ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব – ৪৫)

আলাপ

ভারতনাট্যম শিল্পীদের কথা বলতে গিয়ে এবার বলব দুই অসাধারণ মা মেয়ের কথা, যারা শুধু নাচের জন্য নয়,  তাঁদের সারা জীবনের সামাজিক কাজ এবং নারী আন্দোলনের জন্যও বিখ্যাত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের কাজের জন্য দুজনেই বহু পুরস্কারে ভূষিত। প্রথমে বলি মা মৃণালিনী সারাভাইয়ের কথা। তামিল পিতা এবং মালয়ালী মাতার সন্তান মৃণালিনীর জন্ম কেরালায় ১৯১৮ সালে। বাবা ম্যাড্রাস হাই কোর্টের বিখ্যাত উকিল এবং মা ছিলেন সমাজকর্মী। তাই ছোটবেলা থেকেই সামাজিক কাজ এবং আন্দোলনের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা। সুইজারল্যান্ডের বোর্ডিং স্কুলে দু বছর পড়াশুনা করেন ও সে সময় সেখানকার ডালক্রোস ডান্স স্কুলে ওয়েস্টার্ণ ডান্সে তাঁর প্রথম হাতেখড়ি। এরপর দেশে ফিরে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে ও অভিভাবকত্বে শান্তিনিতেতনে তাঁর শিক্ষালাভ শুরু হয় এবং তিনি বুঝতে পারেন যে নাচ ও নাটকই তাঁর প্রথম ভালোবাসা। এরপর কিছুদিনের জন্য তিনি আমেরিকা যান এবং সেখানে আমেরিকান স্কুল অফ ড্রামাটিক আর্টে শিক্ষালাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি ভারতনাট্যম শিক্ষা শুরু করেন মীনাক্ষিসুন্দরম পিল্লাইয়ের কাছে এবং কথাকলি নৃত্যনাট্য শিক্ষা করেন গুরু থাকাজি কুঞ্চুকুরুপের কাছে।
১৯৪২ সালে আর এক বিখ্যাত মানুষ ভারতীয় মহাকাশ অভিযানের জনক বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। গুজরাটের আহমেদাবাদে সংসার পাতেন মৃণালিনী। তাঁর এক পুত্র কার্তিকেয় এবং কন্যা মৃণালিনী সারাভাইয়ের জন্ম হয়। ১৯৪৮ সালে এখানেই তিনি নৃত্য শিক্ষাদানের জন্য দর্পণা নৃত্য অ্যাকাডেমী তৈরী করেন। এর পরের বছর তিনি প্যারিসে “থিয়েটার ন্যাশনাল দ্য শাইলট” এ নৃত্যনাট্য পরিবেশন করে প্রভূত প্রশংসা ও সুনাম অর্জন করেন।
নৃত্য ও সামাজিক কাজে অতিরিক্ত ব্যস্ততার জন্য তাঁর বিবাহিত জীবনে সমস্যা দেখা দেয় এবং বিক্রম সারাভাই ক্রমে নিজেকে একলা অনুভব করতে শুরু করেন এবং নিজেকে বিজ্ঞানসাধনায় ডুবিয়ে দেন।
নাচ ছাড়াও গুজরাটে হ্যান্ডিক্রাফট ও হ্যান্ডলুম আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। বিদেশী বস্ত্রের পরিবর্তে দেশী বস্ত্র পরিধান তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মৃণালিনী সারাভাই প্রায় একশোর ওপর ভারতনাট্যম ও কথাকলি নৃত্য ও নাট্য রচনা ও নৃত্য পরিকল্পনা (কোরিওগ্রাফি) করেন। এ ছাড়াও তিনি অনেক উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও নাটক লেখেন ছোটদের জন্য। তিনি গান্ধিজীর সর্বোদয় আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন এবং সর্বোদয় ট্রাস্টের একজন ট্রাস্টি ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীর নাম “মৃণালিনী সারাভাই – দ্য ভয়েস অফ দ্য হার্ট”। তাঁর বোন লক্ষ্মী সেহগল ছিলেন সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজ, রানী ঝাঁসি রেজিমেন্টের কম্যান্ডার ইন চিফ।
মৃণালিনী সারাভাইয়ের ভারতনাট্যম ও কথাকলি নৃত্যের জন্য প্রাপ্ত বহু পুরস্কার ও সম্মানের মধ্যে আছে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী ফেলোশিপ, সব্যসাচী সারস্বত সম্মান, ফ্রান্সের দে লা ডান্সে সম্মান ও পুরস্কার এবং বিভিন্ন বিদেশী ইউনিভার্সিটির সাম্মানিক ডক্টরেট। ২০১৬ সালে সাতানব্বই বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

মৃণালিনী সারাভাইয়ের কন্যা মল্লিকার জীবনকাহিনী বলার আগে বলি, তাঁর নাচ দেখার প্রথম অভিজ্ঞতার কথা। সেবার ডোভার লেন মিউসিক কনফারেন্সে নেচেছিলেন মল্লিকা। প্রথম সন্ধ্যাতেই ছিল তাঁর নাচ।
নাচ শুরু হয় আলারিপু দিয়ে। মল্লিকা সারাভাইয়ের মঞ্চ প্রেসেন্স দারুণ! টানটান ঋজু চেহারা, তীক্ষ্ণ নাসা, বুদ্ধিদীপ্ত মুখমন্ডল ও অসাধারণ বিশাল কাজলকালো দুটি চোখ, যাতে মূহুর্মুহু ভাবের পরিবর্তন হয়! গোটা মঞ্চ জুড়ে নাচেন তিনি। আলারিপুর পর ভর্ণম ও পদম অংশে শুরু হল মহাভারতের “দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ”! যেমন তাঁর পায়ের কাজ, হস্তমুদ্রা, তেমনই দারুণ নাট্যাংশের কোরিওগ্রাফি! দ্রৌপদীর অপমান, যন্ত্রণা এবং তারপর তাঁর প্রতিবাদ ও তেজ যেন মূর্ত হয়ে উঠল! তাঁর নাচ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। সবশেষে তিলান্নায় একটি সাদা চাদর পেতে দেওয়া হল স্টেজের মাটিতে। দক্ষিণভারতীয় তারাণার সঙ্গে অতি দ্রুত নৃত্য প্রদর্শন শুরু করলেন মল্লিকা! অত্যাশ্চর্য ব্যাপার হল সেই নৃত্য শেষে সেই সাদা চাদরের ওপর তাঁর পায়ের লাল আলতার দাগে দাগে ফুটে উঠল একটি অপূর্ব পদ্ম! এমন নৃত্য আগে কখনো দেখিনি। সে ছিল এক বিস্ময়!
১৯৫৫ সালে গুজরাটের আহমেদাবাদে মল্লিকার জন্ম হয়। পিতা বিক্রম ও মা মৃণালিনী দুজনেই ছিলেন অত্যন্ত ব্যস্ত এবং বিখ্যাত মানুষ! কিন্তু তিনি ও তাঁর ভাই যাতে ঠিকমতো মানুষ হন সেদিকে তাঁদের বিশেষ নজর ছিল। তাঁরা ঠিক করেছিলেন ছেলেমেয়েদের যতদিন না অন্তত বারো বছর বয়স হয় বাবা বা মা কেউ একজন তাদের সঙ্গে থাকবেন। সেই ভাবেই মৃণালিনী যখন বিদেশে যেতেন, বিক্রম সারাভাই ছেলেমেয়ের দেখভাল করতেন। এমনি একটা সময়ে ছোট্ট মল্লিকাকে স্কুলে মানুষের মুখ আঁকতে বলা হয়েছিল। সে কানটা ঠিক জায়গায় আঁকতে পারেনি। পাশের বাচ্চা ছেলেটি বলে যে মেয়ে এটাও জানে না সে একটি আস্ত গাধা! খুব অপমান লাগে মল্লিকার। সে বাড়ি গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বলে যে সে আর স্কুলে যাবে না। বাবা বলেছিলেন যে একটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে একটি গাধার কী তফাত জানে না, তার ওপর তো করুণা হওয়া উচিত! কেন তার কথা ভেবে মল্লিকা কষ্ট পাবে? সেই শিক্ষা সারাজীবন মল্লিকার কাজে লাগে। এরপর যে যাই বলুক তা কোনদিন গ্রাহ্য করেননি মল্লিকা। তিনি বুঝেছিলেন যে অপমান মনে নিলেই তা অপমান, নইলে নয়।
মল্লিকা নাচ শুরু করেন একটু বেশী বয়সে। ছোটবেলা থেকে দেখতেন তাঁর মা নাচের জন্য কী অমানুষিক পরিশ্রম করেন! দিনরাত খেটে নাট্যরূপ দান, কোরিওগ্রাফি করা, নাচের দলের ছেলেমেয়েদের তৈরী করা, হাজার ঘন্টা রিহার্সালের পরিশ্রম, তারপর সারা দেশ বিদেশ ঘুরে দিনরাত ভ্রমণ করা, মধ্যরাত
পর্যন্ত নাচ করে ফেরা এবং সর্বোপরি নিজের রেওয়াজ ও প্রাকটিস! তাঁর ধারণা হয় নৃত্যশিল্পী হওয়া খুব কঠিন! তিনি নিজের মতো নেচে বেড়াতেন, কারণ নাচ তাঁর ভিতরেই ছিল, কিন্তু তিনি প্রথাগত নৃত্যশিক্ষা করে শিল্পী হতে ভয় পেতেন। ছোটবেলা থেকে মায়ের অসাধারণ নাচ দেখে দেখে তিনি অনেক নাচ এমনিই তুলে ফেলতেন এবং কলেজ ফেসটিভ্যালে সে সব দেখিয়ে প্রথম পুরস্কারও পেয়ে যেতেন, কিন্তু এমনিতে কৈশোর ও যৌবনের শুরুতে তিনি ছিলেন কট্টর নারীবাদী, স্বাধীনচেতা এবং খানিকটা টমবয় সুলভ। তিনি প্রকাশ্যে সিগারেট খেতেন, চুল ছিল ছেলেদের মতো ছাঁটা! আহমেদাবাদে প্রতিবেশীরা মেয়েদের যে রূপ দেখে অভ্যস্ত, তিনি একেবারেই তেমন ছিলেন না। যৌবনের শুরুতে তিনি স্থির করেন যে তিনি সিনেমায় নামবেন। এরপর তিনি  “হিমালয় সে উঁচা” বসু চ্যাটার্জীর “শিশা” ইত্যাদি বেশ কয়েকটি সিনেমা করেন। কিন্তু সেগুলি খুব একটা সফল হয়নি। অবশেষে এক পরিচালক তাকে বলিউডের টিপিকাল নাচ করতে বলায় তিনি তাকে থাপ্পড় মেরে শুটিং থেকে বেরিয়ে আসেন। আর ফিরে যাননি। এরপর তিনি ভারতনাট্যম ও কুচিপুরী নৃত্য শিক্ষা শুরু করেন ও কিছুদিনের মধ্যেই অসাধারণ শিল্পী হয়ে ওঠেন। এরপর মায়ের দর্পণা অ্যাকাডেমীর হয়ে নারী ক্ষমতায়ণের ওপর একটি অসাধারণ নৃত্যনাট্য “শক্তি – দ্য পাওয়ার অফ উইমেন” করেন তিনি। সেখানে সীতার কন্যা রূপে তাঁর নাচ ও অভিনয় অত্যন্ত প্রশংসিত হয় এবং সেই নাটক গোটা পৃথিবী ঘুরে প্রদর্শন করেন তাঁদের দল! ৫০০ বার তিনটি ভাষায় অভিনীত হয় সেই নৃত্যনাট্য। এরপর তিনি দেখেন যে সমসাময়িক বিষয়গুলি নিয়ে নৃত্যে কোন কোরিওগ্রাফি কেউ নতুন করে লিখছেন না। নারীর কথা বলা হয়না সেভাবে কোন নাচে। তখন সমাজ সচেতনতার জন্য তিনি নিজেই নাটক ও কোরিওগ্রাফি তৈরি করে সেগুলি অভিনয় করতে লাগলেন। তিনি বলেছেন তাঁদের পরিবারে তিনি শক্তিশালী ও প্রতিবাদী নারী দেখেছেন ছোটবেলা থেকে। তাঁর ঠাকুমা ছিলেন কেরালার বৃক্ষ আন্দোলনের পুরোভাগে, মা ছিলেন সমাজকর্মী, মাসি ছিলেন লক্ষ্মী সেহগল। পরিবারে প্রায় সবাই সামাজ সচেতক ও সমাজকর্মী ছিলেন। তাঁদের পরিবার ছিল অন্য সব পরিবারের থেকে আলাদা।
মল্লিকা সারাভাইকে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত করে পিটার ব্রুকের মহাভারত! এই নাটকে দ্রৌপদীর চরিত্রে তাঁর নাচ পৃথিবীবিখ্যাত হয়। এই মহাভারতে কৃষ্ণ চরিত্র করেছিলেন এক মরোক্কান, ভীমের চরিত্রে ছিলেন এক আফ্রিকান অভিনেতা। নাটকটি যখন ভারতে প্রদর্শিত হয়, তখন অতি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি ভারতীয় দেবতাদের ও মহাকাব্যের চরিত্রগুলিকে এইভাবে দেখানোর তীব্র বিরোধিতা করেন। প্রবল আন্দোলন শুরু হয় দ্রৌপদীকে নিষিদ্ধ করার জন্য। কিন্তু এই নাটকের জনপ্রিয়তা এতো বেশী ছিল যে সেই বর্ণবৈষম্যমূলক আন্দোলন হেরে যায়।
মল্লিকা সারাভাই “আনসুনি” বলে একটি নৃত্যনাট্য রচনা করেন, যেখানে ভালো ভালো স্কুলের ধনী ঘরের বাচ্চাদের, ভারতের প্রান্তিক মানুষের দুঃখ কষ্ট ও ভারতের প্রকৃত সামাজিক অবস্থা কী সে বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। এই রচনাটি ১২০ টি স্কুল ও কলেজে দেখানো হয়।
১৯৮২ সালে মল্লিকা সারাভাই বিপিন শাহকে বিবাহ করেন ও তাঁর দুই সন্তান হয়, কিন্তু ১৯৮৯ সালে তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যায়। তাহলেও তাঁরা একসঙ্গে নাট্যদলের কাজকর্ম করেন আজীবন বন্ধু হিসাবে।
২০১২ সালে বহু আন্তর্জাতিক নাট্যকর্মী ও বাদ্যযন্ত্রীকে নিয়ে মল্লিকা তৈরী করেন “উইমেন উইথ ব্রোকেন উইংস” যেখানে শত সহস্র মেয়েদের কথা বলা হয়েছে যারা গৃহহিংসার শিকার।
এ ছাড়াও দূরদর্শনের জন্যও তাঁর নারী আন্দোলনের ওপর অনেকগুলি নৃত্যনাট্য আছে।
তিনি গুজরাট সরকারের গৌরব পুরস্কার ও পদ্মভূষণ লাভ করেন।

ভারতনাট্যমের কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পীর মধ্যে আছেন দুজন হিন্দী চলচ্চিত্রের নায়িকা বৈজয়ন্তীমালা বালি ও হেমা মালিনী। দুজনেই অত্যন্ত ভাল নৃত্যশিল্পী এবং অসংখ্য অনুষ্ঠান করেছেন দেশে ও বিদেশে। দুজনেই স্টেজে ছাড়াও প্রচুর দক্ষিণ ভারতীয় ও হিন্দী সিনেমায় ভারতনাট্যম পরিবেশন করেন। সোনাল মানসিং, স্বপ্নসুন্দরী ইত্যাদি শিল্পীও ভারতনাট্যমকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করেছেন।
সবশেষে কলকাতায় ভারতনাট্যমের বিস্তারে থাঙ্কুমণি কুট্টি এবং কলামন্ডলের কথা না বললেই নয়। থাঙ্কামণি কুট্টির নৃত্য জীবন শুরু হয় ১৯৫৪ সালে যখন ছোট্ট মেয়েটি তাঁর বাবার সঙ্গে কেরালার এক বিখ্যাত কবির কন্যা বাসন্তী মেননের নাচ দেখতে কেরালায় কলামন্ডলমে যান। এটি সেই বিখ্যাত কবির বাড়িতে একটি প্রাইভেট শো ছিল। নাচের শেষে মেয়েটির মুখের ভাব দেখে বাসন্তী দেবী জিজ্ঞাসা করেন যে সে নাচ শিখতে আগ্রহী কি না। মেয়েটি একগাল হেসে বলে “অবশ্যই!” প্রথমে কেরালা কলামন্ডলমের সদস্যরা তাকে নিতে চাননি, কিন্তু প্রাথমিক ভাবে কিছু আপত্তির পর তাঁরা তাকে নিতে রাজী হন এবং থাঙ্কামণি কলামন্ডলমের হোস্টেলে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। সেখানে শ্রদ্ধেয় গুরু ভাল্লাথলের কাছে দীর্ঘদিন ভারতনাট্যম ও কথাকলি শেখেন তিনি। তারপর দলের সঙ্গে গোটা ভারত ঘুরে নৃত্য প্রদর্শন করেন। প্রধাণমন্ত্রী জহরলাল নেহরুকেও নাচ দেখান।
একবার কলামন্ডলমের ক্যাম্পাসে মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন থাঙ্কামণি, এমন সময় কথাকলি গুরু রমণ কুট্টি নায়ার তাকে একজন লম্বা ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি কলামন্ডলমের কথাকলির প্রাক্তন ছাত্র। ভদ্রলোক অদ্ভুত অতিরিক্ত ঢোলা সাদা পাজামা কুর্তা পরেছিলেন। মেয়েরা আড়ালে তাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করলো। তখন কি আর থাঙ্কামণি জানতেন যে ইনিই হবেন তাঁর আজীবনের বন্ধু, গাইড ও স্বামী যার সঙ্গে মিলে তিনি কেরালা থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে পৌঁছবেন? সেই ভদ্রলোক কবিগুরুর ডাকে শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষা দিতেন। প্রথমে থাঙ্কামণি তাঁর গ্রাম ছেড়ে আসতে রাজী হননি এবং বিয়েও করতে চাননি। তবে কবিগুরু ও বাংলা সম্পর্কে তাঁর এক অদ্ভুত ভক্তি ছিল, তাই শেষ পর্যন্ত রাজী হন। ১৯৫৮ সালে বিয়ের পর গোবিন্দন কুট্টি ও থাঙ্কামণি হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছন। তিনি ভাবতে পারেননি গোবিন্দনজী এতোজন কথাকলি ছাত্রছাত্রী মালা নিয়ে এভাবে স্টেশনে অপেক্ষা করবে! তাঁর মন আনন্দে ভরে যায়। তারপর থেকে এই দম্পতি কলকাতাকেই তাঁদের বাড়িঘর বানিয়ে নেন এবং প্রথমে একজন থেকে ক্রমে তাঁদের নৃত্যশালা ও বিদ্যালয় কলকাতা কলামন্ডলম অনেকগুলি শাখা খোলে শহরের নানা প্রান্তে। তাঁরা নানা সম্মান ও পুরস্কার পেতে লাগলেন। কিন্তু তাতেই তাঁরা তৃপ্ত ছিলেন না। ক্রমে তাঁদের তিন সন্তান হয়। তারা কলকাতার নানা স্কুলে পড়াশুনা করতে থাকে, বাংলা ভাষা এমন ভাবে শিখে যায় যেন তাঁরা এখানকারই লোক। থাঙ্কামণি ও গোবিন্দন কুট্টি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাভাষার প্রবল ভক্ত। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলিকে ভারতনাট্যমের আঙ্গিকে পরিবেশন করতে লাগলেন। শ্যামা, শাপমোচন, বাল্মিকীপ্রতিভা ইত্যাদির অভিনয় ও নাচ, যেখানে গোবিন্দনজী প্রধাণ পুরুষ চরিত্রগুলি করতেন, খুবই বিখ্যাত হল এবং এমনকি সিঙ্গাপুর থেকে আমন্ত্রণ এল সেখানে গিয়ে পরিবেশন করার জন্য। ২০০৭ সালে গোবিন্দনজীর মৃত্যুর পর কলামন্ডলমের ওপর প্রবল আঘাত আসে। কিন্তু থাঙ্কামণিজী ভয় পাননি। ছাত্রছাত্রী ও সন্তানদের পাশে নিয়ে লড়াই করে আগে সব ধারদেনা মেটান। তারপর সরকার যে জমি দেন তাতে কলামন্ডলমের বিরাট বাড়ি নিজস্ব স্টুডিও, ক্লাসরুম, ডরমিটরি, অডিটোরিয়াম সব এক ছাদের তলায় বানান ও এটিকে একটি ডান্স রিসার্চ সেন্টারে পরিণত করেন। তিনি বলেন যে এভাবেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের চর্চা করে তিনি বাংলার ছেলেমেয়েদের ওপর পশ্চিমী নৃত্যের ও সংস্কৃতির প্রভাব দূর করতে চান। গলফ গ্রীনে কলামন্ডলম পারফর্মিং আর্ট সেন্টার মাথা তুলে দাঁড়ায় এবং অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে ভারতনাট্যম ও কথাকলিতে শিক্ষিত করে। কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ে ভারতনাট্যম নৃত্য চর্চা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।