবলা জীব, গেটের সামনে থাকবে চোর টোর ওকে দেখে ভয় পাবে। বাবা হেসে উঠে বলে চোরের থেকে ট্রেনিং নেবে চোর ধরার। বাবার রাখ তখনও আমার উপরে। বাবাকে অনেকে বলেছিল তোমার ছেলে ফল চোর সেই অপমান ভুলতে পারেনি।
এক সপ্তাহ চলল মনের আনন্দে, কোন গন্ডগোল নেই। আমি ভুলুকে অনেক কসরত শেখাতে আরম্ভ করলাম। বল ছুঁড়ে দিলে একবারে অনুগত ফিল্ডারের মত বল মুখে করে এনে ফেরত দিতে লাগল। কিন্তু ওই সুখ চিরদিন স্থায়ী হয় না। ভুলু একদিন তুলসী মঞ্জেই তিন পায়ে ভর করে একটা ঠ্যাং তুলে চিহ্ন এঁকে দিচ্ছিল। ঠাকুমার জেরে পড়তেই লাঠি নিয়ে তেড়ে গিয়ে বলে তোর ভুলুকে এক্ষুনি তাড়া। আমার তুলসী মঞ্চকে অপবিত্র করে দিল। আমি যত বোঝাই ভুলু, ভুল করেছে। কুকুরা গন্ধ শুকে ওদের জায়গা ঠিক করে নেয়। ওই চিহ্ন দিয়ে দিয়েছে। ঠাকুমা আরো রেগে গিয়ে বলে, তোর চিহ্নর নিকুচি করেছে, আজই ওকে বিদায় কর। দাদু আমার দলে না থেকে দলবদল করে ঠাকুমার নাম লিখল। ভুলুর এবাড়ি থেকে ছুটি হয়ে গেল।
ওদিকে আমার বন্ধু প্রভাতের বাড়িতে ও লালুর ছুটি হয়ে গেলে অনবরত ঘেউ ঘেউ করার জন্য। আসলে আমি যেমন ট্রেনিং দিয়ে ভদ্রস্থ করেছিলাম ও করতে পারেনি, তাই অকারণে চোর ধরতে গিয়ে লালুকেই বিতাড়িত হতে হল। লালু ভুলু আমাদের স্কুলের নৈশ্য পঞ্চুকাকুর সহকারী পাহারাদার হয়ে গেল।
দুজনে স্কুল থেকে ফেরার পথে বোসদের পুকুর ঘাটে বসে মনের দুঃখে খোলাম কুচি ছুঁড়ে ছুড়ে ব্যাঙাচি খেলছি। কার খেলাম কুচি জলের উপরে চিৎসাঁতার কেটে কতদূর যায়। এই সময়েই দেখি দুটো বিড়াল বাচ্চা কচি পায়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে জল দেখে থমকে যায়। বিড়াল দুটো চুপ করে বসে পড়ে। প্রভাত বলে যখন আমাদের কপালে কুকুর সইল না, চল আমরা বিড়াল পুষি।
আমাদের বিড়ালটার নাম হলো ‘ধলো’ সাদা লোম বলে। প্রভাতের বিড়ালের নাম ‘কেলো’ কালো লোম বলে। পাঁজা কোলা করে বিড়ালটাকে এনে গেটের বাইরে ছেড়ে দিই। বিড়ালটা সুড়সুড় করে বাড়িতে ঢুকে যায়। কেউ খেয়াল করে না। এই ভাবে বিড়াল ছানা বড়ো হতে থাকে, কিন্তু পোষ মানানো যায় না। যখন ইচ্ছা আসে খেয়ে দেয়ে আবার কোথায় চলে যায়, কে জানে! তবে কালো সাপকে থাবা মেরে জব্দ করার জন্য খুব সুনাম ছড়িয়েছে ওই বোস বাড়িতে।
স্কুলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিরাট এক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে জেলা শাসক এসে কয়েকটা বেলুন আর পায়রা আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, পায়রারা শান্তির দূত। ওরা অনেক সময় রাজা রাজাদের চিঠি বয়ে নিয়ে যেত। আরও অনেক অনেক কথা বললো আর কোন কথা মাথায় ঢুকলো না আমাদের। আমরা চোখের ইশারায় হাত দিয়ে বুঝিয়ে দিই এবার থেকে পায়রা পুষবো কিন্তু পাব কি করে। প্রভাত বলে আমাদের স্কুলের সরস্বতী পুজোর দালানে অনেক পায়রা থাকে। স্কুলের পাহারাদার পঞ্চুকাকুে বলে যদি দুটি পাওয়া যেত। পঞ্চুকাকাকে বলতে বলে শনিবার স্কুল ছুটি হওয়ার পর সবাই চলে গেলে তোদেরকে দেব। কিন্তু ভালো করে পুষবি। আমি সব শিখিয়ে দেব।
পঞ্চুকাকু দুটি পায়রা দুজনকে দিল, তবে পায়রা গুলোর এক পায়ে লাল সুতো বাঁধা। পায়রা দুটো দিয়ে বলে প্রথম প্রথম যাতে উড়ে না যায় তাই বেঁধে দিলাম। কিছু গম দানা ছড়িয়ে দিলেই ওরা খুঁটে খুঁটে খেয়ে নেবে। এক সপ্তাহে পোষ মেনে যাবে। দুজনেই বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঠিক করি চিলে কোঠার ঘরে একটা প্যাকিং বাক্সের ভিতর রাখবো। প্রতি শনি রবিবার বিকালে পায়রাটা এখানে নিয়ে আসব পঞ্চুকাকু ট্রেনিং দিয়ে দেবেন। পায়রা পোষ মেনে যাবে।
পঞ্চুকাকু পায়রা সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন বলে, পায়রার বৈজ্ঞানিক নাম কলম্বিয়া লেভিয়া ডোমেস্টিক ভালো ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ওদের চোখের পালক পরার সঙ্গে সঙ্গে চোখের তলায় পরিবর্তন হয়।যাদের ছোট কালো দাগ থাকে তারা রাতেও দেখতে পায়। তোদেরকে ভালো জাতের পায়রা দিয়েছি।
পায়রাটা হাতে নিয়ে পালকগুলো আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দিয়ে পালকের কারুকার্য গুলো দেখিয়ে বলে কি সুন্দর ডিজাইন দেখছিস, পায়রার নখ দেখিয়ে বলে কি সুন্দর পরিস্কার দেখছিস। এরা অনেকক্ষণ উড়তে পারে। পায়রাটা উড়িয়ে দিয়ে পঞ্চুকাকু মুখে শিষ দিতে লাগল। পায়রা দুটো গোল হয়ে উড়তে লাগল আবার শিষ দিল। পায়রা দুটো দু’কাঁধে বসল। আমার হাতে গমের দানা দিয়ে বলে ডাক ওদের খেতে – পায়রা দুটো আমাদের হাত থেকে দানা খেল। কয়েক সপ্তাহ ট্রেনিং দিয়ে পঞ্চুকাকা বলে তোরা পায়রা বদলা বদলি করে নিয়ে যা দেখবি রাতে নিজরাই যে যার ঘরে চলে আসবে।
কয়েক মাস হয়ে গেল আমরা দুজনেই খুশি। রাতের বেলায় পায়রা আমাদের পড়ার টেবিলেই রাত কাটায়।
শীতটা চলে যাবে এই সময়েই গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমাদের সদর দরজায় করা নাড়িয়ে কয়েক জন বলছে, ডাক্তারবাবু দরজা খুলুন আমাদের সঙ্গে রোগী আছে, একটু দেখে দিতে হবে। দাদু ভালো মনে আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলে দিতেই – ছয় সাত জন লোক দাদুর হাত পা বেঁধে ফেলে। বাবা নিচে, বাবাকে বেঁধে ফেলে। একজন মা আর ঠাকুমার গলায় ছুরি ধরে বলে চিৎকার করলেই খুন করে দেব। কোথায়, সিন্দুকের চাবি কোথায়? আমরা জানি অনেক সোনা দানা আছে তোদের বের কর দে সব। কেউ উল্টো পাল্টা কিছু করলেই রামদা চালিয়ে দেব। সর্দার বলে চিৎকার করেও কিছু হবে না। আশে পাশে কোন বাড়ি নেই। কেউ এগিয়ে আসবে না।
আমি চুপচাপ আমার ঘরে ঢুকে প্রভাতকে একটা চিঠি লিখলাম। আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, তোরা সবাই মিলে আমাদের বাঁচা। চিঠিটা পায়রার পায়ে বেঁধে দিয়ে পায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিলাম।
ডাকাতদল কিছু বোঝার আগেই প্রভাতদের বাড়ির সবাই। সঙ্গে আশেপাশের লোকজন, প্রত্যেকেই হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে চলে এসেছে। সব পিঠমোরা করে বেঁধে প্রভাতের ছোটকাকা সাইকেল নিয়ে থানায় খবর দিতে গেল।
আমার আর প্রভাতের কাঁধে বসে পায়রাগুলো বক বকম করেই চলেছিল। কখন ঘুমিয়েছিলো এখনও মনে করতে পারছি না।