এবার সেই অপর প্রবীণ ও অত্যন্ত বিখ্যাত শিল্পির কথা বলবো যাঁর নামেই বিখ্যাত হয়ে আছে তাঁর ঘরানা। তখন ২০০৪ সাল। আমি একটি আই টি কোম্পানীতে প্রজেক্ট ডিরেকটর পদে কর্মরত। সারাদিন চলে যায় প্রজেক্ট ম্যানেজারদের সাথে মিটিং-এ, ব্যাবসা আনার জন্য বিদেশের সঙ্গে টেলিকলে আর বাড়ি ফিরে ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে পড়াতে বসি। তখন সবে আমার ছোট স্যান্ট্রো গাড়িটা বিক্রি করে একটা বড় সেডান কিনেছি। মানে যাকে এককথায় বস বলে নিজেকে তেমন ভাবতে শুরু করেছি। কাজের চাপে এবং নেশায় দিনের আলো দেখতে পাই না। যদিও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা ছাড়িনি, গুরুজী অর্থাৎ গুরু অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যাচ্ছিও রবিবার, তবলা নিয়ে রেওয়াজও করছি, কিন্তু সপ্তাহে ঐ একদিন। তার বাইরে সংগীত আমার জীবন থেকে অনেক দূরে সরে আছে। আপনারা হয়তো ভাবছেন এই গল্পের সঙ্গে আলাপ এর বিষয় অর্থাৎ ঘরানাদারী এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সম্বন্ধ কী, কিন্তু কোন কোন সময় হঠাত কোন কোন সঙ্গীতের অভিঘাত কেমন ভাবে সবকিছু পেরিয়ে এসে হৃদয়ে আঘাত করে, তুচ্ছ করে দেয় দৈনন্দিনকে তা বোঝাতেই এই গল্পের অবতারণা। এমনি একদিনের কথা। নতুন গাড়িতে খুব ভালো মিউসিক সিস্টেম লাগানো। ঠিক করলাম এমনি যখন গান শোনা হয় না, বেশ কটি ক্লাসিকাল গানবাজনার সিডি নিয়ে গাড়িতে উঠবো। রুবি হসপিটাল থেকে সেকটর ফাইভ যাওয়ার সময় রাজার মতো শুনতে শুনতে যাবো। এই ভেবে সিডিগুলো নিয়ে গাড়িতে উঠেছি। বসেছি পিছনের সিটে। বিশাল গাড়িতে জানালা তুলে দিয়ে হালকা এ সি চালিয়ে দিয়েছি। ড্রাইভারকে দিয়ে হবে না বলে নিজেই একটি সিডি সিস্টেমে লাগিয়ে রিমোটে অপারেট করছি। দেখিওনি কোন সিডি লাগালাম। ক্যাসুয়ালি একটা সিডি প্লে করতে দিয়েছি। জাস্ট রিল্যাক্স করবো বলে চালানো। ও মা! একটু পরেই একটি পুরুষকন্ঠের ওজনদার জোয়ারি এবং হংসধ্বনির আলাপ আমাকে সোজা উঠিয়ে বসালো! গাড়ির মধ্যে যেন স্বর্গ রচনা হয়েছে ততক্ষণে! পন্ডিত জশরাজজী গাইছেন! বাইরের গাড়ির জ্যাম, হর্ণ, সময় সব কেমন উধাও হয়ে গেছে । আমার মাথায় মনে কানে তখন শুধু পন্ডিতজীর “পবন পুত্র হনুমান” বন্দিশের সুর। কথাটি ভাবুন। ঐ অদ্ভুত ‘হনুমান’ শব্দটি নিয়েই যে শব্দের অনেক ঊর্ধে গিয়ে কী সুরের মূর্ছনা ছড়ানো যায় তা সেদিন বুঝেছিলাম। কখন যেন আমি নিজে গাইছি, বিস্তার করছি, তান করার চেষ্টা করছি অমন বিদ্যুতের মতো! এমন সময় এলো বিদেশের কল। ওখানকার রেসিডেন্ট ম্যানেজার ফোন করেছেন। কোন এক প্রজেক্টের রিসোর্স চাই সম্ভবতঃ। আমি তার কল বেমালুম শুনতে পেলাম না। আমি তখন অন্য জগতে! অফিস এসে গেলো। গাড়ি আমাদের বিল্ডিং এর সামনে দাঁড় করালো ড্রাইভার। আমি শুনেই চলেছি, গেয়েই চলেছি। নামিনি। শেষে ড্রাইভার গাড়ি ব্যাকইয়ার্ডে পার্ক করাতে নিয়ে গেলো। যখন দাঁড় করিয়ে ও নামছে গাড়ি বন্ধ করে, তখন আমার খেয়াল হয়েছে আমি কোথায়! তাড়াতাড়ি বাস্তবে ফিরে দৌড়ে বিল্ডিং-এ ঢুকে নিজের রুমে! তারপর তো একটু পরেই বসের ফোন “তপশ্রী, তুমি টিডির কল নাওনি সকালে? ব্যস্ত ছিলে বুঝি?” আমি তো আমতা আমতা করে কুল পাই না। কিন্তু কানের গুঞ্জন তো থামে না। অতএব আমার সঙ্গের আরেকটা সিডি, সেটা জশরাজের ভজন, দিয়ে এলাম অ্যাডমিনকে লুপে চ্যানেল মিউসিক হিসেবে পুরো ফ্লোরে চালাবার জন্য। সাধারণতঃ যন্ত্রসঙ্গীত চলে খুব আস্তে করে, কিন্তু সেদিন চলতে লাগলো যশরাজজীর ভজন! আমি আমার রুমে বসে আর মাথার ওপর যশরাজজীর ঐ স্বর্গীয় ভজনগুলি “জগদম্বে জগদম্বে” মেঘমল্লারের ওপর একটি মীরা ভজন! কোথায় গেলো কাজ, কোথায় গেলো কল, কোথায় গেলো বস! আমার মাথায় শুধু সেই সুরের গুঞ্জরণ আর পন্ডিত যশরাজ!! হ্যাঁ বন্ধুরা আমি এমনি পাগল হয়ে গেছিলাম সেদিন। যার গান কানুর বাঁশীর মতো আমার কূল ভুলিয়ে দিলো এবার তবে একটু বলি তাঁর কথা।
প্রধাণতঃ জয়পুর মেওয়াটি ঘরানার শিল্পি পন্ডিত যশরাজ। আসুন দু কথায় বলে নিই এই অপেক্ষাকৃত কম শ্রুত মেওয়াটি ঘরানার কথা। একে জয়পুর মেওয়াটি ঘরানা, যোধপুর ঘরানা বা মিয়াঁ বন্দে আলি খান বীণকার ঘরানাও বলা হয়। আসলে রাজস্থানের জয়পুর ও যোধপুরের মধ্যবর্তী মেবার অঞ্চল জুড়েই ছিলো এই ঘরানার বিস্তার। তাই একে মেওয়ারি বা মেওয়াটি ঘরানা বলা হয়। ঘাগগে নাজির খান এবং ওয়াহিদ খান ঘরানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই ঘরানায় বিশুদ্ধ খেয়াল গায়ন অনেক সময়েই খান্ডরবানী ধ্রুপদ, হাভেলী সঙ্গীত, গোয়ালিয়র ঘরানার সঙ্গীত এবং কাওয়াল বাচ্চো সঙ্গীত প্রথা (কথিত আছে আমীর খুসরু এবং তাঁর ছাত্রেরা দিল্লীর কাছে যে প্রাচীন ঘরানা খুসরু সাহেবের সময় প্রবর্তন করেছিলেন, তারই নাম কাওয়াল বাচ্চো সঙ্গীত) দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এক বিচিত্র রূপ ধারণ করে। ঘাগগে নাজির খানের কাছ থেকে এই সঙ্গীত ঐতিহ্য ও শিক্ষা লাভ করেন অনেকের সঙ্গে, নাত্থুলাল পন্ডিত। তিনি আবার তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র মোতিরাম ও জ্যোতিরামকে তা শেখান। এই জ্যোতিরাম আবার পরে মিয়াঁ বন্দে আলি খানের এক বংশধরের কাছে শিক্ষালাভ করেন। মোতিরাম মৃত্যুর সময় এই সঙ্গীতধারা তাঁর পুত্র মণিরাম ও প্রতাপনারায়ণকে দিয়ে যান। পন্ডিত যশরাজ ছিলেন এই মণিরাম ও প্রতাপনারায়ণের ছোট ভাই। সবচেয়ে বড় ভাই প্রতাপনারায়ণের ছেলেরা হলেন আজকের যতীন ললিত এবং সুলক্ষণা ও বিজয়েতা পন্ডিত ইত্যাদি। তাই এই ঘরানার সঙ্গে সিনেমার একটি সম্বন্ধ অনেককাল ধরেই আছে। প্রতাপনারায়ণ মূলতঃ খেয়াল গায়ক হলেও মণিরামজী গায়নের সঙ্গে সঙ্গে তবলিয়াও ছিলেন। তিনি ছোট্ট যশরাজকে তবলিয়া হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এই পরিবারটি আদিতে হরিয়ানা থেকে আসেন এবং পরে কর্ণাটকে ও তারপর রাজস্থানের মেবার অঞ্চলে সঙ্গীত শিক্ষা ও গায়নের জন্য যান। যশরাজজী মণিরাম এবং বড় ভাই প্রতাপনারায়ণের সঙ্গে বহু অনুষ্ঠানে তবলা সঙ্গত করেন। কিন্তু সেই সময়ে সঙ্গতকার শিল্পিদের কেউ সম্মান করতো না। এতে যশরাজজীর মনে আঘাত লাগে এবং তিনি ঠিক করেন যে তিনি শুধু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চাই করবেন।
প্রতিদিন চোদ্দ ঘন্টার কঠোর রেওয়াজ শুরু হয়। বাইশ বছর বয়সে পন্ডিত যশরাজ মেপালের রাজা ত্রিভুবন বীরবিক্রম সিং এর দরবারে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। শুরু হয় একের পর এক স্টেজ পারফরম্যান্স এবং রেডিওতে সঙ্গীত পরিবেশন। যশরাজজীর সঙ্গীতের বৈশিষ্ট ছিলো তাঁর সঙ্গীতে মেওয়াটি ঘরানার বিশুদ্ধ খেয়াল গায়নের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নানা ঘরানার ভালো জিনিসগুলি নিয়ে আসতেন তাঁর গানে। কখনো লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অর্থাৎ ঠুমরীর বৈশিষ্টও ব্যবহৃত হতো তাতে। প্রথমদিকে এর জন্য তিনি সমালোচিত হলেও পরে সবাই পন্ডিতজীর অসাধারণ সঙ্গীত শুনে বুঝতে পারতেন যে ঘরানার এই মিশ্রণে সঙ্গীতের মাধুর্য আরো বেড়েছে বই কমেনি। যশরাজজী একটি নতুন ধরণের যুগলবন্দীর প্রচলন করেন যার নাম দেন যশরঙ্গী। এতে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা শিল্পি একই সঙ্গে মূর্ছনা স্টাইলে দুটি ভিন্ন রাগ গান। এই যুগলবন্দী খুব বিখ্যাত ও উপভোগ্য হয়। যশরাজজী বিভিন্ন অতি অল্পশ্রুত রাগ যেমন আহিরী টোড়ি এবং পটদীপকি রাগকে বিখ্যাত করেছেন। যশরাজজী খেয়ালের বন্দিশের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি প্রধাণতঃ বিশুদ্ধ হিন্দু দেবদেবীদের কথা বা সাধনার কথা দিয়ে গান বাঁধতেন। তাঁর গানের অন্যতম প্রধাণ উপজীব্য ছিলো ভক্তি। সব সময় তাঁর গানের আলাপ শুরু হতো “ওম অনন্ত বাসুদেবায়” দিয়ে। তারপর তিনি বন্দিশ ধরতেন। খেয়াল ছাড়াও যশরাজজীর ভজন যেন এক অন্য উচ্চতায় উঠতো! এতে বিশুদ্ধ খেয়ালের বৈশিষ্ট, মেওয়াটি ঘরানার লম্বা মীড় যেমন থাকতো তেমনি থাকতো ভগবানকে লাভ করার আকুতি, ভক্তিরস ও গানের মধ্যে লীন হয়ে যাওয়া। পন্ডিতজী ছিলেন পারফেকশনিস্ট! অপূর্ব সুন্দর চেহারার শিল্পি সবসময় সিল্কের পাঞ্জাবী পরে, গলায় স্বর্নালঙ্কার পরে স্টেজে আসতেন। তাঁর শ্বেত বস্ত্রের সঙ্গে মিশে যেতো তাঁর শ্বেতশুভ্র কাঁধ পর্যন্ত এলানো চুল। পন্ডিতজী বেশ কটি সিনেমাতেও কন্ঠদান করেছেন।
এবার একটু বলি শিক্ষক যশরাজজীর কথা। তিনি দেশে এবং বিদেশে আমেরিকা ও কানাডায় একাধিক সঙ্গীত বিদ্যালয় স্থাপন করেন ও অজস্র শিল্পি ও গায়ক তৈরী করেছেন। তার মধ্যে বিখ্যাত তাঁর পুত্র শারঙ্গদেব, কন্যা দুর্গা যশরাজ, পন্ডিত সঞ্জীব অভয়ংকর, প্রীতম ভট্টাচার্য, বেহালায় কলা রামনাথ থেকে শুরু করে কবিতা কৃষ্ণমূর্তি ও সাধনা সরগম। যারা তাঁর কাছে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা করতেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পি হবেন বলে, তাঁদের জন্য তাঁর শর্ত ছিলো যে সঙ্গীত শিক্ষা ছাড়া আর কোনকিছু করা চলবে না। গুরুকূল প্রথায় তাঁর বাড়িতেই থাকতো তাঁর এইসব ছাত্রেরা। তিনিই তাঁদের খাওয়া পরার দায়িত্ব নিতেন। দীর্ঘ সময় সঙ্গীতশিক্ষা তো চলতোই, এ ছাড়া তাঁরা গুরুজীর সঙ্গে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াতেন দেশে ও বিদেশে। ভ্রমণকালীনও সঙ্গীতশিক্ষা চলতো। স্টেজে গুরুজীর সঙ্গে অনেকেই দীর্ঘদিন সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন, যেমন পন্ডিত সঞ্জীব অভয়ংকর। কলা রামনাথজীর মতো অনেক শিল্পিকেই তিনি সুযোগ করে দিয়েছেন তাঁর পরিবেশনের আগে সঙ্গীত পরিবেশন করার। এভাবে তিনি বহু শিল্পিকে তৈরী করেছেন এবং তুলে এনেছেন।
বছরে ছয়মাস তিনি আমেরিকা ও কানাডায় এবং বাকী ছ মাস ভারতে থাকতেন। তাঁর সঙ্গীত পরিবেশনের শুরুর দিনগুলিতে এবং ভি শান্তারামের কন্যা মধুরাজীকে বিবাহ করার পর তিনি প্রথম বেশ কিছুদিন কলকাতায় থাকতেন। এরপর তিনি মুম্বই চলে যান। সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। বেশ ভালো বাংলা বলতেন পন্ডিতজী। ২০২০ সালে লকডাউনের সময় তিনি নিউ জার্সিতে তাঁর বাড়িতেই ছিলেন। সেখানেই আগস্ট মাসের এক সকালে হঠাত হার্ট অ্যাটাকে তাঁর মৃত্যু হয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।