ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (অন্তিম পর্ব)

পরিশিষ্ট

বহুদিন যখন একটি প্রবন্ধ লেখকের সঙ্গে পথ চলে এবং সেই যাত্রায় সঙ্গী হয় ভারতীয় শাস্ত্রীয় বা মার্গ সঙ্গীতের অসাধারণ সব শিল্পীরা, তখন সেই যাত্রার রসাস্বাদন, এনে দেয় এক অনন্য আনন্দ। একদিন শেষ হয় সেই লেখা, কিন্তু মন বলে “শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে”। দেখতে দেখতে পঞ্চাশটি পর্ব পেরিয়ে চলে এলাম আলাপের পরিশিষ্টে। সবচেয়ে দুঃখের কথা হল গত দু তিন বছরে, অতিমারীতে আমরা হারিয়েছি বহু মানুষকে, এবং সবচেয়ে বেশী ক্ষতি বোধহয় হয়েছে সঙ্গীত জগতের। আমরা হারিয়েছি বেশ কিছু নক্ষত্রসম শিল্পীকে। তার মধ্যে বেশ কয়েকজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী। আমরা হারিয়েছি পন্ডিত যশরাজ, পন্ডিত রাজন মিশ্র, তবলিয়া পন্ডিত শুভংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকরজী এবং গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং আরো বেশ কয়েকজনকে। বাকীদের সম্বন্ধে আলাপের পাতায় আগেই লিখেছি। কেন লতাজী এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কথা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে আলোচনা করছি তা তাঁদের শিক্ষা এবং সঙ্গীতই বলে দেবে। এঁদের মধ্যে সব শেষে হারিয়েছি গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। তাই পরিশিষ্টে তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা নিয়ে দু চারটি কথা না লিখলে আলাপ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

১৯৩১ সালে কলকাতার ঢাকুরিয়া অঞ্চলে সন্ধ্যা মুখার্জীর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে ছিল গান বাজনার পরিবেশ। পিতামহ এবং বাবা দুজনেই ভক্তিসঙ্গীত গাইতেন। বাড়িতে গজল, ভজন ইত্যাদি নানা ধরণের গানের চর্চা ছিল। খুব ছোটবেলাতেই সন্ধ্যা মুখার্জী মন্দিরে এবং পাড়ায় বাবার সঙ্গে ভক্তিসঙ্গীত গাইতেন। গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ দেখে তাঁকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষার জন্য প্রথমে শ্রদ্ধেয় যামিনী গাঙ্গুলীর কাছে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সেখানে ছয় বৎসর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা করেন তিনি। এ ছাড়া ভজন ও ভক্তিসঙ্গীত শিখতেন আশু মল্লিকের কাছে। এই সময় অল বেঙ্গল মিউসিক কম্পিটিশনে ভজনে নাম দেন, যেখানে বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় আলাউদ্দীন খান সাহেব, দবীর খান সাহেব এবং রবীন্দ্র পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান পান ও গীতশ্রী উপাধি লাভ করেন।

এরপর পন্ডিত চিন্ময় লাহিড়ী এবং এ টি কাননের কাছেও তিনি অল্প কিছুদিন শেখেন।

সেই সময় বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান কলকাতায় বসবাস করছেন। সন্ধ্যা তাঁর কাছে শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন তাঁর দাদা শ্রী রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় শ্রদ্ধেয় গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। খান সাহেব তখন শ্রী ঘোষের ডিক্সন লেনের বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন। গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের অনুরোধে উস্তাদজী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে শেখাতে রাজী হন। এরপর দাদার সঙ্গে সন্ধ্যা গান্ডা বাঁধার সামগ্রী নিয়ে গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়িতে যান। সেখানে হাতে একটি লাল সুতো বেঁধে এবং ছোলা গুড় মুখে দিয়ে তাঁকে গান্ডাবদ্ধ শিষ্য করে নেন বড়ে গুলাম সাহেব। তারপর তাঁকে গান শোনাতে বলেন উস্তাদজী। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় খুব ভয় পেয়ে যান। কিন্তু হেসে তাঁকে অভয় দেন উস্তাদজী। অবশেষে তিনি রাগ জৌনপুরী শোনান। সেদিনই সেই রাগের ওপরই তাঁর তালিম শুরু হয়।

শুরু হয় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে পথ চলা, পাতিয়ালা ঘরানার নতুন ধারা অনুযায়ী। তিনি নিজেই একটি ইন্টারভিউতে বলেছেন যে উস্তাদজীর কাছে তিনি, মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়, উস্তাদজীর পুত্র মুনাবর আলি খান সাহেব সবাই একসাথে শিখতেন। উস্তাদজী ছিলেন কঠোর শিক্ষক। তিনি বলতেন “দেখো বেটা, এক ভাগ গানা ঔর তিন ভাগ শুননা। জো এক সাধে উয়ো সব সাধে” অর্থাৎ গান শুনতে হবে বেশী, গাইতে হবে কম। একটি রাগ যদি সম্পূর্ণ ঠিক ভাবে শেখা ও গাওয়া যায়, তবে সব রাগই গাওয়া যাবে। উস্তাদজী নিজে রেডিওতে লঘু গান শুনতেন না। সিনেমা থিয়েটার দেখা ঘোর অপছন্দ করতেন। তাঁর প্রিয় ছিল খাওয়া দাওয়া, খেলাধুলো। তাঁর ভিতরে এক ছেলেমানুষ সত্তা ছিল। কিন্তু সন্ধ্যা মুখার্জী নিজেই স্বীকার করেছেন যে সেই কম বয়সে একেবারে অন্যরকম পাতিয়ালা ঘরানার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতে তাঁর বেশ অসুবিধা হয়েছিল। সেই সময় উস্তাদজীর গানের গায়কী, চরিত্র, গুরুত্ব, স্বরক্ষেপণের নিপুণতা, বোঝার বা রসাস্বাদন করার কান বা বোধ তাঁর তৈরী হয়নি। অনেক স্নেহে ও যত্নে উস্তাদজী ধৈর্য ধরে তাঁকে শেখাতেন। কিন্তু আগে অন্য আঙ্গিকে বা ঘরানায় গান শেখায় তাই পাতিয়ালা ঘরানার গায়কী আত্মস্থ করে সঠিক ভাবে গাইতে তাঁর অনেক সময় লেগেছিল। তিনি মজা করে গল্প করেছেন যে তিনি এবং মীরা বন্দ্যোপাধ্যায় অধৈর্য হয়ে থাকতেন। তাঁরা উস্তাদজীকে বাবা ডাকতেন। বাবা একটি বিস্তার করলেই তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে সেটি অনুকরণ করার চেষ্টা করতেন। হাসতে হাসতে বাবা বলতেন “দো বিল্লি বৈঠি হ্যায়, হাঁ করতেহি সব কুছ খা যায়েগী! পহেলে পাঁচ সাত বার শুন লো, ফির কোশিশ করো!” এইভাবে একেবারে ধরে ধরে শিক্ষা পেয়েছেন। সকাল বেলা দশটা এগারোটা থেকে তাঁর শিক্ষা শুরু হত এবং রাত্রি আটটা, নটা অবধি চলত। মাঝে দুপুরের খাওয়া উস্তাদজীর বাড়িতেই খেতেন। উস্তাদজীর আতিথেয়তা ছিল উদাহরণযোগ্য। বড়ে গুলামের স্ত্রীকে তাঁরা মা ডাকতেন। তিনি অসাধারণ রান্না করতেন বিরিয়ানী, কাবাব, ফিরনি এবং নানা নিরামিষ পদ। সব ছাত্রছাত্রীরা তাই খেত। সেই সময় সন্ধ্যা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উস্তাদজী ও তাঁর ভাই বরকত আলি খানের গান শুনতেন এবং বহু শুনে তাঁর গায়কী সন্ধ্যা মুখার্জীর চেতনার গভীরে প্রবেশ করে এবং সন্ধ্যার নিজের গায়কীতে সেই সুর অক্ষয় হয়ে ছিল।

সন্ধ্যা নিজেই স্বীকার করেছেন, যে উস্তাদজীর মৃত্যুর পর, তাঁর সুযোগ্য পুত্র মুনাবর আলি, যাকে তিনি ভাইয়া বলে ডাকতেন, তাঁর কাছে যখন শিখতে শুরু করেন, ততদিনে তিনি পাতিয়ালা ঘরানার গায়কী, হড়ক, মুড়কী প্রভৃতি আয়ত্ত করতে সমর্থ হন। তবে বড়ে গুলাম আলি খানের কাছে শেখা জৌনপুরী, মালকোষ, গাউতি, জয়জয়ন্তী, ইমন, গুণকেলী, কোমল আশাবরী, বাগেশ্রী, রাগেশ্রী, গুর্জরী টোড়ি, কৌশিক ধ্বনি এবং কিছু ঠুংরী সন্ধ্যার অমূল্য সম্পদ ছিল বলে তিনি বলেছেন।

এরপর রেডিওতে নিয়মিত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়া ভারতের নানা নামী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশন করতে শুরু করেন, যেমন অল বেঙ্গল মিউসিক কনফারেন্স, উত্তরপাড়া সঙ্গীত সম্মেলন, ডোভার লেন মিউসিক কনফারেন্স, এমনকি তানসেন সঙ্গীত সমারোহ। পরবর্তী কালে উস্তাদজীর বিখ্যাত ঠুংরীগুলির বাংলা রূপ গেয়ে রেকর্ড করেন সন্ধ্যা, যেমন “প্রেমকি মার কাটার” অবলম্বনে “প্রেম যে কাঁদে রাধার”, কিংবা “ক্যা করু সজনী আয়ে না বালম” অবলম্বনে “কী করি সজনী, আসে না প্রীতম” ইত্যাদি। এর প্রতিটি গানই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়।

আমার বেশ কয়েকবার রেডিওতে সন্ধ্যা মুখার্জীর খেয়াল শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর খেয়াল শুনে সব সময়েই মনে হয়েছে তাঁর গলার আওয়াজের ভিন্নতা তাঁর সঙ্গীতকে এক অন্য মাত্রা দিত। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য লেগেছে তাঁর দ্রুত হড়ক তান যা সহজেই তিন সপ্তক ছুঁয়ে যেত। তাঁর গলায় ট্রেমেলো বা ভাইব্রেশন, যা সাধারণতঃ বিদেশী অপেরা সঙ্গীতে ব্যবহার হয়, তা ছিল। সেই কম্পন আধুনিক এবং প্লে-ব্যাক গায়কির জন্য খুব আকর্ষণীয় হলেও, খেয়াল গায়নের জন্য সহায়ক ছিল না। তিনি আশ্চর্যভাবে সেই ট্রেমেলো নিয়ন্ত্রণ করতেন খেয়াল গায়কীতে। পরবর্তী কালে তাঁর সহশিল্পী পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী এ কথা উল্লেখ করেছেন।

গানকে তিনি জীবনের একমাত্র সাধনা মনে করতেন। অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করতেন এবং প্রতিদিন সকালে উঠে অল্প যোগ ব্যায়াম ইত্যাদি করে নিয়মিত তানপুরা নিয়ে রেওয়াজ ছিল তাঁর নিত্যকর্ম। খুব কম স্টেজ প্রোগ্রাম করতে রাজী হতেন। কোন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সমারোহে গাইবার অন্তত তিনমাস আগে অন্য সব ধরণের গান করা বন্ধ করে দিতেন। গলায় সর্বদা কাপড় জড়িয়ে রাখতেন। জোরে কথা বলতেন না।

অজয় চক্রবর্তী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন যে গায়িকা জীবনের চূড়ায় উঠে একবার পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দীতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত রেকর্ড করার কাহিনী। বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই সন্ধ্যা বারবার তাঁকে ফোন করে বলতেন যে অজয় চক্রবর্তীর মত শিল্পীর সঙ্গে গাইতে গিয়ে তাঁর নার্ভাস লাগছে! অবশেষে প্রোগ্রামের দিন তিনি তিনবার ফোন করে ফেললেন ও বললেন “ভাই অজয়, তুমি একটু সোজা তান কোরো ভাই, নইলে আমি ধরতে পারব না। আমি নিজের হাতে চিকেন স্যুপ করে নিয়ে যাব। স্টুডিওতে স্যুপ খেয়ে তারপর তুমি গান করবে। তাহলে গলা গরম থাকবে।“

অজয় চক্রবর্তী আশ্চর্য হয়ে বলেছেন, এরপর স্টুডিওতে রেকর্ডিং করতে গিয়ে কিন্তু দেখেন সন্ধ্যার গলায় সুরের ঝর্ণা বইছে, এবং সবচেয়ে শক্ত হড়কত ও তানগুলি তিনিই করছেন!

সেতারী পন্ডিত প্রত্যুষ ব্যানার্জী উল্লেখ করেছেন মধ্য আশির দশকে সন্ধ্যা মুখার্জীর কন্ঠে শোনা কলকাতায় একটি শাস্ত্রীয় কনফারেন্সের কথা। সন্ধ্যা মুখার্জী লম্বা সময় ধরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গেয়েছিলেন সেই কনফারেন্সে এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে তাঁর যথেষ্ট পরিচিতি ছিল।

১৯৪৮ সালে রাইচাঁদ বড়াল সুরারোপিত “অঞ্জনগড়” ছবিতে তিনি প্রথম প্লে-ব্যাক করার সুযোগ পান। ইমনে “অব নাহি ধরত ধীর”। এরপর শচীনদেব বর্মণের আহবানে তিনি মুম্বই যান এবং সেখানেই প্লে-ব্যাকে তাঁর গায়ন শুরু হয়। পরপর সতেরোটি ছবিতে প্লে-ব্যাক করেন তিনি। গানগুলি বেশীরভাগই ছিল শাস্ত্রীয় সুরের ওপরে আধারিত। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন সলিল চৌধুরী, শচীনদেব বর্মন, মদনমোহন, রোশন প্রভৃতি বিখ্যাত মানুষেরা। মুম্বইতে থাকাকালীন লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব হয় এবং তিনি যেখানে ভাড়া থাকতেন সেই ফ্ল্যাটে লতা প্রায়ই যাতায়াত করতেন আবার পরস্পরকে বাড়িতে ডেকে খাওয়াতেন। লতার সঙ্গে সন্ধ্যা মুখার্জীর একটি ডুয়েট গান খুব বিখ্যাত হয়। সেটি হল অনিল বিশ্বাসের সুরে “বোল পাপিহে বোল তু কৌন মেরা চিতচোর।

এরপর ব্যক্তিগত কারণে সন্ধ্যা কলকাতায় ফিরে আসেন এবং একের পর এক অসংখ্য বাংলা ছবিতে অসাধারণ সব গান গাইতে শুরু করেন। বিশেষতঃ সুচিত্রা সেনের ঠোঁটে তাঁর সে সব গান অমর হয়ে আছে। এ ছাড়াও বহু নায়িকার ঠোঁটে গান করেন সন্ধ্যা। তার মধ্যে আধুনিক সুরের গান, বিদেশী সুরের গান যেমন ছিল, তেমনই ছিল বেশ কিছু রাগপ্রধাণ ও শাস্ত্রীয় সুরের গান। পাশাপাশি কিছু বেসিক রেকর্ডেও অপূর্ব কয়েকটি শাস্ত্রীয় সুরের গান করেন সন্ধ্যা। আমরা আলোচনা করব এমনই কয়েকটি গান নিয়ে। প্রথমেই মনে পড়ে ১৯৫৭ সালের ছবি “বসন্ত বাহার” এর কথা। এই ছবিতে ছিল অসাধারণ কয়েকটি রাগপ্রধাণ গান। বিকাশ রায়ের পরিচালনায়, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরে বসন্তবাহার রাগে সন্ধ্যা গেয়েছিলেন “বাঁধো ঝুলনা, তমাল ডালে এস দুলি দুজনে”। এই গানটির দুটি ভার্শন ছিল। একটিতে তিনি একা গেয়েছিলেন এবং অন্যটিতে তাঁর সঙ্গে পন্ডিত প্রসুন ব্যানার্জী গেয়েছিলেন।

এরপর কবি ও গীতিকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে সন্ধ্যা মুখার্জীর বিবাহ হয় এবং তাঁর কথায় সন্ধ্যা অনেকগুলি গান করেন। তিনি আজীবন সন্ধ্যার সঙ্গী এবং গাইড ছিলেন।

১৯৫৮ সালে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ও সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের সুরে সন্ধ্যা গাইলেন দেশ রাগে বিখ্যাত রাগপ্রধাণ “পথ ছাড়ো ওগো শ্যাম কথা রাখ মোর”, যা আজও মুখে মুখে ফেরে।

১৯৬৩ সালে অসিত সেনের পরিচালনায় রবীন চ্যাটার্জীর সুরে উত্তর ফাল্গুনী ছবিতে সন্ধ্যা গাইলেন অসাধারণ খাম্বাজ ঠুংরী “তোরে নয়না লাগে”

১৯৬৭ সালে একটি উল্লেখযোগ্য ছবি অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি। এতে অনিল বাগচীর সুরে সন্ধ্যা মুখার্জীর গাওয়া ঠুংরী “ঘিরি ঘিরি আঈ কারি বদরিয়া” রাগপ্রধাণ অঙ্গে “তুহুঁ মম মনপ্রাণ হে” “আমি যে জলসাঘরে”, মান্না দের সঙ্গে ডুয়েটে “চম্পা চামেলী গোলাপের বাগে” অসম্ভব জনপ্রিয় হয় এবং আজও সমানভাবে গাওয়া হয়। ১৯৭১ সালে জয় জয়ন্তী একটি খুব হিট একটি মিউসিকাল ছবি। এতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সুরে জয়জয়ন্তী রাগে সন্ধ্যা গাইলেন “কেন ডাক বারে বারে আমারে রিমঝিমঝিম বরষায়” এবং জৌনপুরীতে বাংলা ছোট খেয়াল “ঝনঝনন সুরঝংকারে” উস্তাদ মুনাবর আলি খানের সঙ্গে যুগলবন্দীতে।

এমনি আরো কতগুলি গান, নচিকেতা ঘোষের সুরে “মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা” কিংবা “প্রভুজী তুমি দাও দরশন” এর মত বাংলা ভজন। এমন কত যে মণিমুক্তা ঝরেছে সন্ধ্যা মুখার্জীর কন্ঠে তার তালিকা করতে বসলে এ লেখা আর শেষ হবে না।

২০২২ সালে আমরা হারিয়েছি এই কিন্নরকন্ঠী শিল্পীকে। শেষদিন পর্যন্ত তিনি তাঁর রেওয়াজ বন্ধ করেননি। যদিও বাইরে গাওয়া বন্ধ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কন্ঠ ছিল সজীব। তাঁকে প্রণাম জানিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ এবং আলাপের দীর্ঘ যাত্রা শেষ করি। এই প্রবন্ধে আমি ভেবেছিলাম উত্তরভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অর্থাৎ গায়নের মূল ঘরানাগুলির কথা বলব। কিন্তু সঙ্গীতই যেন আমাকে পরিচালিত করেছে এবং আমার হাত ধরে লিখিয়ে নিয়েছে পঞ্চাশটি পর্ব যাতে উত্তরভারতীয় শাস্ত্রীয় গায়নের সঙ্গে সঙ্গে লঘু শাস্ত্রীয়সঙ্গীত ঘরানা, দক্ষিণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, বাদনে তবলা, অন্যান্য যন্ত্রসঙ্গীত ঘরানা এবং নৃত্য ঘরানাগুলির কথাও উঠে এসেছে। গায়ন বাদন ও নৃত্য নিয়েই তো সঙ্গীত।

তথ্যসূত্রঃ তথ্যের জন্য মূলত অন্তর্জালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখার টুকরো, ইউটিউবে শিল্পীদের সাক্ষাতকার এবং আত্মজীবনী, পন্ডিত রবিশংকরজীর “রাগ অনুরাগ” ও কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের “কুদ্রত রঙ্গীবিরঙ্গী” ছিল আমার সহায়ক। নিজের সঙ্গীতজীবন যাপন ও বিভিন্ন কনফারেন্সে শিল্পীদের গানবাজনা শোনা, নাচ দেখা ও তাঁদের কারো কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগও অনেক সাহায্য করেছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।