• Uncategorized
  • 0

গদ্য বোলো না তে তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্য

আতঙ্কবাদের সঙ্গে সর্বক্ষণ

আতঙ্কবাদ আমাদের পৃথিবীকে জ্বলন্ত শিখার মতন দহন করছে। তার উত্তাপ আমরা রোজ অনুভব করে চলেছি। অনেক মানুষ এর বলি হয়েছে, অনেক শিশু অনাথ হয়েছে, বহু বিধবা অশ্রুমোচন করেছে। আতঙ্কবাদের ঘাত প্রতিঘাতে জন্ম নিচ্ছে পাল্টা আতঙ্কবাদ। ধর্মীয় মৌলবাদী শিবিরে, রাজনৈতিক শিবিরে বা কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে আতঙ্কবাদ ভীষণভাবে উপস্থিত। আতঙ্কবাদ ছাড়া অনেক কিছু ভাবাই যায় না।
সত্যিই কি আতঙ্কবাদ ছাড়া ভাবা যায় না? প্রাত্যহিক জীবনের অনেক চাপান উতোর টানা পোড়েনে আমরা টের পাই সমাজের পরতে পরতে মেখে থাকা আতঙ্কবাদ। স্কুল- কলেজে ছিল মাস্টারমশাই, পরীক্ষা, হোম ওয়ার্কের আতঙ্ক। ছোটবেলা থেকেই মনে আতঙ্কবাদের বীজ বপন করে দেওয়া হয়েছে। আরো ছোটদের জন্য আছে জুজুর ভয়, ছেলেধরার ভয়। বাড়িতে বাবার কাছে মার খাওয়ার ভয়, পাড়ার খেঁকি কুকুরের ভয়, কত বলব। অফিসে আছে ভয়ানক চাকরি যাবার উদ্বেগ, অফিসের বাইরে আছে তোলাবাজ আর মস্তানদের আতঙ্ক আরো আছে রাজনৈতিক আতঙ্ক। আমরা কি আতঙ্কবাদ ছাড়া থাকতে পারি?
চোর ডাকাতকে আতঙ্কিত করতে তৈরি হয়েছে আইন কানুন, পুলিশ হাজত। চোর ডাকাতের আতঙ্কে তৈরি হয়েছে বাড়ি, পাঁচিল, সিন্দুক। তা না হলে হয়ত যখন তখন আমি চুরি করতে বেরিয়ে পড়তে পারি। প্রতিবেশী দেশের দুর্বুদ্ধির আতঙ্কে আমরা তৈরি করি প্রতিরক্ষা। জীবন সংগ্রামে পরাস্ত হবার ভয়ে দিনরাত এক করে রক্ত জল করি। সব সময়ে নিজেকে সুরক্ষিত করি – অনিশ্চয়তা থেকে আর আতঙ্ক থেকে। আতঙ্কবাদ মানেই বিশেষ কোনো সম্প্রদায় বা দলের অভিসন্ধি নয়, আতঙ্কবাদ সমাজের বৈশিষ্ট্য, সমাজের প্রয়োজন।
যখন আমেরিকা লাদেনের গুপ্ত আস্তানায় হানা দিয়ে তাকে হত্যা করে অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি, গুণ্ডার হাত এড়াতে পুলিশের কাছে যাই, পুলিশি হেনস্থা থেকে বাঁচতে গুণ্ডা বা নেতার কাছে যাই। সমাজের মানুষই আতঙ্কবাদকে লালন করে, এর থেকে মুক্তি নেই। স্কুলের মাস্টারমশাই আর পরীক্ষার স্বপ্ন অনেক বুড়ো বয়স পর্যন্ত লোকে দেখে থাকে।
যে কোনো রকম রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হল আতঙ্কবাদ। আতঙ্কবাদ ছাড়া কেউ কাউকে মানবে না। প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস থেকে পাপ আর নরকের ধারণা মানুষের মনে ঢোকানো হয়েছে বারবার। মধ্যযুগে ধর্মভিত্তিক শাসনব্যবস্থা ছিল এরই বলে কার্যকর। আধুনিক যুগে তার জায়গা নিল ধনবল আর দমন পীড়ন। যখনই আতঙ্কবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার প্রয়োজন হয়েছে প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে আতঙ্কবাদী। বিবর্তনবাদের ঐতিহাসিক জীবন সংগ্রামের ধারা মেনেই এর উদ্ভব হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। যখন ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছিল তখন যে লড়াই শুরু হয়েছিল সেও একপ্রকার আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্দেশ্যে। গান্ধীজি একটা অন্য পথ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন তার মধ্যেও, এটাই ওঁর একটা উদ্ভাবনা। ফরাসী বিপ্লব, কমিউনিস্ট আন্দোলন সবকিছুর মূলেই একই ভাবনা, আর সেই ভাবনা হল দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তির সংঘাত।
প্রত্যেকটি মানুষ সেই শক্তিগুলির কোনো একটি কণা। সেই কণার স্বেচ্ছা আছে, স্বাতন্ত্র্য আছে, স্বাধীনতা আছে। সে নিজস্ব ইচ্ছামত বা বুদ্ধিমত কোনো একটি শক্তিপুঞ্জে যোগ দিতে পারে, ত্যাগ করতে পারে অথবা নিরপেক্ষ ও থাকতে পারে। মানুষের এই বুদ্ধিবৃত্তির জোরেই মানুষ সভ্যতার পথে এতদূর এগিয়ে এসেছে অনেক ভ্রান্তির পরেও। প্রচেষ্টার একটা মূল্য আছে, একবার পরাস্ত হয়ে দমে না গিয়ে ফের এগোনোর চেষ্টা, সেটার অবদান অনস্বীকার্য। এই অগ্রগতির জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী আতঙ্কবাদ। আতঙ্কবাদ মানুষকে শিখিয়েছে, দেখিয়েছে, সচেষ্ট হতে বাধ্য করেছে। অসহায় গুহাবাসী মানুষ যেদিন বন্যজন্তু তাড়াতে হাতে পাথর তুলে নিয়েছিল সেদিনই সে উপলব্ধি করেছিল আতঙ্কবাদের উপযোগিতা- আজও আমরা তা মরমে মরমে জানি। আতঙ্কের মোক্ষম জবাব হল চুপচাপ হাত গুটিয়ে না থেকে পাল্টা ভয় দেখানো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *