‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ৩ ।। খন্ড – ৭)

কফি পাহাড়ের রাজা

তৃতীয় পর্ব:

৭)
একটা আধা শহর, প্রায় গ্রামই বলা যায় এই জায়গাটাকে। একটা একচালার নিচে একদল ছেলে জটলা করছে। সামনে তাদের বইখাতা, ব্যাগ ছড়ানো। এই পড়ন্ত বিকেলে তাদের ছোট্ট স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তারা এখনও বাড়ি যায়নি। কারুর জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা এই কদিনেই জেনে গেছে ওদের চকলেট আংকেল এখুনি এসে পড়বে। রোজ ছুটির পরে তাদের সবাইকে লজেন্স, চকলেট, বিস্কুট বিলি করে একটা লোক। আর তারপর তাদের সঙ্গে ওর শুরু হয় হাজারও গল্প আর খেলা। লোকটার নাম ওরা জানে না। লোকটা স্কুলের হেডমাস্টারের থেকে অনুমতি নিয়েই ছেলেদের কাছে আসে অবশ্য। দেখতে দেখতে একটা বাইক এসে দাঁড়াল। হইহই করে উঠল ছেলেরা। একটা ব্যাগ থেকে লোকটা একে একে সকলের হাতে ধরিয়ে দিল কেক। কেক পর্বের মাঝেই একটা ছোট্ট ছেলে বলে উঠল—আর আমার চকোলেট কই? দাঁড়ি গোঁফের ফাঁক থেকে এক চিলতে হাসি ভেসে এলো যেন। যেন এই আধো আধো মিষ্টি কথারই অপেক্ষায় ছিল সে। আবার চলল চকোলেট বিলি। সামনে খোলা প্রাঙ্গনে এবার তাদের খেলা শুরু হল। রোদ পড়ে এলে লোকটা এবার তাগাদা দিল, ‘কই রে! এবার তোরা বাড়ি যা! সন্ধে হয়ে যাবে তোদের ফিরতে ফিরতে। একজন বলল, ‘আর পাঁচ মিনিট’। একজন সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘না, না দশ মিনিট’। লোকটা আবারও হাসল। রোজকার রুটিন এটা তার। সে বলল, ‘আচ্ছ, সাত মিনিট!’ সেদিনের মতো লোকটা খালি ব্যাগ নিয়ে চলে গেল বাইকে চেপে। প্রায় আধঘন্টা বাদে বাইক এক ছোট শহরে এসে পড়েছে। ছোট হলেও শহর খুব ব্যস্ত। বড় রাস্তা থেকে ছোট রাস্তা ধরে, এ গলি, সে গলি ঘুরে বাইক এসে দাঁড়ালো এক অ্যাপার্টমেন্টের নিচে। ছোট চারতলা বিল্ডিং। একতলায় শাটার বন্ধ একটি দোকানের তালা খুলে লোকটা দোকানে ঢুকল। একটা মাঝারি মাপের কনফেকশনারি তার। সন্ধে আর সকালটা এখানেই কাটায়। রাত হলে তালা দিয়ে উঠে পড়ে তিনতলায়। সেখানেই তার এক কামরার ফ্ল্যাট। রাতে ডিনারে স্যুপ আর পাঁউরুটি খায় লোকটা। তার আগে অবশ্য বোতল খুলে বসে। সঙ্গে নিজের দোকানেরই বেঁচে যাওয়া স্ন্যাক্স নিয়ে নেয়। রোজ তার দোকানে মাল আসে। সন্ধে আটটায় যা বেঁচে থাকে ফেরত নিয়ে যায়। দোকানটি খুব পয়া তার। প্রথম থেকেই লোকসমাগম হয়। ছোট ছোট অ্যাপার্টমেন্টই এখানে বেশি। সেখানকার বাসিন্দারাই নিয়ে নেয় সব। তাদেরও আর দূরে যাওয়ার কষ্ট করতে হয় না। লোকটাকে অনেকে জন নামে ডাকে। বুকের ওপর একটা ক্রশ ঝোলে তার সর্বক্ষণ।
 তার বাইক নেওয়াও হুজুগে পড়ে বা হঠাৎ করে। ওদের অ্যাপার্টমেন্টের কাছাকাছিই একটা গ্যারেজ আছে। একদিন ওই গ্যারেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল ও। কিছু একটা হল্লা হচ্ছিল ওখানে। দাঁড়িয়ে পড়েছিল ও অলসভাবে। ব্যাপারটা কী জানার জন্য ঠিক না। এমনিই সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে ও দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তারপর একটু দেখে যা বুঝল, একটা বাইক হাত বদল হয়েছে। প্রথম পার্টি দ্বিতীয় পার্টির থেকে পুরো দাম এখনও পায়নি। সেই নিয়েই বচসা, চাপান উতোর চলছে। কিছুক্ষণ বাদে এমন হল যে, দ্বিতীয় পার্টি কাগজ দেয়নি ঠিকঠাক—এই অজুহাতে বাইক ফেরত দিতে মরিয়া হয়ে উঠল। এদিকে প্রথম পার্টি বলছে, তার পক্ষে টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব না। খরচ হয়ে গেছে। বাইকটা দেখল ও কিছুক্ষণ। কন্ডিশন দেখে ভালই মনে হল ওর। গ্যারেজ মালিকের কাছে গেল ও। তার কাছ থেকে জেনে নিল বাইকটার হাল হকিকত। খুব পুরনো কিছু নয় বাইকটা। নতুন মডেল কিনবে বলে বেচে দিয়েছে প্রথম জন। আর কাগজপত্রও ঠিকই আছে, শুধু রোড ট্যাক্স দিয়ে দিলেই হবে। এ পর্যন্ত শুনে ও দুম করে বাইকটা কিনে নিতে চাইল। ওর এই প্রস্তাবে দুই যুযুধান পার্টিই বেঁচে গেল এককথায়। সেই থেকে বাইকটা ওর। প্রথম প্রথম দীর্ঘদিনের অনভ্যেসে বাইক চালাতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। তাছাড়া সে যখন বাইক চালাত, তখন তার দুটো পাই আস্ত ছিল। এখনকার একটা কাঠের পা নিয়ে গিয়ার বদলাতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল কয়েকটা দিন। তবে অভ্যেসে সব হয়। এই কাঠের পা তো তার দেহেরই অংশ হয়ে গেছে এখন। তাই সড়গড় হতে সময় লাগল না।
যেহেতু সে নির্বিবাদী টাইপের, কাস্টমারদের সঙ্গে টুকটাক কথা ছাড়া আর কোন সাতেপাঁচে থাকে না, তাই কেউই তাকে নিয়ে খুব একটা কৌতূহলী হয়নি কোনদিন। তাছাড়া এই ফ্ল্যাটে কোন পরিবার, কোথা থেকে এলো, সেখানে কে এলো, কে গেল, কেউই তেমন খোঁজ নেয় না। সকলেই সকালে কাজে বেরিয়ে পড়ে, সন্ধেবেলায় ফেরে। জনের পূর্বপরিচিতি নিয়ে কেউই তেমন আগ্রহী হয়নি এই কারণে। একদিন জন এমনি উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে গ্রামের দিকে চলে গেছিল। সেখানেই ওই ছোট স্কুলটিকে দেখতে পায়। একচালার নিচে ছেলেরা পড়াশুনো করছে। কারুর খালি পা, কারুর ছেঁড়া জামা…দেখেই বোঝা যায় গরীব ঘর থেকেই আসে এরা। অনেকদিন বাদে এদের দেখে জনের নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। সেও এমন এক স্কুলে পড়ত। মায়ের কাছ থেকে যাহোক কিছু খেয়ে দৌড়তে দৌড়তে অনেক দূরের এমনই এক স্কুলে পড়তে যেত। মা! ঝাপসা হয়ে আসে দৃশ্য। মায়ের মুখ কিছুতেই মনে পড়ে না মুরুগানের। বদলে আচমকাই মনে পড়ে যায় কফি বাগান আর বিদ্যা। কেমন আছে সে এখন? দেখতে দেখতে ছ’মাস কেটে গেছে। দাড়িগোঁফ কাটেনি এসে থেকে। নিজের মুখ নিজেই চিনতে পারে না আয়নায়। বিদ্যা চিনতে পারত ওকে দেখে? পরনে অবশ্য সেই মিলিটারি ক্যামোফ্লেজ প্যান্ট। নিশ্চই চিনতে পারত বিদ্যা। বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল জনের। এই তো তারা দুজন দুজনকে ছেড়ে দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছে। বেঁচেও আছে বহাল তবিয়তে। কুগানের থেকে নিয়মিত খোঁজ পায় সে সবার। বাগানেরও। বিদ্যা জেদের বশে সেই মাড়োয়ারি কোম্পানির সঙ্গেই রফা করেছে। ঈশ্বর না করুন, কোন ক্ষতি হয় ওর বাগানের। কুগানকে কড়া ভাবে জানিয়ে রেখেছে জন, সে যেন ওর কোন খবর না দেয় বিদ্যাকে বা তাদের যে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ আছে এটাও না জানায়। জানায়নি নিশ্চই কুগান। নইলে এতদিনে বিদ্যা ঠিক এখান থেকে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেত। ফিরে সে আর যাবে না ওই বাগানে।
না ফেরার কারণ কিন্তু বিদ্যার জেদ নয়। আসলে ওই বাগান আর তার ভালো লাগছিল না। একঘেয়ে জীবন কাটানো তার দ্বারা হবে না। এই জন সেজে সে খুব ভালো আছে। মাঝেমাঝে বিদ্যার অভাব বোধ করে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য ফিরে যেতেও মন চায় না আর। কোন বাঁধন, কোন দায় আর সে বইবে না। কুগান, বিদ্যার ভবিষ্যৎ সে রেখে এসেছে। ওরা যদি কিছু রোজগার নাও করে, ওদের বাকি জীবন পায়ের ওপর পা তুলে কেটে যাবে। এখন এই শেষ বয়সে, বাকি জীবনটা সে নিজের মতো করে কাটাবে। এখানেও যদি আর ভালো না লাগে, এখান থেকেও চলে যেতে তার দেরি হবে না।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।