গদ্যের পোডিয়ামে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

ঘর শুধু ঘর নয়

ঘরের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। ঘরের মেঝেরও কি আছে? থাকার তো কথা। মেঝে তো ঘরেরই। তবে গন্ধ থাকলেও হয়তো ঘর মোছার পর আর থাকেনা। কিন্তু মেঝের কোণায় যেখানে ঘর-মোছা হাতটা পৌঁছযনা, সেখানেও কি বাকি গন্ধটুকু থেকে যায়? পরখ করে দেখিনি কোনদিন। ভাবিনি। কত কিছুই এরকম ভাবিনা। আলস্যে নয়, অভ্যাসে নেই বলে। প্রয়োজন নেই বলেও হয়তো।

না ভাবাগুলো এইরকম ঘরের কোণার অনাঘ্রাত গন্ধের মতো অনাদরেই পড়ে থাকে। কিন্তু যে ভাবনাগুলো ভাবি, যা নিয়ে মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয় এবং ক্রমশ তা বাড়তে থাকে, সেগুলোও কি সেরকম আদর যত্ন পায়? কারও নজর কাড়তে পারে? অবস্থা বা স্থিতাবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেলে কেউ কি এগিয়ে এসে বলে – আমি আছি তো। বল কি অসুবিধা তোমার?

এইটা বলার লোক খুব কমে গেছে এখন। একটা মায়ার টান, অন্যের ভালো হোক, তাতে আমাকে যদি সামান্য একটু কষ্ট করতেও হয় তো করব, এই মনোভাব নিয়ে হাত বাড়ানো সহযোগীর খুব অভাব হয়ে গেছে। তার চেয়ে বরং যতটুকু পারি নিজেরটা গুছিয়ে নিই, আমি থাকলেই জগত থাকবে তাই আগে আমার ভালো হোক, এই দর্শনই এখন মানুষকে বেশি চালিত করে। নাহলে চারপাশে হাহুতাশ করা এত প্রতিবেশী দেখি কেন? প্রতিবেশীই তো। হতে পারে তারা আমার বাড়ির পাশেই থাকেনা। কিম্বা তারা স্ট্যাটাসে আমার সমতুল্য নয়। তাও যদি মেনে নিতে অসুবিধা থাকে, তারা সহনাগরিক তো বটেই।

ভেবেছিলাম কোভিড পরবর্তী সময়ে অনেক কিছু পাল্টে যাবে। আগে পালটাবে মানুষের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ। আশা জেগেছিল, এই যে এক চরম সংকটকালের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে মানুষ, তাতে সে চিনতে পারছে নিজেদের দুর্বলতাগুলো। শিখে যাচ্ছে কে কখন কার কতটুকু কাজে লাগতে পারে। অনেক কিছু থাকলেও একটা সময়ে যে সে কেমন অসহায় হয়ে যাচ্ছে, এইটা দেখেও অন্তত এইটুকু ভাবতে পারবে যে একজনের আর একজনের পাশে দাঁড়ানো খুব দরকার। ধন দৌলত ক্ষমতা প্রতিপত্তি খ্যাতি যার যতই থাকুক চরম সংকটের মুহূর্তে সেগুলো কোন কাজের নয়। শেষ পর্যন্ত তাকে তুলে ধরবে সেই একজন রক্তমাংসের মানুষেরই দুটো হাত। সে সহমর্মিতা জানাবে, আঘাতে প্রলেপ দেবে, অভয় দেবে, সেবা করবে। সে ডাক্তার হতে পারে, নার্স বা স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কেউ হতে পারে, কিম্বা সাধারণ কোনও সহনাগরিক। কিন্তু সেই আসলে আমার আপনজন। তার প্রতি আর হিংসা দ্বেষ নয়, ঘৃণা নয়। তাই মনে করেছিলাম, মানুষ ভাববে মারণ রোগের কাছে কোনও ভেদাভেদ তো নেই, তার কাছে আমিরই হোক কিম্বা ফকির, সাদা কিম্বা কালো, খারাপ কিম্বা ভালো, সবাই সমান। সবাইকে তা একভাবে আক্রমণ করতে পারে। তার কাছে সবাই অসহায়। এই অবস্থা বারবার ঘটতে পারে। আর তার ফলে মৃত্যু তো নেমে আসতেই পারে, তার সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায় মানুষের রুজি রোজগারের পথ, নিদারুণ বিপর্যয় নেমে আসে জীবনে। সেই অসহায় অবস্থাটাকে সামাল দিতে পারে একমাত্র আর একজন মানুষ। তাই আর রক্তপাত নয়, মারামারি খুনোখুনি নয়। এবার থেকে শুধু একজন আর একজনের সহযোগী হয়ে উঠি। কেননা তুলে ধরার জন্য দুখানা হাত দরকার। সেই হাত একজন মানুষের। আমার চারপাশেই রয়েছে সেই মানুষজন। ঈশ্বরের বেশেই হয়তো।

তবু সেই ঈশ্বরকেই অবহেলা করি। হিংসা করি। তার সঙ্গে শত্রুতা করি। সে এগিয়ে যাচ্ছে দেখলে পিছন থেকে টান মারি। তার কোনো কথায় বা আচরণে পান থেকে চুন খসে যাবে মনে হলে ভাবাবেগে আঘাত লেগে যায়।
এইসব ভাবনাগুলো খুব ক্লান্ত করে দেয়। ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করি। কখনও বা অলস সময়ে পায়ে হেঁটে শহর ঘুরতে বেরই। কত কী-ই তো অদেখা থেকে গেছে। ঘুরতে ঘুরতে অনেক কিছু চোখে পড়ে যায়। কোথাও থমকে থাকা ইতিহাস, কোথাও চলমান উচ্ছল জীবনস্রোত। কখনও ঢুকে পড়ি একটা বড় রাস্তা থেকে একটা সরু গলিতে। সেখানে হয়তো কোনদিনই রোদ্দুর ঢোকেনি। সেই গলিতেই বহু পুরনো যুগের কোন বাড়ির চারতলা থেকে হয়তো সদ্য মেলে দেওয়া কাপড় ঝুলছে, রঙ চটে গেছে বাড়িটার, একটা মলিন পুরনো ছাপ পড়ে গেছে পুরো বাড়িটার দেওয়ালে থামে রেলিংয়ের কারুকার্যে। তবু রঙিন কাপড়টা ঝুলে রয়েছে যেন এটুকু বলার জন্যই যে দেখ, এত বিবর্ণতার মধ্যেও আমি আছি। গলিতে রোদ নেই তো কি হয়েছে? আমার গায়ে রোদ্দুর খেলা করে যায়। আমাকে উজ্জ্বল করে। সব শেষ হয়ে যায়নি। যায়না কখনও। এই রঙটুকু তোমার মনের মধ্যে নাও। নিয়ে সামনে তাকাও।

এও এক নগর জীবন। টিকে থাকার। সহ্য করে নেওয়ার। অনেক ক্ষয় এবং অবক্ষয়ের মধ্যে থেকেও উৎসারিত হয় কোনও আলো। ভিজে যাওয়া রাস্তার বুকেও সঞ্চারিত হয় তাপ। সেরকম তাপের দুপুরে যখন তৃষ্ণা জেগে ওঠে, মনে হয় কোথাও এতটুকু ছায়া নেই, বিপজ্জনক বারান্দার নিচে দাঁড়ানো যায়না, হৃদয়হীন খর রোদ্দুরে হাঁটা যায়না, তখন মনে হয় সভ্যতা এগুলোও শেখায়, হয়তো ভালোর জন্যই। পুড়ে সোনা হওয়ার জন্যই। তাই তখনও বলতে পারিনা ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’। বরং প্রশ্নটা জেগে থাকে, এর চেয়ে কি ভালো ছিল নিস্তরঙ্গ গাঁয়ের জীবন?

গাঁ বলতে তো ছোটবেলা থেকেই বুঝে এসেছি পাশাপাশি সব মানুষের বসতবাটি। ঘরের একপাশে রান্নাঘর। উঠোনের এককোণে তুলসীমঞ্চ, ঢেঁকিশাল, গোয়াল। সেখানে গরু বাছুর। রান্নাঘরের চালে লাউমাচা। এরকম অনেকগুলো ঘর মিলে একটা পাড়া, অনেকগুলো পাড়া নিয়ে গোটা গ্রাম। শুধু শৈশবে ভূগোল বইয়ে পড়া নয়, চোখে দেখা জীবন। দাদা দিদি কাকা পিসি জ্যাঠা জেঠিমার সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা যেন সবাই আপনজন। একজনের বিপদে আপদে আর একজন তখনই ছুটে আসে। কাজে কর্মে সাহায্য করে। সে এ পাড়ারই হোক বা অন্য পাড়ার। এগুলো আর শিখিয়ে দিতে হয়নি নতুন করে। এখন সেই বন্ধনটাকে খুঁজে বেড়াই। পাড়াগাঁয়ে, নগর জীবনে, দেশের অন্যত্র।

দেশ বলতে ঠিক কি বুঝি? শুধু একটা সীমারেখার মধ্যে কতকগুলো মানুষ, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শহর বাজার, শপিংমল, কলকারখানা, গাড়ি ঘোড়া, উন্নয়ন, এইসব? দেশের মানুষগুলোর মধ্যে যে আজন্ম লালিত সম্পর্ক, ভাব ভালোবাসা, আদান প্রদান, যোগাযোগ, পারস্পরিক নির্ভরতা, বন্ধুত্ব, দায়িত্ব, কর্তব্য, এগুলো দেশ এর ধারণায় আসেনা? এগুলো না থাকলে কিসের জীবন যাপন? অথচ এগুলোই যেন ভুলতে বসেছি ক্রমশ। বড় হয়ে যাচ্ছে ক্ষমতা আর না-ক্ষমতার ধারণা। কে দয়া করে দিচ্ছে বলে কারা বেঁচে আছে তার গুণকীর্তন। কে দেয়? কার নিয়ে কাকে দেয়? এ কী ঘোলা জলে ডুবে যাচ্ছি আমরা! এরকম তো আগে ভাবতে দেখিনি কাউকে? না বাইরের কাউকে, না ঘরের!

আবার সেই ঘরের প্রসঙ্গেই ফিরে আসা, যা দিয়ে শুরু এই লেখার। আসলে ঘরের টান বড় অমোঘ। ঘুরেফিরে দিনের শেষে সেখানেই ফিরে আসতে হয়। তখনই মনে এই ধারণার জন্ম হয়, ঘর শুধু ঘর নয়। আরও অনেক কিছু। তাহলে ঘর থেকেই বরং শুরু হোক। সমস্ত ভালো চিন্তা এবং কাজের। ছড়িয়ে পড়ুক পাড়ায়, সমাজে, দেশে। কোভিড পরবর্তী সভ্যতা পাল্টে যাক। মানুষ মানুষকে নতুন করে ভরসা করুক, বিশ্বাস করুক। কবে সুখের বান ডাকবে সেই আশায় বসে থাকতে সবাই রাজি না হতেই পারে। কিন্তু আগে তো সবার দুঃখ দূর হোক। ভুল বোঝাবুঝি দূর হোক। সেই দায়িত্বটা সবাই নিক।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।